খবরের বিস্তারিত...


তরুনের হাতে করুণ ভাষা–কাশেম শাহ

 

প্রমথ চৌধুরী লিখেছিলেন, “বাংলা ভাষা আহত হয়েছে সিলেটে আর নিহত হয়েছে চট্টগ্রামে”। কথাটি হয়তো সর্বাৎশে সত্য নয়। বাংলা ভাষা চট্টগ্রামে এসে একেবারে নিহত না হলেও ক্ষত-বিক্ষত তো হয়েছে। তবে আধুনিক কালে, আরো নির্দিষ্ট করে বললে ফেসবুকের এই অতি আধুনিক সময়ে এসে শুধু নিহত নয় বরং নির্মমভাবে নিহত হয়েছে বাংলা ভাষা। যে ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন রফিক-জব্বার-সালামরা, সে ভাষা মর্মান্তিকভাবে খুন হয়েছে বহিরাগত ইংরেজি ও হিন্দির আক্রমনে। বিশেষ করে তরুন প্রজন্মের ফেসবুক ইউজাররা স্ট্যাটাস, কমেন্টস আর চ্যাটে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি মিশ্রিত ভাষার ব্যবহারে বাংলাকে চরম অপমান করে চলেছে প্রতিনিয়ত।

 

স্বাভবিকভাবে প্রশ্ন আসে এ দায় কার? ফেসবুক ব্যবহারকারীর না আমাদের সংস্কৃতির?

সঠিক জবাব দেয়া কঠিন।

তবে এইটুকু বলা যায়, গত দুই দশক ধরে যে উম্নুক্ত সংস্কৃতি আমরা আমদানী করেছি তার কুফল আমরা ইতিমধ্যে পেতে শুরু করেছি। শুধু ফেসবুক স্ট্যাটাস নয়, তরুন প্রজন্মের কথা-বার্তায়, চালচলনে তার প্রকাশ দৃশ্যমান। মুখের ভাষা থেকে শরীরের পোষাক সবকাটাতেই বিজাতীয় সংস্কৃতির জয় জয়কার।

আমরা একটা অভিযোগ প্রায়ই করি, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা জাতীয় সঙ্গীত গায় না, তারা জানে না- এটা যেমন অনেকাংশে সত্য, তেমনি যদি প্রশ্ন তোলা হয়, কয়টা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থীরা জাতীয় সঙ্গীত গাইতে জানে, বাংলা মাধ্যম স্কুল-কলেজগুলো কিংবা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের কত শতাংশ শুদ্ধ করে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে পারে, কেউ কি তার সঠিক পরিসংখ্যান দিতে পারবেন?

কারও কাছে কি এর জবাব আছে?

সরকারি বা বেসরকারি কোনো সংস্থা?

 

বলিউডের কোনো ফিল্মের গান রিলিজ হওয়ার সাথে সাথে তা ঠোটস্থ হয়ে যায় যে জেনারেশনের, সে জেনারেশনের জাতীয় সঙ্গীত মনে রাখার অবকাশ কই?

আগে দেখতাম, যে কোনো অনুষ্ঠানের শুরুতে পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হতো জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে। কিন্তু এখন এ সংস্কৃতি চোখে পড়ে না বললেই চলে। প্রায় প্রতিদিন কোথাও না কোথাও নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন হচ্ছে, বিশাল বাজেটে দেশের মন্ত্রি-এমপি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্তরা, বিশিষ্টজনেরা সেখানে উপস্থিত থাকেন, মিডিয়া সেসব ফলাও করে প্রচার করে।

কিন্তু কেউ কোনদিন জানতে চান নি, অনুষ্টানের শুরুতে দেশ-মাতৃকার সন্তানদের একটু স্মরণ করলে কি এমনটি হতো?

একবার জাতীয় সঙ্গীত পড়া হলে অনুষ্ঠানে কতটা সময় নষ্ট হতো?

ঘন্টার পর ঘন্টা যে অনুষ্ঠান, সে অনুষ্ঠানে তিন মিনিট ব্যয় করার মত সময় নেই আয়োজকদের।

তারাই আবার দেশের জাতীয়তাবোধের ধারক-বাহক।

 

