খবরের বিস্তারিত...


মি’রাজ বা ঊর্ধ্বগমনঃ স্বচক্ষে আল্লাহর দীদার লাভ ও নবীজীর ’সূরতে হাক্কী’র আত্মপ্রকাশ

জুলাই 17, 2018 আক্বীদা

নবী করিম [ﷺ]-এঁর উর্দ্ধজগতের মো’জেযা সমূহের মধ্যে মি’রাজ গমন একটি বিস্ময়কর মো’জেযা। এজন্যই মি’রাজের আয়াতের শুরুতেই আল্লাহ পাক ‘সোব্হানাল্লাহ্’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন – যা কেবল আশ্চর্য্যজনক ঘটনার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। স্বশরীরে মি’রাজ গমনের প্রমাণ স্বরূপ কোরআনের ‘বিআব্দিহী’ শব্দটি তাৎপর্য্যপূর্ণ। কেননা, ‘আবদুন’ শব্দটি দ্বারা রুহ ও দেহের সমষ্টিকে বুঝান হয়েছে। তদুপরি- বোরাক প্রেরণ ও বোরাক কর্তৃক নবী করিম [ﷺ]-কে বহন করে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেও স্বশরীরে মি’রাজ গমনের প্রমাণ পাওয়া যায়। সর্বোপরী স্বপ্নে বা রুহানীভাবে মি’রাজের দাবী করা হলে কোরাইশদের মধ্যে এত হৈ চৈ হতোনা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের সকল ইমামগণই স্বশরীরে মি’রাজ গমনের কথা স্বীকার করেছেন।

মি’রাজের ঘটনাটি নবীজীর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এজন্য যে, এর সাথে গতির সম্পর্ক এবং সময় ও স্থানের সঙ্কোচনের তত্ত্ব জড়িত রয়েছে। সূর্য্যরে আলোর গতি সেকেন্ডে একলক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল। পৃথিবীতে সূর্যের আলো পৌঁছতে লাগে আট মিনিট বিশ সেকেন্ড। এ হিসেবে পৃথিবী হতে সূর্যের দূরত্ব- নয় কোটি তিরিশ লক্ষ মাইল। অথচ নবী করিম [ﷺ] মূহুর্তের মধ্যে চন্দ্র, সূর্য, সিদরাতুল মোনতাহা, আরশ-কুরছি ভ্রমণ করে লা-মকানে আল্লাহর দীদার লাভ করে নব্বই হাজার কালাম করে পুনরায় মক্কা শরীফে ফিরে আসেন। এসে দেখেন, বিছানা তখনও গরম রয়েছে। এর চেয়ে আশ্চর্য আর কি হতে পারে? নবী করিম [ﷺ]-এঁর নূরের গতি কত ছিল- এ থেকেই অনুমান করা যায়। কেননা, তিনি ছিলেন নূর। যাওয়ার সময় বোরাক ছিল – কিন্তু ফেরার সময় বোরাক ছিলনা (রুহুল বয়ান)।

মি’রাজের মধ্যে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- অন্যান্য নবীগণের সমস্ত মো’জেযা নবী করিম [ﷺ]-এঁর মধ্যে একত্রিত হয়েছিল। হযরত মুছা (عليه السلام) তূর পর্বতে আল্লাহর সাথে কালাম করেছেন। হযরত ঈছা (عليه السلام) স্বশরীরে আকাশে অবস্থান করছেন এবং হযরত ইদ্রিছ (عليه السلام) স্বশরীরে বেহেস্তে অবস্থান করছেন।

তাঁদের চেয়েও উন্নত মাকামে ও উচ্চমর্যাদায় আল্লাহ পাক নবী করিম [ﷺ]-কে নিয়ে সবার উপরে মর্যাদা প্রদান করেছেন। মুছা (عليه السلام) নিজে গিয়েছিলেন তূর পর্বতে। কিন্তু আমাদের প্রিয় নবী [ﷺ]-কে আল্লাহ্তায়ালা দাওয়াত করে বোরাকে চড়িয়ে ফেরেশতাদের মিছিলসহকারে প্রথমে বায়তুল মোকাদ্দাছে নিয়েছিলেন। সেখানে সব নবীগণকে স্বশরীরে উপস্থিত করে হুযুর করিম [ﷺ]-এঁর মোক্তাদী বানিয়েছিলেন। সেদিনই সমস্ত নবীগনের ইমাম হয়ে নবী করিম [ﷺ] নবীগণেরও নবী অভিষেক লাভ করেছিলান। সমস্ত নবীগণ অষ্ট অঙ্গ (দুই হাত, দুই পা, দুই হাটু, নাক ও কপাল) দিয়ে স্বশরীরে নামায আদায় করেছিলেন সেদিন। সমস্ত নবীগণ যে স্বশরীরে জীবিত, তারই বাস্তব প্রমাণ মিলেছিল মি’রাজের রাত্রে। সমস্ত নবীগণ আপন আপন রওযায় জীবিত (হাদীস)।

