যুগে যুগে যুগ নক্বীবদের উপর কুফরী ফতোয়া !! ~~ শাহীদ রিজভী
সম্প্রতি একটা ফতোয়া নিয়ে খুব আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। বলা হয় শীর্ষ স্থানীয় চব্বিশ জন ওলামা মাশায়েখ কর্তৃক একজন আলেমেদ্বীন আল্লামা জয়নুল আবেদীন জুবাইর কে “কুফরী” ফতোয়া দেওয়া হয়েছে। তাই জুবাইর সাহেবকে মানা যাবে না, সম্মান করা যাবে না, সম্পর্ক রাখা যাবে না। অর্থাৎ জুবাইর সাহেবের সাথে দূরবর্তী বা নিকটতম সম্পর্ক রাখা হলে তিনিও “কাফির” সাব্যস্থ হবেন। আমি আলেম নই, একজন আইনজীবী মাত্র। আলেমদের খন্ডন করার যোগ্যতা বা ইচ্ছা কোনটাই আমার নেই। তবে একজন জ্ঞানানুসন্ধিৎসু হিসেবে এ বিষয়ে আমি কিছু পড়াশুনা করার চেষ্টা করেছি। এ ফতোয়া নিয়ে পূর্বেও আমার পোস্ট থেকে আলোচনা করেছিলাম। এখন আবার প্রয়াস পাচ্ছি।
প্রকৃতপক্ষে আলোচ্য ফতোয়া টা #চব্বিশ_জন_আলেম দেননি। আড়াই পাতার আলোচ্য ফতোয়াটা লিখেছেন আরেক জন আলেম নামধারী ব্যক্তি। যিনি ফতোয়াটি লিখার সময় এমনকী কোনও মাদ্রাসার সাথেও সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। বরং বহু আগেই তিনি একটা প্রায় একই রকম অভিযোগের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে চাকুরি চ্যুত হয়েছিলেন।
উক্ত ফতোয়ায় ফতোয়া দাতা আলেম সাহেবের কথার পিঠে কথা হিসেবে মন্তব্য ও মতামত কলামে আরও #চব্বিশ_আলেম মতামত ব্যক্ত করেছেন। যার অধিকাংশ মন্তব্য ও মতামতে “ঘটনা যদি সত্য হয়” এরকম বাক্যাংশ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তার মানে#ঘটনার_সত্যতা সম্পর্কে মন্তব্য কারী সম্মানিত #ওলামা_মাশায়েখ দের মনে সংশয় ছিল কিংবা তাঁরা সন্দেহমুক্ত ছিলেন না। আরও মজার ব্যাপার হলো ফতোয়া কার বিরুদ্ধে দেওয়া হচ্ছিল সেই উদ্দিষ্ট ব্যক্তি আল্লামা জয়নুল আবেদীন জুবাইর সাহেবের নাম আড়াই পাতার কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। পরে অবশ্য সেই ফতোয়ার মন্তব্য কলামে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বয়োঃজ্যেষ্ঠ ও সর্ব শীর্ষ স্থানের অধিকারী#আল্লামা_মুফতী_মুছা_মোজাদ্দেদী এবং #আল্লামা_মুসলেহ_উদ্দীন এই দুজন শীর্ষ স্থানীয় আলেম নিজেরা সেই ফতোয়া ভুল ছিল বলে লিখিত ঘোষণা দিয়ে গেছেন।
