খবরের বিস্তারিত...


ইসলামী ছাত্রসেনা’র প্রতিষ্ঠার দিনগুলো – ড. সাইয়েদ আব্দুল্লাহ আল মা’রূফ

 

 

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা এখন যার দখলে তা হচ্ছে ইসলামী ছাত্রসেনা। ১৯৮০ সালের ২১ জানুয়ারী এর যাত্রা শুরু হয়। সময়ের ব্যবধানে এখন ইসলামী আন্দোলনের এক বিরাট শক্তি হিসেবে ইতোমধ্যে এটি শক্ত ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে গেছে।

 

বলা যায় এ আন্দোলন একটি শুন্যতা পূরন করেছে। ৮০ এর দশকে বাতিল সংগঠন হিসেবে একটি ইসলামী ছাত্র সংগঠন তখন ময়দানে খুবই তৎপর ছিল। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক এ সংগঠনটি তরুন ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অবস্থান করে নিয়েছিল। একইভাবে মাঠে-ময়দানে তাদের মুরব্বি সংগঠন তাদের নেতাদের সুরক্ষা দিত। এরা গলাবাজি করতো গলাবাজদের।

 

তখন এদের পুস্তিকা ও কথাবার্তায় একটি প্রতিপক্ষকে আঘাত করতো, সে প্রতিপক্ষ হচ্ছে পীর মাশায়েখ, তরীকত, তাসাওফ, এবং সুন্নি আকিদার কিছু বিষয়। এরা যেয়েতু ওহাবি আকিদা আশ্রয়ী দল তারা নবীজিকে মনে করতো আমাদের মত সাধারন মানুষ এবং সাহাবী হচ্ছেন নবীর মন্ত্রী পরিষদ। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার প্রক্রিয়া ছাড়া অন্যসব ব্যক্তিগত আমল-ইবাদত এসব তাদের দৃষ্টিতে ছিল দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ। নবীজির মুজিজাকে স্বীকার করলেও এসবের আলোচনা এড়িয়ে যেত এবং অলিদের কারামত বলতে গেলেই অবিশ্বাসই করতো। কারামতের বর্ণনা আসলেই এরা উপহাস করতো। তাদের ধারনা ও বিশ্বাস হচ্ছে অলৌকিক বিষয় বর্ণনা করে সময় নষ্ট না করে কাজের কাজ যেটা সেটা করা। তাগুতি শক্তিকে উৎখাত করা। অনেকেই এতে প্রনোদিত হয়েছে বৈকি, কারন তাদের কথার বাস্তবতা খুঁজতে বেশিদূর যেতে হতো না। কিন্তু গোটা আধ্যাতিকতা বা ইহসানকে অস্বীকার করা এবং তাসাওফ বা আত্নশুদ্ধির পথকে অবজ্ঞা করা যে কতোবড় আঘাত তা হক্কানি আলেম ও পীরগন বুঝতে পেরে যে যার স্থান থেকে মৃদু প্রতিবাদ করে আসছিল। সর্বশেষ সাঈদি নামের গায়রে আলেম বক্তার প্রতিনিয়ত আক্বীদা বিরোধী কথা শুনে সুন্নি ঘরানার সকল কেন্দ্রে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। তখন তরুন সমাজের সুন্নিদের কোনো সংগঠন থাকাটা যে সময়ের দাবি এটা অনেকেই বুঝতে পারেন এবং আলাপ আলোচনা চলতে থাকে।

 

সে সময় আমাদের অগ্রগামী ক্লাসের কয়েকজন বড় ভাই তখন শীষস্থানীয় পীর মাশায়েখদের উপস্থিতিতে দেব পাহাড়ে আহলা দরবার শরীফের খানকায় তাৎক্ষনিকভাবে একটি কমিটি করেন। নাম বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা। সুন্নি মতাদর্শ ভিত্তিক ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্লোগান নিয়ে গঠিত হয় প্রথম ইসলামী ছাত্র সংগঠন।

আমি তখন জামেয়া আহমদিয়া কামিল প্রথম বর্ষের ছাত্র। এরকম কত সংগঠন সকালে করে তো বিকালে থাকেনা। এইতো আমাদের সমাজে অহরহ চলছে। ক’মাস ধরে এ খবর আস্তে আস্তে সুন্নি মাদরাসার ছাত্রদের কানে যায় যে, সুন্নিদের একটি সংগঠন করার প্রয়াস চলছে। নীতিগতভাবে সবাই এটি সমর্থন করে। কিন্তু কিছু পীরের দরবার পরিক্ষা-নিরক্ষা পর্যায়ে রাখে এ খবরকে।

 

জামেয়া যেহেতু মাদরাসার ও তরিকার কেন্দ্র হিসেবে চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় অবস্থানে আছে তারা প্রথমে এটাকে একটি কথার কথা মনে করে। অনেক শিক্ষক মনে করে আমাদের সাবেক মেধাবীরা হয়তো একটি ছাত্র সংগঠন করছে। বড় জাহাজের ক্যাপ্টেন যেমন দূরে একটি ছোট্টো একটি ডিঙ্গি নৌকা দেখে ভাবলেশহীন থাকে, তেমনি অবস্থা।