মি’রাজের রাত্রে নবী করিম [ﷺ]-কে প্রথম সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিলো জিব্রাইল, মিকাইল ও ইস্রাফিল ফেরেশতাসহ তাঁদের অধীনে সত্তর হাজার ফেরেশতা দ্বারা। দ্বিতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল বাইতুল মোকাদ্দেছে নবীগণের (عليهم السلام) দ্বারা। তৃতীয় সম্বর্ধনা দেয়া হয়েছিল আকাশের ফেরেশতা, হুর ও নবীগণের দ্বারা এবং চতুর্থ ও শেষ সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। সিদরাতুল মুনতাহা এবং আরশ মোয়াল্লা অতিক্রম করার পর স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা একশত বার সম্বর্ধনামূলক বাক্য دن منى يا محمد অর্থাৎ ‘হে প্রিয় বন্ধু মোহাম্মদ, আপনি আমার অতি নিকটে আসুন” – একথা বলে নবী করিম [ﷺ]-কে সম্মানিত করেছিলেন। কোরআন মজিদে (سورة النجم – الآية ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّى ( আয়াতটি এদিকেই ইঙ্গিতবহ- বলে ‘তাফসীরে মুগ্নী’ ও ‘মিরছাদুল ইবাদ’ নামক গ্রন্থদ্বয়ের বরাত দিয়ে ‘রিয়াজুন্নাছেহীন’ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত কিতাবখানা সাত শত বৎসর পূর্বে ফারসি ভাষায় লিখিত। লেখকের নিকট কিতাবখানা সংরক্ষিত আছে।

মি’রাজের ঘটনা ঘটেছিল নবুয়তের ১১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিনের মাথায়। অর্থাৎ নবুয়তের ২৩ বৎসরের দায়িত্ব পালনের মাঝামাঝি সময়ে। সে সময় হুযুর [ﷺ]-এঁর বয়স হয়েছিল ৫১ বৎসর ৫ মাস ১৫ দিন। সন ছিল নবুয়তের দ্বাদশ সাল। তিনটি পর্যায়ে মি’রাজকে ভাগ করা হয়েছে। মক্কা শরীফ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাছ পর্যন্ত মি’রাজের অংশকে বলা হয় ইসরা বা রাত্রি ভ্রমণ। বায়তুল মোকাদ্দাছ থেকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত অংশকে বলা হয় মি’রাজ।

সিদরাতুল মুনতাহা থেকে আরশ ও লা-মকান পর্যন্ত অংশকে বলা হয় ই’রাজ। কিন্তু সাধারণভাবে পূর্ণ ভ্রমণকেই এক নামে মি’রাজ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কোরআন, হাদীসে-মোতাওয়াতি এবং খবরে ওয়াহেদ দ্বারা যথাক্রমে এই তিনটি পর্যায়ের মি’রাজ প্রমাণিত।
Sitapur Sufia DarBar Sharif

মি’রাজের প্রথম পর্যায়ঃ
রজব চাঁদের ২৭ তারিখ সোমবার পূর্ব রাত্রের শেষাংশে নবী করিম [ﷺ] বায়তুল্লায় অবস্থিত বিবি উম্মেহানী (رضي الله عنها)-এঁর ঘরে অবস্থান করছিলেন। বিবি উম্মেহানী (رضي الله عنها) ছিলেন আবু তালেবের কন্যা এবং নবী করিম [ﷺ]-এঁর দুধবোন। উক্ত গৃহটি ছিল বর্তমান হেরেম শরীফের ভিতরে পশ্চিম দিকে। হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) ঘরের ছাদ দিয়ে প্রবেশ করে নূরের পাখা দিয়ে, অন্য রেওয়ায়াত মোতাবেক-গন্ডদেশ দিয়ে নবী করিম [ﷺ]-এঁর কদম মোবারকের তালুতে স্পর্শ করতেই হুযুরের তন্দ্রা টুটে যায়। জিব্রাইল (عليه السلام) আল্লাহর পক্ষ হতে দাওয়াত জানালেন এবং নবীজীকে যমযমের কাছে নিয়ে গেলেন। সিনা মোবারক বিদীর্ণ করে যমযমের পানি দিয়ে ধৌত করে নূর এবং হেকমত দিয়ে পরিপূর্ণ করলেন। এভাবে মহাশূন্যে ভ্রমণের প্রস্তুতিপর্ব শেষ করলেন।

