মুজাদ্দিদ আলফে সানী (রঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিব ১০ম শতাব্দীর/সহস্রাব্দের মুজাদ্দিদ হযরত আহম্মদ সারহিন্দী (রঃ) এর সাথে। উনি সব থেকে বেশী পরিচিত মুজাদ্দিদ আলফে সানী (রঃ) নামে। “খাস মুজাদ্দেদী” তরিকার জনক তিনিই। আহম্মদ সারহিন্দী (রঃ) ৯৭৫ হিজরীতে (১৫৬৩ খ্রি.) পাঞ্জাবের তৎকালীন পাতিয়ালা রাজ্যের বিখ্যাত সারহিন্দ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) এর ২৮তম অধঃস্তন বংশধর। তাঁর বয়সকাল ছিল রাসূল (স.)-এর ন্যায় ৬৩ বছর। তাঁর জীবন ও কর্ম তাঁকে সত্যিকারের ওয়ারাছাতুল আম্বিয়ার মর্যাদা দান করেছে। তিনি হানাফী মাজহাবের অনুসারী ছিলেন, তবে ইমাম শাফেয়ীকে তিনি অত্যন্ত ভক্তি শ্রদ্ধা করতেন এবং কোনো কোনো আমল ইমাম শাফেয়ীর তরীকায় সম্পাদন করতেন।
ফসলের ক্ষেতে যেরূপ আগাছা জন্মায় এবং উক্ত আগাছা যথাযথরূপে উৎপাটন না করলে যেভাবে ফসলের মাঠ আগাছার মাঠে পরিণত হয় ঠিক তদ্রুপ ইসলাম নামক শস্যক্ষেত্রেও শিরক, বেদাত, কুফরীসহ বিভিন্ন আগন্তুক মতবাদের আগাছা জন্মায় অথবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আগাছার বীজ ছড়িয়ে দেয়া হয়, যাতে ইসলামের বাগান বাতিলের বাগানে পরিণত হয়। এমতাবস্থায় যে ধর্মনেতা পরিপূর্ণভাবে আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) কে অনুসরণ করে ইসলামের বাগানকে আগাছামুক্ত করার দায়িত্ব পালন করেন তাঁকে বলা হয় মুজাদ্দেদ বা সংস্কার কর্তা।
শেখ আহমদ সারহিন্দী ছিলেন একজন যুগনায়ক, মরদে মুজাদ্দিদ ও মুজাহিদ। ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতের এক মহাসংকটকালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং স্বীয় সাধনা ও কর্মশক্তি গুণে জাতির ইতিহাসে মুজাদ্দিদে আলফেসানী (দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মুজাদ্দিদ) নামে পরিচিত হন। এ প্রসঙ্গে রাসুল (স.) বলেন- “আল্লাহ এই উম্মতের জন্য প্রতি শতাব্দীর অবসানকালে এমন একজন ব্যক্তিকে পাঠাবেন, যিনি উম্মতের স্বার্থে তাঁর দ্বীনের সংস্কার সাধন করবেন।” (আবু দাউদ)
মুজাদ্দিদ সাহেবের উপলব্ধি ও শিক্ষা
সম্রাট আকবর রাজত্ব করেন ১৫৫৬ থেকে ১৬০৬ খ্রি. পর্যন্ত। আহমদ সারহিন্দের জন্ম ১৫৬৩ খ্রি. এবং ইন্তেকাল ১৬২৪ খ্রি.। সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬০৬ খ্রি. সিংহাসনারোহণ করেন। সুতরাং আহমদ সারহিন্দ এই উভয় প্রবল প্রতাপান্বিত মোগল সম্রাটদের রাজত্ব প্রত্যক্ষ করেন। মুজাদ্দেদ (রঃ) যখন সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন তখন সম্রাট আকবরের চূড়ান্ত উন্নতি, সমৃদ্ধি ও শানশওকতের কাল। ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য আকবর তখন ইরানী শিয়া ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ঠাকুর-পুরোহিতদের পরামর্শে সঠিক ইসলামকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দ্বীনে ইলাহী নামক কুফরী ধর্ম প্রচারে ব্যস্ত। এমতাবস্থায় শেখ আহমদ সারহিন্দ অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতো প্রথমে রোগীর রোগের কারণ নির্ণয় করেন এবং অতঃপর রোগমুক্তির দাওয়াই সংগ্রহ করে প্রয়োগ করা শুরু করেন। ক্রমান্বয়ে তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতি সফলতার দিকে এগিয়ে যায় এবং মুরতাদ আকবর শেষ জীবনে তওবা করে নিজ ধর্মে ফিরে আসেন এবং সম্রাট জাহাঙ্গীর পর্যায়ক্রমে সংশোধিত হয়ে এক পর্যায়ে শেখ আহমদ সারহিন্দ (রঃ) এর মাধ্যমে ইসলামের নিকট আত্মসমর্পণ করেন ও শরীয়া আইন জারি করেন।
শেখ আহমদ সারহিন্দীর সংস্কার কর্মসূচি