কেউ কেউ ছাত্রদের কোনো সংগঠন করতে দিলে কখন কি করে বসে, এদের বাংলাদেশের ছাত্র আন্দলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এখন যার দখলে তা আসকারা দিওনা। ফলে জামেয়ার ভেতর ছাত্রসেনার অফিসিয়াল কোনো স্বীকৃতি ছিলো না। আহলে রাসুল (দ.) সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহ.) দূরদর্শী ছিলেন। তিনি শুরু থেকেই নীতিগত সমর্থন দেন, দোয়া করেন। এতে অন্তত ছাত্রসেনা অপাংক্তেয় থাকল না। এ ছাড়া জামেয়ার এই সকল বড় ভাইয়েরা মেধাবী ছাত্র ও সাংগঠনিক প্রতিভা সম্পন্ন ছাত্র ছিলেন বিধায় সচেতন মহলে তখনই কিছুটা গুরুত্ব পায়।

 

এ হচ্ছে আমার দেখা সে সময়কার একটি সাধারন দৃশ্য।

অন্য আরেকভাবেও তা দেখে থাকতে পারেন। এবার বলবো আমি কিভাবে ছাত্রসেনায় যোগ দিলাম।

১৯৮১ সালে জামেয়া থেকেই আমি মাদরাসা বোর্ডে ফাজিল ক্লাসে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলাম। তখন কামিলের ছাত্র। প্রবন্ধ, কবিতা, ইসলামী গান রচনায় বেশ কিছু পুরস্কার পাই এ সময়। জাতীয় একটি রচনা প্রতিযোগীতায় প্রথম স্থান অধিকার করে সে সময় ৫ হাজার টাকা পুরস্কার লাভ করি। সাধারন ছাত্রদের মধ্যে আমার একটি সম্মান-ভালবাসার স্থান ছিল।

 

আর বড় ভাইদের কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়েই ৮০ সালেই যোগ দিই ছাত্রসেনায়। এতে বহু ছাত্র অনুপ্রানিত হয়। তারা মনে করে মেধাবী তালিকায় শীর্ষস্থানীয় অধিকারীর যদি সংগঠনের কারণে লেখা-পড়া নষ্ট না হয়, আমাদেরও হবেনা।

আমি এ সময় কয়েকটা সভায় আমার চিন্তা-চেতনা তুলে ধরি। হক পন্থীদের একটি যুব সংগঠন বা ছাত্র সংগঠন না থাকলে আমাদের সামনেই মুরব্বী ওয়াজ করতে গেলেই মার খাবে। এ ছাড়া নবীর মুহাব্বতের মৌলিক দাবির বাস্তবায়নে সংগঠিতভাবে কাজ করতে হবে। তবে আমি শুরু থেকে এ কথা বলি যে, আপাতত বাতিলের প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠে নামলেও আমাদের উচিত কারো বিরোধিতা করার জন্য নয়, সংগঠন করতে হবে মানুষকে ছিরাতুল মুস্তাকিম দেখানোর জন্য, হকের পতাকা উড্ডীন হলে বাতিল যেখানেই থাকবে তার খবর হয়ে যাবে।

এ সময় মনে প্রাণে ইসলামী যুব শক্তি জাগরনের জন্য আকুল আকুতি ছিলো। এ সময় নিজেদের আর্দশের বাণীবাহী একটি সংগীতই পারে শিরায় শিরায় প্রণোদনা জাগাতে। এ দ্যোতনায় ঝংকৃত হবে তরুণ মনের বীণা। আশেকে রাসূলদের দিলে সে কথা ফূঁকে দিতে হবে যা তার মননে রেখাপাত করবে। একদিন বা একরাতে সামনেই থাকা একটি পাতায় লিখলাম ‘ছাত্রসেনা জিন্দাবাদ’

নবীজির শানে পতাকা বাহী

নিবেদিত প্রান এই বীর সিপাহী

নবী প্রেম সিন্ধুতে অবগাহী

মিটায় মনের সাধ

 

এভাবে ১৫ টির মত ছান্দসিক পংতিমালা লিখে ফেললাম। সুরও নিজের করা। আমারই কন্ঠে বারবার গাইলাম। ক্যাসেট ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। পরে তো পত্রিকায় ছাপা হলো। এর মধ্য থেকে কয়েকটি নিয়ে ইসলামী ছাত্রসেনার “সেনা সংগীত” ঘোষিত হলো। আর আজতো কোটি কন্ঠে এ গান। এ সংগীতটির মকবুলিয়ত হচ্ছে ছাত্রসেনার মকবুলিয়তের অন্যতম নির্দশন। এই একটি সংগীত আমার আখেরাতের পুঁজি। আমি অধমের কোনো সাধ্যই ছিল না এটি লেখা ও প্রসারের। এটি ছাত্রসেনার প্রতি আল্লাহর অনুকম্পা ও প্রিয় নবীজির রহমত।