নিকটেই বোরাক দন্ডায়মান ছিল। বোরাকের আকৃতি ছিল অদ্ভুত ধরণের। গাধার চেয়ে উঁচু, খচ্চরের চেয়ে নীচু, মুখমন্ডল মানুষের চেহারাসদৃশ, পা উটের পায়ের মত এবং পিঠের কেশর ঘোড়ার মত (রুহুল বয়ান-সুরা ইসরাইল)। মূলতঃ বোরাক ছিল বেহেস্তী বাহন- যার গতি ছিল দৃষ্টি সীমাস্তে মাত্র এক কদম। নবী করিম [ﷺ] বোরাকে সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করতেই বোরাক নড়াচড়া শুরু করলো। জিব্রাইল (عليه السلام) বললেন- “তোমার পিঠে সৃষ্টির সেরা মহামানব সওয়ার হচ্ছেন- সুতরাং তুমি স্থির হয়ে যাও।” বোরাক বললো, ”কাল হাশরের দিনে নবী করিম [ﷺ] আমার জন্য আল্লাহর দরবারে শাফাআত করবেন বলে ওয়াদা করলে আমি স্থির হবো।” নবী করিম [ﷺ] ওয়াদা করলেন। বোরাক স্থির হলো। তিনি বোরাকে সওয়ার হলেন। জিব্রাইল (عليه السلام) সামনে লাগাম ধরে, মিকাইল (عليه السلام) রিকাব ধরে এবং ইস্রাফিল (عليه السلام) পিছনে পিছনে অগ্রসর হলেন। পিছনে সত্তর হাজার ফেরেশতার মিছিল। এ যেন দুল্হার সাথে বরযাত্রী। প্রকৃতপক্ষে নবী করিম [ﷺ] ছিলেন আরশের দুল্হা (তাফসীরে রুহুল বয়ান)।

মক্কা শরীফ থেকে রওনা দিয়ে পথিমধ্যে মদিনার রওযা মোবারকের স্থানে গিয়ে বোরাক থামলো। জিব্রাইলের ইশারায় তথায় তিনি দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। এভাবে ঈছা আলাইহিস সালামের জন্মস্থান বাইতুল লাহাম এবং মাদ্ইয়ান নামক স্থানে হযরত শুয়াইব (عليه السلام)-এঁর গৃহের কাছে বোরাক থেকে নেমে নবী করিম [ﷺ] দু’রাকাত করে নামায আদায় করলেন। এজন্যই বরকতময় স্থানে নামায আদায় করা ছুন্নত। এই শিক্ষাই এখানে রয়েছে। নবী করিম [ﷺ]-এঁরশাদ করেন, আমি বোরাক থেকে দেখতে পেলাম- হযরত মুছা (عليه السلام) তাঁর মাযারে (জর্দানে) দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছেন।

অতঃপর জিব্রাইল (عليه السلام) বায়তুল মোকাদ্দাছ মসজিদের সামনে বোরাক থামালেন। সমস্ত নবীগণ পূর্ব হতেই সেখানে স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন। জিব্রাইল (عليه السلام) বোরাককে রশি দিয়ে বায়তুল মোকাদ্দাছের ছাখরা নামক পবিত্র পাথরের সাথে বাঁধলেন এবং আযান দিলেন। সমস্ত নবীগণ (عليهم السلام) নামাযের জন্য দাঁড়ালেন। হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) নবী করিম [ﷺ]-কে মোসল্লাতে দাঁড় করিয়ে ইমামতি করার জন্য অনুরোধ করলেন। হুযুর [ﷺ] সমস্ত আম্বিয়ায়ে কেরাম ও সত্তর হাজার ফেরেশতাকে নিয়ে দু’রাকাত নামায আদায় করলেন।

তখনও কিন্তু নামায ফরয হয়নি। প্রশ্নজাগে নামাযের আদেশ নাযিল হওয়ার পূর্বে হুযুর [ﷺ] কিভাবে ইমামতি করলেন? বুঝা গেল, তিনি নামাযের নিয়ম কানুন পূর্বেই জানতেন। নামাযের তা’লীম তিনি পূর্বেই পেয়েছিলেন – তানযীল বা নাযিল হয়েছে পরে। আজকে প্রমাণিত হলো- নবী করিম [ﷺ] হলেন ইমামুল মোরছালীন ও নবীউল আম্বিয়া (عليهم السلام)। নামায শেষে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত সভায় নবীগণ নিজেদের পরিচয় দিয়ে বক্তব্য পেশ করলেন। সর্বশেষ সভাপতি (মীর মজলিশ) হিসাবে ভাষণ রাখলেন নবী করিম [ﷺ]। তাঁর ভাষণে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করে তিনি বললেন- “আল্লাহ পাক আমাকে আদম সন্তানগণের মধ্যে সর্দার, আখেরী নবী ও রাহমাতুল্লিল ’’আলামীন বানিয়ে প্রেরণ করেছেন।”