জাতীয় সঙ্গীত গাইলে দেশের প্রতি মমত্ববোধ তৈরি হয়। শিশু কিশোরেরা সেটি গাইতে শিখে, জানতে পারে দেশত্ববোধ সম্পর্কে, তৈরি হয় দেশপ্রেম। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টগুলোতেও মাঠে দাড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইবার সময় হয়, সময় হয়না শুধু স্থানীয় অনুষ্ঠানমালায়। এ দোষ তরুন প্রজন্মের নয়, এ দোষ শিক্ষার্থীর নয়, এ দোষ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার। ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থার করুন দশার দায় বহন করছে তরুন সমাজ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক লেভেলের স্কুলগুলোতে তাও যা একটু জাতীয় সঙ্গীত চর্চা হয়, কলেজ-প্রাইভেট বিশবিদ্যালয়গুলোতে সে চর্চাও নেই। শুধু জাতীয় সঙ্গীত নয়, জাতীয়তা বোধ কিংবা শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চা এসব প্রতিষ্ঠানে সুদূর পরাহত। ফলে ফেসবুকিং নামক ডিজিটাল জগতে বাংলা ভাষাকে করুণ মৃত্যু বরন করতে হচ্ছে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত।

 

একুশে ফেব্রুয়ারী, ২৬ মার্চ কিংবা ১৬ ডিসেম্বরের মত দিবসগুলোর সঙ্গে আমাদের আবেগ-ভালবাসা জড়িত। আমাদের ভাই-বোনেরা কিংবা সন্তানেরা যখন এ আবেগকে পায়ে দলিত করেন তখন আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরন হয়। গত কয়েকবছর ধরে একই ধরনের একটি প্রতিবেদন প্রচার আসছে বেসরকারি চ্যানেলগুলো, সেটি হচ্ছে জাতীয় দিবসসমুহে শহিদদের প্রতি যারা শ্রদ্ধা জানাতে যান তাদের একটি অংশ (তরুন) জানেইনা, কি জন্য তারা শহীদ মিনারে বা স্মৃতিসৌধে গিয়েছেন। একুশে ফেব্রুয়ারী কি ঘটেছিল, কি হয়েছিল ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে, শহীদ বুদ্ধিজীবি কারা, সাত বীরশ্রেষ্ঠ কে কে কিংবা আর সহজ কিছু প্রশ্ন, যার উত্তর তাদের কাছে নেই।

বলতে দ্বিধা নেই, এসব প্রশ্নের উত্তর যাদের কাছে নেই তাদের প্রায় সবাই এসএসসি-এইচএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ পাঁচ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী। তাদের সাফল্যে আমরা অভিভুত হই, আনন্দিত হই, উল্লাস-উচ্ছাস প্রকাশ করি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি দেখে! সবাই হয়ত জানেন না এমন নয়, কিন্তু এ সংখ্যাটা বেশি, একটু ভাল করে খোঁজ নিলে দেখবেন, আমার-আপনার ঘরেই আছে এমন কেউ না কেউ। এই যে না জানার অপরাধ, তা তাদের একার নয়, তার দায়ভার নিতে হবে আমাদের।

আমাদের আজকাল জীবনচারন হয়ে উঠেছে বড় বেশি অনুষ্ঠান ও সেলফি নির্ভর। শহীদ মিনারে যাই আর স্মৃতিসৌধে, সেখানে পৌছার আগেই সেলফি তুলে ফেসবুকে চেক ইন না দিলে আমাদের দিবস পালন স্বার্থক হয়না।

 

আমাদের জাতীয়তাবোধ আটকা পড়েছে সেলফিতে। ইদানিং আবার নতুন করে জাতীয়তাবোধ প্রকাশের স্টাইল বের হয়েছে। দেশকে কতটা ভালবাসি! বোঝাতে জাতীয় দিবস ও মাসগুলোতে জাতীয় পতাকা ও শহীদ মিনারকে প্রোফাইল পিক বানাই। ওই প্রোফাইল পিক পর্যন্তই আটকা আমাদের দেশপ্রেম।

এই কঠিন দুরাবস্থা থেকে পরিত্রানের উপায় খুজে বের করতে হবে। নইলে অন্ধকার পথে হাঁটতে হাঁটতে একদিন আমরা কঠিন সর্বনাশের অতল গহ্বরে পতিত হবো, বুঝে উঠার আগেই। সাবধান হতে হবে, সচেতন, সজ্ঞান করতে হবে আমার-আপনার সন্তানকে, শিক্ষার্থীকে। তার আগে সচেতন হতে হবে আমাদের নিজেদের। সংস্কৃতি, বিজাতীয় সংস্কৃতি ও অপ সংস্কৃতির মধ্যে তফাত করতে না পারলে জাতীয় জীবনে কঠিন সময়ের জন্য অপেক্ষার প্রহর গোনা ছাড়া আর কোনো পথই খোলা থাকবেনা আমাদের।

 

 

লেখকঃ সিনিয়র সহ-সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

 

 

Comments

comments