 

সংগীতটির জন্য আমাকে যারা ভালোবাসেন তারা প্রকৃতপক্ষে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতকে ভালোবাসেন। তখন ঐ সকল মেধাবী বড় ভাইগণ ও সচেতন সুন্নি সমাজ জেগে উঠলেই পাবেন কাঙ্খিত মুক্তির দিশা।

 

সংগীত রচনা করে তখন ভাবিনি যে বড় কিছু করেছি। কত কবিতাই লিখি, সংরক্ষন করিনা। আবার কবিতার খাতা হারিয়ে যায়।

আমি তখন নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে পোস্টারে লিখতাম, লাগাতাম। বার আউলিয়া, গহিরা, রাউজান, বোয়ালখালী ইত্যাদী থানায় গিয়ে সাংগঠনিক কাজ করতাম। অধিকাংশ সময় আমার সাথে থাকতেন তৈয়ব ভাই। এ সময়ে আমার কলমি নাম ছিল শাহ্ আলম আল মা’রুফ।

 

ছাত্রসেনার প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় বছরে পা দিয়েছে এ সংগঠন। প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত হল মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে। সভাপতির পরেই দ্বিতীয় ফুলের মালা আমার গলায়। বুঝতেই পারছেন একজন জাপানীর (চট্টগ্রামবাসীর দেওয়া বহিরাগতদের ডাক নাম) গলায় ফুলের মালা!

আঞ্চলিকতার উর্দ্ধে থেকে কাজ করেছি আমরা। অর্থ লোভ কাজ করেনি। কি পজিশনে আছি সেটাও মাথায় রাখিনি। তবে চট্টগ্রামের ভাইয়েরাই আমাকে চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রথম সভাপতি বানিয়েছিলেন। যে ফিরোজ আলম একটি ব্যাগ হাতে করে বরিশাল থেকে হঠাৎ করে জামেয়ায় আমার কাছে এসেছিল, দাখিল শ্রেণির শিশু ছাত্র, সেই ছাত্রসেনার কেন্দ্রীয় সভাপতি হয়েছিল দু-দুবার। এমনিভাবে তৎকালীন ছাত্রসেনার সকলেই আমাকে সমর্থন দিয়েছিল। জামেয়ায় জায়গা না পেয়ে পাশের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ধূলামলিন সংকীর্ণ বারান্দায় আমরা সভা করতাম।

কত যে স্মৃতি আজ জেগে উঠছে। নিজের কথা বলা একটু কঠিন। আজকের ছাত্রসেনার একজন কর্মীকে বলব, কারো প্রতি হিংসা নয় বরং মহানবী (স.)’র প্রতি ভালবাসা যেন আমাদের কর্মের প্রেরণা হয়। মানুষের হেদায়াত জঙ্গিবাদী কর্ম তৎপরতায় কোনোদিন সম্ভব নয়। আল্লাহর অলিরা যেভাবে মানুষ পশু-পাখি, গাছ-পালা সবাইকে ভালবাসার চোখে দেখেছেন, সে চোখে পৃথিবীকে দেখতে হবে। বাতিল পথে ভাইটি মনের ভুলে পানিতে ডুবে যাচ্ছে, তাকে উদ্ধার করতে হবে। কারো মৃত্যু কামনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।

 

পরিশেষে আমি এ কথা বলব সংগঠন অর্থ ঐক্য। তাই অনৈক্যের হাতছানি উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হবে। সংগঠনের সবাই একমাপের হয়না, তবুও সাথে রাখতে হবে। নিজের প্রতি ওজর গ্রহনের মনোভাব নিয়ে চলতে হবে। অন্যদের প্রতি সংশোধনীয় মনোভাব রাখতে হবে। সংগঠন কখনো জ্ঞান অর্জনের বাধা হতে পারেনা। আমাদের অনেকেই ঈমান, শরীয়ত ও ইহসানের বুনিয়াদ বিষয়গুলো ভালভাবে জানেনা। তাদেরকে তা শিক্ষা দিতে হবে। নিজেরাও আজীবন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। ছাত্র জীবনের পর যে যেখানেই থাকি কিছু টাকা দিয়ে সংগঠনকে শক্তি যোগাতে হবে। ছাত্র জীবন শেষ হলেও সব শেষ হয়ে যাবেনা। ওটাতো আসলেই প্রশিক্ষণ সময়। আমাদের দেশকে ভালবাসতে হবে। সন্ত্রাসী কাজ করে যারা ইসলামী জিহাদ নাম দিচ্ছে তাদের রুখতে হবে। তাই ছাত্রসেনার মত সংগঠন বড় বেশি প্রয়োজন।

 

মহান আল্লাহ আমাদেরকে সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে মানব কল্যাণে অবদান রাখার তওফিক দিন।

আমিন।

 

লেখকঃ সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সদস্য, ও.আই.সি ইন্টারন্যাশনাল ফিকহ্ একাডেমী

ইসলামী ছাত্রসেনার দলীয় সঙ্গীত রচয়িতা।

Comments

comments