এখানে একটি আক্বিদার প্রশ্ন জড়িত আছে। তা হলো- আম্বিয়ায়ে কেরামগণের মধ্যে চারজন ব্যতিত আর সকলেই ইতিপূর্বে ইনতিকাল করেছেন এবং তাঁদের রওযা মোবারকও বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত। যে চারজন নবী জীবিত, তাঁরা হচ্ছেন- হযরত ইদ্রিছ (عليه السلام) বেহেশতে, হযরত ইছা (عليه السلام) আকাশে, হযরত খিযির (عليه السلام) জলভাগের দায়িত্বে এবং হযরত ইলিয়াছ (عليه السلام) স্থলভাগের দায়িত্বে। জীবিত ও ইনতিকালপ্রাপ্ত সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম (عليهم السلام) বিভিন্ন স্থান থেকে মূহুর্তের মধ্যে কিভাবে স্বশরীরে বায়তুল মোকাদ্দাছে উপস্থিত হলেন?

তাফসীরে রুহুল বয়ানে এ প্রশ্নের উত্তর এভাবে দেয়া হয়েছে- “জীবিত চারজন নবীকে আল্লাহ তায়ালা স্বশরীরে এবং ইন্তিকাল প্রাপ্ত আম্বিয়ায়ে কেরামগণকে মেছালী শরীরে বায়তুল মোকাদ্দাছে উপস্থিত করেছিলেন।” কিন্তু অন্যান্য গ্রন্থে স্বশরীরে উপস্থিতির কথা উল্লেখ আছে। কেননা, নবীগণ অষ্ট অঙ্গ দ্বারা সিজদা করেছিলেন। নবীগণ ও অলীগণ মেছালী শরীর ধারণ করে মূহুর্তের মধ্যে আসমান জমিন ভ্রমণ করতে পারেন এবং জীবিত লোকদের মতই সব কিছু শুনতে ও দেখতে পারেন (মিরকাত ও তাইছির গ্রন্থ)। আধুনিক থিউসোফীতেও (আধ্যাত্মবাদ) একথা স্বীকৃত। ফিজিক্যাল বডি, ইথিক্যাল বডি, কস্যাল বডি, এস্ট্রাল বডি- ইত্যাদি রূপ ধারণ করা একই দেহের পক্ষে সম্ভব এবং বাস্তব বলেও আধুনিক থিউসোফীর বিজ্ঞানীগণ স্বীকার করেছেন। আমরা মুসলমান। আল্লাহর কুদরত ও প্রদত্ত ক্ষমতার উপর আমাদের ঈমান নির্ভরশীল। এ বিষয়ে কবি গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী বইখানায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

মি’রাজের দ্বিতীয় পর্যায়
মি’রাজের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় বায়তুল মোকাদ্দাছ থেকে এবং শেষ হয় সিদরাতুল মুনতাহাতে গিয়ে। প্রথম আকাশে গিয়ে জিব্রাইল (عليه السلام) ডাক দিলেন প্রথম আকাশের ভারপ্রাপ্ত ফেরেশতাকে এবং দরজা খুলে দিতে বললেন। উক্ত ফেরেশতা পরিচয় নিয়ে হুযুর [ﷺ]-এঁর নাম শুনেই দরজা খুলে দিলেন। প্রথমেই সাক্ষাত হলো হযরত আদম (عليه السلام)-এঁর সাথে। হুযুর [ﷺ] তাঁকে ছালাম দিলেন। কেননা ভ্রমণকারীকেই প্রথমে সালাম দিতে হয়। হযরত আদম (عليه السلام) নবীগণের আদি পিতা। তাই তাঁকে দিয়েই প্রথম অভ্যর্থনা শুরু করা হলো। হযরত আদম (عليه السلام)-এঁর নেতৃত্বে অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কেরাম এবং প্রথম আকাশের ফেরেশতারা উক্ত অভ্যর্থনায় যোগদান করেন। এমনিভাবে দ্বিতীয় আকাশে হযরত ঈছা, হযরত যাকারিয়া ও হযরত ইয়াহ্ইয়া (عليهم السلام) এবং অন্যান্য নবী ও ফেরেশতারা অভ্যর্থনা জানালেন।

হযরত যাকারিয়া (عليهم السلام) ও উক্ত অভ্যর্থনায় শরীক ছিলেন। নবী করিম [ﷺ] তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন- “যখন আপনাকে করাত দ্বারা দ্বিখন্ডিত করা হচ্ছিল- তখন আপনার কেমন অনুভব হয়েছিল? উত্তরে যাকারিয়া (عليه السلام) বললেন- তখন আল্লাহ তায়ালা আমাকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন- “আমি তোমার সাথে আছি।” এতদশ্রবণে আমি মউতের কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম।” প্রকৃত আশেকগণের মউতের সময় নবীজীর দিদার নছিব হয়। তাই তাঁদের মউতের কষ্ট অনুভূত হয় না (আল বেদায়া ওয়ান নেহায়াঃ যাকারিয়া অধ্যায়)।