তিনি সহজ-সরল-বোধগম্য ভাষায় তাঁর উপলব্ধি ও সিদ্ধান্ত মৌখিক ও লিখিত আকারে জাতির সামনে তুলে ধরেন। তিনি বুঝেছিলেন মূল ইসলাম ধর্মে অন্যান্য বিষয় অনুপ্রবেশের ধারাবাহিকতায় ধর্মনেতাদের বেশির ভাগ অংশ বিপদগামী এবং মাতৃভাষায় ইসলামকে না বুঝার কারণে জনগণ গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। তাঁর সমকালীন উপলব্ধি ছিল- শাসকগোষ্ঠীই সকল অনাচারের মূল। আরবীতে একটি প্রবচন আছে যার অর্থ হলো- “জনগণ শাসকদেরই অনুসারী হয়ে থাকে।” এ প্রসঙ্গে পত্র নং-৪৭, (১ম খ-)-এর ৬৫ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, “সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাদশাহর সম্পর্ক ঠিক তেমন- যেমন সম্পর্ক দেহের সাথে মনের। মন যদি ঠিক থাকে তবে দেহও ঠিক থাকে। যদি মন বিগড়ে যায় তবে দেহ বিপথগামী হয়। সুতরাং বাদশাহর সংশোধন সাম্রাজ্যেরই সংশোধন। বাদশাহর বিপর্যয় সমগ্র সাম্রাজ্যের ধ্বংসের নামান্তর। এ জন্য তিনি শাসক পরিবর্তনের চাইতে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনকেই অগ্রাধিকার দেন। এর আলোকে তাঁর কর্মসূচি ছিল-
(ক) বেসরকারি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সংশোধন
(খ) উচ্চপদস্থ সরকারি আমলাদের সংশোধন
(গ) বাদশাহর সংশোধন
(ঘ) দুনিয়াদার ও দরবারী আলেমদের সংশোধন
উক্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের পদ্ধতি ও পন্থা ছিল নিম্নরূপ-
তিনি তাঁর কর্মসূচি বাস্তবায়নে তরবারির আশ্রয় নেননি। তিনি ভারতের নেতৃস্থানীয় সামরিক-বেসামরিক, সরকারি-বেসরকারি গুরত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এবং জনগণের মনোজগতে বিপ্লব সৃষ্টির পন্থা অনুসরণ করেন। উক্ত বিপ্লব তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষের চিন্তায় ও দৃষ্টিভঙ্গীতে, নৈতিকতা ও তামাদ্দুনে, রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থায়, সমাজ ও অর্থনীতিতে।
আকবরের মৃত্যুর পর ১০১৪ হিজরীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর সিংহাসনারোহণ করলে তিনি চূড়ান্ত লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। তিনি স্বমতে দীক্ষিত দরবারের সভাসদদের দ্বারা জাহাঙ্গীরের মনোভাবকে ইসলামের অনুকূলে আনতে সক্ষম হন এবং এক পর্যায়ে সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দেদ (র.)-এর দাবিগুলো মেনে নেন। অবশ্য দাবি মানার পূর্বে সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দিদকে স্বীয় সিংহাসনের জন্য হুমকি মনে করে কুখ্যাত গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দী করেন। দুর্গাধিপতি এক সময় সম্রাটের নিকট এই মর্মে রিপোর্ট প্রেরণ করেন যে, “আহমদ সারহিন্দ এর সংস্পর্শে থেকে গোয়ালিয়র দুর্গের পশুসুলভ বন্দীরা মানুষে পরিণত হয়েছে এবং মানুষগুলো ফেরেশতায় পরিণত হয়েছে।” এরূপ রিপোর্ট পাওয়ার পর সম্রাট জাহাঙ্গীর নিজের ভুল বুঝতে পারেন এবং মুজাদ্দেদকে মুক্তি দান করে তাঁর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। সাক্ষাতে মুজাদ্দিদ (র.) সম্রাটের নিকট স্বীয় দাবিনামা পেশ করেন। তাঁর দাবিগুলো ছিল-
(ক) সম্রাটকে সেজদা করার রীতি সম্পূর্ণভাবে রহিত করতে হবে।
(খ) মুসলমানদেরকে গরু জবেহ করার অনুমতি দিতে হবে।
(গ) বাদশাহ ও তাঁর দরবারীদের জামায়াতে নামাজ আদায় করতে হবে।
(ঘ) কাজীর পদ ও শরীয়ত বিভাগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
(ঙ) সমস্ত বেদায়াত ও ইসলামবিরোধী অনাচারকে সমূলে উৎখাত করতে হবে।
(চ) ইসলামবিরোধী যাবতীয় আইন রহিত করতে হবে।
(ছ) ভগ্ন ও বিধ্বস্ত মসজিদগুলোকে পুনরায় আবাদ করতে হবে।
(উল্লেখ্য, সম্রাট আকবরের আমলে হিন্দুরা ভারতের অনেক মসজিদকে ধ্বংস করেছিল এবং অনেকগুলোকে মন্দিরে পরিণত করেছিল।)
সম্রাট জাহাঙ্গীর মুজাদ্দেদ (র.)-এর দাবিসমূহ সন্তুষ্টচিত্তে মেনে নেন এবং শাহী ফরমান জারি করে তা কার্যকর করেন।
মুজাদ্দেদ (র.)-এর দাবির সারকথা ছিল নির্ভেজাল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা। অপর কোনো ধর্ম বা ফেরকার বিরোধিতা করা বা ব্যক্তিগত লাভের কোনো ব্যাপার এতে ছিল না।
আমাদের দেশেও উনার প্রবর্তিত তরিকায়ে খাস মুজাদ্দিদ এর অনেক অনুসারী রয়েছেন যারা ইসলামের খেদমতে নিয়োজিত আছেন। বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য ইন্টারনেটে তাদের খুব সন্দর দুটি ওয়েবসাইটঃ
১. http://www.hakimabad.com/
২. https://sites.google.com/site/tariqaekhasmujaddidia/
পোষ্টি পড়া শেষ হলে আপনারা আপনাদের বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন যাতে তারাও উনার সম্পর্কে জানতে পারেন।