ইসলামের ইতিহাস বলছে যুগে যুগে দ্বীনের নক্বীবরাই ফতোয়ার বিষবাষ্পের শিকার হয়েছেন। আজ সারা মুসলিম জাহান যে সকল মহান ইমামদের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে , যাদের ফতোয়া/আইন (সুন্নি/শিয়া মাজহাব) কিংবা যাঁদের সংকলিত হাদিসের উদ্ধৃতি (যেমনঃ ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহি কৃত বুখারী শরীফ) ছাড়া আমাদের আলেম -ওলামা-মুফতি-মুহাদ্দেস-পীর মাশায়েখদের ওয়াজ সম্পন্ন হয় না, আসুন একটু দেখে নেই ,তাদের উপর কিরূপ আচরন করেছিল রাস্ট্র কিংবা আলেম সমাজ। মনকে স্থির করুন। আসুন অন্তরের টাইম মেশিনে চড়ে ঘুরে আসি ইসলামের ইতিহাসের সেরা সময় এর সেরা সন্তানদের প্রতি আমাদের কথিত দ্বীনি সমাজ কি ব্যবহার ও আচরণ করেছিল একটু চোখ বুলিয়ে নিই।
আমাদের পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর রওজা মোবারক রয়েছে যে পবিত্র শহরে সেই সোনার মদীনার পথে দেখুন ইমাম মালিক (রঃ) এর হাত পা বেঁধে মারছে খলিফার সৈন্যরা , মুচড়ে মুচড়ে শরীর থেকে তাঁর হাত ভেঙ্গে ফেলেছে। এর পর চলে যান অন্ধকার কারাগারে , যেখানে বন্দী ইমাম শাফেয়ী (রঃ) আর ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রঃ)। দেখুন তাদের উপর কি নিষ্ঠুর অত্যাচার হচ্ছে।
ঐ দেখুন, ইমাম নাসায়ী (রঃ) কে যেন খুন করে গেল। আর ইমামুল আজম বলে খ্যাত, বিশিষ্ট তাবেয়ী, মুসলিম ব্যবহারশাস্ত্রের প্রবক্তা, স্বাধীন চিন্তা সমর্থক ইমাম আবু হানিফা নু’মান বিন সাবিত কে কুফার কাযীর পদ গ্রহনে অস্বীকৃতির জন্য খলিফা আল মনসুর এর আদেশে প্রকাশ্যে ১১ দিন ধরে প্রত্যহ ১০ ঘা মারার পর তাঁকে ছাড়া হয়। কিন্তু খলিফার দুঃশাসন ও হত্যাকান্ডের সমালোচনা থেকে ইমামে আযমকে বিরত রাখা যায়নি। তাই, খলিফা ইমাম আবু হানিফাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন এবং কারাগারেই বিষ প্রয়োগে তাকে হত্যা করান।
খলিফা আল মনসুর বিষ প্রয়োগে আরো হত্যা করেন রসায়ন শাস্ত্রের জনক জাবীর ইবনে হাইয়ান এর ওস্তাদ মশহুর আলেম ইমাম জাফর আস সাদেক (রঃ) কে। খলিফা হারুনুর রশীদের আদেশে চার বছর জেলখানায় বন্দী থাকাকালীন সিন্দি ইবনে শাহিক বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন ইমাম মুসা কাজেম কে ৭৯৯সালে । খলিফা আল মামুন বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন ইমাম রেজা (রঃ) কে ২৬ মে ৮১৮ সালে ইরানের তুস নগরে।
বিশ্বমাঝে যেক’টি স্থানকে পরিবেশ ও আবহাওয়াগত কারণে “ভূ-স্বর্গ” বলা হয় তাদের মধ্যে “সমরখন্দ” অন্যতম। সেই সমরখন্দ যাঁর কাছে দোযখ সমরুপ ধারণ করে তিনি আর কেউ নন। যিনি সহীহ্ হাদীস এর পরীক্ষায় যুগের মানোত্তীর্ণ হয়েছিলেন বিশ্ববরেন্য মুহাদ্দেস, কোরআনের পরই সবচেয়ে বেশি পঠিত বিশুদ্ধ গ্রন্থ আল জামেউস সহীহ (সহীহ বুখারী) এর সংকলক, যুগশেষ্ঠ ইমাম আবূ আবদুল্লাহ মুহম্মদ ইবনে ইসমাইল আল বুখারী (৮০৯-৮৬৯)। সেই তাঁকে