তৃতীয় আকাশে হযরত ইউসুফ (عليه السلام)-এঁর নেতৃত্বে অন্যান্য নবী ও ফেরেশতাগণ নবী করিম [ﷺ]-কে অভ্যর্থনা জানান এবং ছালাম কালাম বিনিময় করেন। চতুর্থ আকাশে হযরত ইদ্রিছ (عليه السلام), পঞ্চম আকাশে হযরত হারুন (عليه السلام) ফেরেশতাগণসহ অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। ৬ষ্ঠ আকাশে হযরত মুছা (عليه السلام)-এঁর সাথে সাক্ষাত হয়। তিনি অভ্যর্থনা জানিয়ে বিদায়কালে আশ্চর্য হয়ে বললেন- “এই যুবক নবী শেষকালে এসেও আমার পূর্বে বেহেস্তে যাবেন এবং তাঁর উম্মতগণ আমার উম্মতের পূর্বে বেহেস্তে প্রবেশ করবে।” হযরত মুছা (عليه السلام) নবী করিম [ﷺ] ও তাঁর উম্মতের বিশেষ মর্যাদা দেখে আনন্দাশ্রর কান্না কেঁদেছিলেন। যেমন মা সন্তানের কোন সুসংবাদ শুনতে পেলে আনন্দে কেঁদে ফেলেন। তাঁর এই আফ্সোস ছিল আনন্দসূচক ও স্বীকৃতিমূলক- বিদ্বেষমূলক নয়, এটাকে ইর্ষা বলে। ইর্ষা শরিয়তে জায়েয- কিন্তু হাছাদ বা হিংসা করা জায়েয নয়।

হযরত মুছা (عليه السلام) সে সময় নবী করিম [ﷺ]-এঁর নিকট একটি হাদীসের ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলেন। হাদীসটি হলো- নবী করিম [ﷺ]-এঁরশাদ করেছেনঃ
علماء امتي كانبياء بني اسراءيل
অর্থাৎ “আমার উম্মতের যাহেরী-বাতেনী এলেম সম্পন্ন আলেমগণ বনী ইসরাইলের নবীগণের ন্যায় (এলেমের ক্ষেত্রে)। নবী করিম [ﷺ] উক্ত হাদীসের যথার্থতা প্রমানের জন্য রুহানী জগত থেকে ইমাম গাযালী (رحمه الله عليه) কে হযরত মুছা (عليه السلام)-এঁর সামনে হাযির করালেন। হযরত মুছা (عليه السلام) বললেন- “আপনার নাম কি? উত্তরে ইমাম গাযালী (رحمه الله عليه) নিজের নাম, পিতার নাম, দাদার নাম, পরদাদার নাম সহ ছয় পুরুষের নাম বললেন। হযরত মুছা (عليه السلام) বললেন, আমি শুধু আপনার নাম জিজ্ঞেস করেছি। আপনি এত দীর্ঘ তালিকা পেশ করলেন কেন? ইমাম গাযালী (رحمه الله عليه) আদবের সাথে জবাব দিলেন- “আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে আপনিও তো আল্লাহ তায়ালার ছোট্ট একটি প্রশ্নের দীর্ঘ উত্তর দিয়েছিলেন।” ইমাম গাযালীর (رحمه الله عليه) এলেম ও প্রজ্ঞা দেখে হযরত মুছা (عليه السلام) মুগ্ধ হয়ে গেলেন এবং হুযুর [ﷺ]-এঁর হাদীসখানার তাৎপর্য্য স্বীকার করে নিলেন। (রুহুল বয়ান তৃতীয় পারা ২৪৮ পৃষ্ঠা)।

[এখানে একটি বিষয় তাৎপর্য্যপূর্ণ। হযরত মুছা (عليه السلام)-এঁর ইন্তিকালের আড়াই হাজার বৎসর পরে মক্কার জমিনে প্রদত্ত হুযুর [ﷺ]-এঁর ভাষণ তিনি শুনতে পেয়েছিলেন-আপন রওযা থেকে। অপরদিকে দুনিয়াতে আসার পূর্বে আলমে আরওয়াহ্ থেকে ইমাম গাযালী (رحمه الله عليه)-এঁর মত একজন বিজ্ঞ অলী আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে তুর পর্বতে ঘটে যাওয়া মুছা (عليه السلام)-এঁর ঘটনা সম্পর্কেও অবগত ছিলেন। এতে প্রমাণিত হলো- আল্লাহর নবী ও অলীগণকে আল্লাহ তায়ালা বাতেনী প্রজ্ঞা দান করেন- যাকে নূরে নযর বা ফিরাছাত বলা হয়। আল্লাহর অলীগণ আল্লাহ প্রদত্ত কাশ্ফ দ্বারা অনেক সময় মানুষের মনের গোপন কথাও বলে দিতে পারেন। ইমাম আবু হানিফা (رحمه الله عليه) কুফার এক মসজিদে জনৈক মুছল্লিকে অযু করতে দেখে বলেছিলেন,
“তুমি যিনা করে এসেছো। লোকটি অবাক হয়ে বললো, আপনি কিভাবে জানলেন? ইমাম আবু হানিফা (رحمة الله عليه) বললেন- তোমার অযুর পানির সাথে যিনার গুনাহ্ ঝরে পড়ছিল।”

হাদীসেও অযুর পানির সাথে গুনাহ্ ঝরে পড়ার কথা উল্লেখ আছে। লোকটি ইমাম সাহেবের বাতেনী এলেম দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো এবং সাথে সাথে ইমাম সাহেবের হাতে তওবা করলো। বড়পীর হযরত গাউছুল আ’যম আবদুল কাদের জিলানী (رحمة الله عليه) বাহ্জাতুল আসরার কিতাবে বলেনঃ

ان السعداء والاشقياء ليعرضون على عينى فى اللوح المحفوظ –
অর্থাৎ “দুনিয়ার নেককার ও বদকার- সকলকেই আমার দৃষ্টিতে পেশ করা হয় লওহে মাহ্ফুযে।” লওহে মাহ্ফুযে নেককার-বদকার সকলের তালিকা রয়েছে। হযরত বড়পীর (رحمه الله عليه)-এঁর নযরও দুনিয়া থেকে লওহে মাহ্ফুযে নিবদ্ধ। এজন্যই মাওলানা জালালুদ্দিন রুমী (رحمه الله عليه) মসনবী শরীফে বলেছেনঃ

لوح محفوظ است پیش اولیا -آنچه محفوظ است محفوظ از خطا –
অর্থাৎ “লওহে মাহফুয অলী-আল্লাহগণের নযরের সামনে। একারণেই তাঁদের দিব্যদৃষ্টি সমস্ত ক্রটি থেকে মুক্ত।”]

হযরত মুছা (عليه السلام) থেকে বিদায় নিয়ে নবী করিম [ﷺ] জিব্রাইল (عليه السلام) সহ সপ্তম আকাশে গেলেন। সেখানে হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) ফেরেশতাগণসহ নবী করিম [ﷺ]-কে অভ্যর্থনা জানালেন। নবী করিম [ﷺ] ইরশাদ করেন- “আমি হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) কে একটি কুরছিতে বসে বাইতুল মামুর মসজিদের গায়ে হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় দেখতে পেয়েছি” (রুহুল বয়ান)।

হযরত ইব্রাহীম (عليه السلام) দুনিয়াতে আল্লাহর ঘর কা’বা শরীফ তৈরী করেছিলেন। তার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সপ্তাকাশের বাইতুল মামুর মসজিদের মোতাওয়াল্লীর সম্মান দান করেছেন। দীর্ঘ এক হাদীসে এসেছে- বাইতুল মামুরে হুযুর [ﷺ]-এঁর সাথে নামায আদায় করেছিলেন সাদা পোষাকধারী একদল উম্মত- যাদের মধ্যে গাউসুল আযমও ছিলেন। (আ’লা হযরতের ইরফানে শরিয়ত তৃতীয় খন্ড)।

আসমানে ভ্রমণের সময়ই নবী করিম [ﷺ] বেহেস্ত ও দোযখ প্রত্যক্ষ করেন। পরকালে বিভিন্ন পাপের কি রকম শাস্তি হবে, তার কিছু নমুনা তিনি মেছালী ছুরতে প্রত্যক্ষ করেছেন। সুদ, ঘুষ, অত্যাচার, নামায বর্জন, ইয়াতিমের মাল ভক্ষণ, প্রতিবেশীর উপর যুলুম, স্বামীর অবাধ্যতা, বেপর্দা ও অন্য পুরুষকে নিজের রূপ প্রদর্শন, যিনা, ব্যাভিচার ইত্যাদির শাস্তি নবী করিম [ﷺ] স্বচক্ষে দেখেছেন।