বৃদ্ধাবস্থায় ধর্মদ্রোহ (কুফুরী) এর অভিযোগে মোল্লাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে (যে আন্দোলনের পেছনে স্বয়ং গভর্নরের হাত ছিল) আজীবন নির্বাসন দন্ড দেন বুখারার গভর্নর খালিদ ইবনে আহমদ জহলি। ইমাম বুখারী রহমতুল্লাহি আলাইহিঁ বুখারা থেকে বহিস্কৃত হয়ে বয়কন্দ নামক স্থানে উপস্থিত হন কিন্তু সেখানেও তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলতে থাকে।তখন তিনি সমরখন্দবাসীদের আমন্ত্রনের প্রেক্ষিতে সমরখন্দের দিকে যাত্রা করেন । কিন্তু পথিমধ্যেই বখরতঙ্গ নামক নিভৃত পল্লীতে নিকট আত্বীয় গালীব ইবনে জিবারিলের গৃহে গুরুতর পীড়ায় আক্রান্ত হন। এমতাবস্থায় সমরখন্দবাসীদের পক্ষ থেকে উপর্যপুরি দরখাস্ত আসার প্রেক্ষিতে তিনি তথায় যাবার মনস্থ করেন, কিন্তু পরে জানতে পারলেন বুখারায় তার বিরুদ্ধে ছড়ানো বিদ্বেষের অগ্নিশিখা সমরকন্দকেও গ্রাস করেছে। ইমাম বুখারী সর্বশেষে স্ববরের বাঁধ ভেঙে দু’হাত তুলে প্রার্থনা করেলেন :”হে আল্লাহ! আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও-এ দুনিয়া আমার জন্য ছোট হয়ে গেছে। সমরখন্দের মাটি দু’ ভাগ করে দাও, আমি নিজেই কবরস্থ হই।” পরে সমরখন্দবাসীগণ তাদের ভুল বুঝতে পেরে ইমাম সাহেবকে তথায় নিয়ে যাবার ইচ্ছা করলে তিনি মোজা ও পাগড়ি পরিধান করে দু’ব্যক্তির কাধে ভর করে সওয়ারীর উপর আরোহনের জন্য অগ্রসর হন কিন্তু ১৫/২০ কদম অগ্রসর হয়েই বললেন :”আমাকে ছেড়ে দাও, আমার দূর্বলতা বেড়ে চলেছে”। কিছুক্ষন পরেই নিভে গেল ইমাম বুখারী (রঃ) এর প্রাণ প্রদীপ। দিনটি ছিল ২৬৫ হিজরির সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরের পবিত্র দিন রোজ রোববার।
তাই সকলের প্রতি করজোড়ে মিনতি জানাই- দূরাচারী ফতোয়া থেকে বেরিয়ে আসুন। একে অপরের উপর “কুফর” “মুনাফিক” এরকম ইলজাম দেয়া থেকে বের হয়ে আসুন। তাকফির” অর্থাৎ কাউকে “কাফির” সাব্যস্ত করা খুব সিরিয়াস একটা ব্যাপার। ইমাম মালিক রাহিমাহুল্লাহর একটা “আসার” আছে, যার সারমর্ম হচ্ছে এরকম যে, ১০০ টা দিক বিবেচনা করে যদি দেখা যায় যে, ৯৯টা বিষয়ে কেউ “কুফরির” উপর রয়েছে – কিন্তু ১টা বিষয়ে তাকে ঈমানদার মনে হয়, তবে তিনি (ইমাম মালিক) ঐ ব্যক্তিকে “মুসলিম”-ই মনে করবেন। কারণ ঐ একটা বিষয়ের জন্য যদি আল্লাহ তাকে মুসলিম হিসেবে কবুল কের নেন, তাহলে তাকে “কাফির” “ব্র্যান্ড” করার জন্য, ব্যাপারটা (তাকফির) হয়তো তার উপরই reverse applicable হবে (এই সংক্রান্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর প্রসিদ্ধ হাদীস অনুযায়ী)।
~~ শাহীদ রিজভী