বেহেস্তে হযরত খদিজা (رضي الله عنها)-এঁর জন্য সংরক্ষিত প্রাসাদ, হযরত ওমরের (رضي الله عنه) প্রাসাদ, হযরত বেলালের (رضي الله عنه) পাদুকার আওয়ায- এসব দেখেছেন এবং শুনেছেন। বেহেস্তের চারটি নহরের উৎসস্থল নবী করিম [ﷺ]-কে দেখান হয়েছে। বিছ্মিল্লাহর চারটি শব্দের শেষ চারটি হরফ থেকে (م-ه-ن-م) চারটি নহর প্রবাহিত হয়ে হাউযে কাউছারে পতিত হতে দেখেছেন। দুধ, পানি, শরবত ও মধু এই চার প্রকারের পানীয় বেহেস্তবাসীকে পান করানো হবে। যারা ভক্তি ও ঈমানের সাথে প্রত্যেক ভাল কাজ ”বিছ্মিল্লাহ” বলে শুরু করবে, তাদের জন্য এই নেয়ামত রাখা হয়েছে। (তাফসীরে রুহুল বয়ানে বিছমিল্লাহর ব্যাখ্যায় এর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়েছে)।

সপ্ত আকাশ ভ্রমণের পর জিব্রাইল (عليه السلام) খাদেম বা প্রটোকল হিসাবে নবী করিম [ﷺ]-কে সিদরাতুল মুনতাহা বা সীমান্তের কুলবৃক্ষের নিকট নিয়ে যান। হাদীসে এসেছে- “এ বৃক্ষের পাতা হাতীর কানের মত এবং ফল ওহোদ পাহাড়ের ন্যায় বিশাল। শহীদগণের রূহ মোবারক সবুজ পাখীর ছুরতে উক্ত বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করছেন। নবী করিম [ﷺ] স্বচক্ষে তা দর্শন করেছেন। সিদরা বৃক্ষ পৃথিবীর সপ্ত তবক নীচ থেকে চৌদ্দ হাজার বছরের রাস্তার উপরে অবস্থিত। সিদরা থেকে আরশের দূরত্ব ছত্রিশ হাজার বৎসরের রাস্তা। সর্বমোট পঞ্চাশ হাজার বৎসরের দূরত্বে আরশে মোয়াল্লা। (ইবনে আব্বাস)। আরশে মোয়াল্লা থেকেই আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় নির্দেশ ফেরেশতাগণের নিকট আসে। হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) সিদরাতুল মুনতাহা থেকেই আল্লাহ তায়ালার যাবতীয় নির্দেশ গ্রহণ করে থাকেন। এখানে এসেই জিবরাঈলের গতি শেষ হয়ে যায়।

মি’রাজের তৃতীয় পর্যায়ঃ সিদরা হতে আরশে আযীম পর্যন্ত
সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছে জিব্রাইল (عليه السلام) নবী করিম [ﷺ] থেকে বিদায় নিলেন এবং বললেনঃ
لو دنوت منها أنملة لا حرقت وفى رواية شعرة –
অর্থাৎ “সিদরাতুল মুনতাহা থেকে এক আঙ্গুল – অন্য রেওয়ায়তে চুল পরিমাণ অগ্রসর হলে আমার ছয়শত নূরের পাখা আল্লাহ্‌ পাকের নূরের তাজাল্লীতে জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।” সোব্হানাল্লাহ!

যেখানে নূরের ফেরেশতা জিব্রাইল (عليه السلام) জ্বলে যায়, সেখানে আমাদের প্রিয় নবী [ﷺ] স্বশরীরে স্বচ্ছন্দে সামনে অগ্রসরমান। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্রন্থের প্রারম্ভে হযরত জাবের (رضي الله عنه) কর্তৃক বর্ণিত নূরে মোহাম্মদী সৃষ্টির হাদীসখানা আর একবার পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি- “তিনি আল্লাহর যাতী নূরের জ্যোতি হতে পয়দা হয়েছেন।” বুঝা গেল- তিনি মাটি নন। মাটি হলে তথায় জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যেতেন। জিব্রাইল (عليه السلام) আমাদের নবীজীর [ﷺ] নূরের সামান্যতম অংশের তাজাল্লী দিয়ে সৃষ্ট। যেখানে জিব্রাইলের গতি শেষ, সেখান থেকে আমাদের নবীজীর [ﷺ] যাত্রা শুরু। হাকিকতে মোহাম্মদী [ﷺ] সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হলে হযরত জিব্রাইল (عليه السلام) কে জিজ্ঞাসা করতে হবে- সিদরাতুল মুনতাহার পরে জিব্রাইল (عليه السلام) নবীজীকে কেমন দেখেছিলেন। জিব্রাইলও বলতে পারবেনা – তার পরের ঘটনা কি ঘটেছিল। ফিরতি পথে হুযুর [ﷺ]-এঁর স্বরূপ কেমন ছিল – তা জানতে হবে মুছা (عليه السلام)-এঁর কাছে। সেদিন তিনি প্রকৃতপক্ষে কাকে দেখেছিলেন?

বিদায়ের সময় জিব্রাইল (عليه السلام) নবী করিম [ﷺ]-এঁর কাছে একটি আরয পেশ করেছিলেন- “আল্লাহ যেন হাশরের দিনে জিব্রাইলকে পুলছিরাতের উপর তার ছয়শত নূরের পাখা বিছিয়ে দেয়ার অনুমতি দান করেন।” উম্মতে মোহাম্মদী যেন উক্ত পাখার উপর দিয়ে পুলসিরাত পার হয়ে যেতে পারে। নবী করিম [ﷺ] আল্লাহর দরবারে জিব্রাইলের এই ফরিয়াদ পেশ করলে আল্লাহ তায়ালা ছাহাবায়ে কেরাম ও আহলে মহব্বতের লোকদের জন্য তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। আল্লাহ্ পাক বলেছিলেন, هذا لمن صحبك وأهل محبتك (মাওয়াহেব লাদুন্নিয়া)। অর্থাৎ “জিব্রাইলের পাখার ওপর দিয়ে পুলছিরাত অতিক্রম করার আরজি মঞ্জুর করা হলো-আপনার সাহাবী এবং আশেকানদের জন্য।” এই দুই শ্রেণীর লোক জিব্রাইলের পাখার উপর দিয়ে পুলছিরাত পার হয়ে যাবে।

জিব্রাইল (عليه السلام) থেকে বিদায় হওয়ার পর রফরফ নামে এক বাহন এসে নবী করিম [ﷺ]-কে আরশে আযিমে পৌঁছিয়ে দেয়। এ পথে নবী করিম [ﷺ] সত্তরটি নূরের পর্দা ভেদ করেন। এক এক পর্দার ঘনত্ব ছিল পাঁচশত বৎসরের রাস্তা। এ হিসাবে ৩৬ হাজার বৎসরের রাস্তা অতিক্রম করে নবী করিম [ﷺ] আরশে মোয়াল্লায় পৌঁছলেন। এ পথে যখন তিনি একাকীত্ব অনুভব করছিলেন, তখন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (رضي الله عنه)-এঁর আওয়ায শুনতে পেয়ে শান্ত হয়েছিলেন। আর একটি আওয়াজও তিনি শুনতে পেয়েছিলেনঃ
قف يا محمد فان ربك يصلى
অর্থাৎঃ “হে প্রিয় মোহাম্মদ [ﷺ], আপনি একটু থামুন, আপনার রব সালাত পাঠ করছেন।” আল্লাহর সাথে দীদারের সময় নবী করিম [ﷺ] এ দু’টি বিষয়ের রহস্য জানতে চাইলেন। আল্লাহ তায়ালা বললেন, আমার সালাত অর্থ আপনার উপর দরূদ পাঠ করা। আর আবু বকরের সুরতে এক ফেরেশতা সৃষ্টি করে আবু বকরের আওয়াজ নকল করা হয়েছিল- যেন আপনি শান্ত হন। মহিউদ্দিন ইবনে আরবী (رحمه الله عليه)-এঁর তাফসীরে বলা হয়েছে- হযরত আবু বকর সিদ্দিকই (رضي الله عنه) রুহানীভাবে ফেরেশতার সূরতে তথায় উপস্থিত ছিলেন। এটা ছিল তাঁর কারামত। কেননা, তিনি ছিলেন রাসুলে পাকের নিত্য সঙ্গী। তিনি দুনিয়াতে, মাযারে, হাশরের ময়দানে এবং জান্নাতেও নবী করিম [ﷺ]-এঁর সঙ্গী থাকবেন। সুতরাং মি’রাজে রূহানীভাবে উপস্থিত থাকা খুবই স্বাভাবিক (দেখুন ইরফানে শরিয়ত)। আরশে পৌঁছার পর লাওহে মাহফুয অবলোকনকালে নবী করিম [ﷺ] দেখতে পেলেন, তথায় শেষ বাক্যটি লেখা ছিল এরূপঃ
قد سبقت رحمتى على غضبى
অর্থাৎঃ “আমার গযবের উপর আমার রহমত প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে।” উক্ত হাদীসে কুদসীর মধ্যে উম্মতের জন্য একটি গোপন ইশারা নিহিত রয়েছে। তা হলো- কিছু শাস্তি ভোগ করার পর সমস্ত হকপন্থী উম্মতই আল্লাহর রহমতে নাজাত পাবে।

নবী করিম [ﷺ] আরশকে জিজ্ঞেস করলেন- আমি সমগ্র জাহানের জন্য রহমত- তোমার জন্য কিরূপে রহমত? আরশ তখন আরয করলো- আল্লাহ তায়ালা যখন আমার মধ্যে কলেমার প্রথম অংশ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ লিখলেন, যখন আল্লাহর জালালী শানে আমার মধ্যে কম্পন সৃষ্টি হয়েছিল। মনে হয়েছিল- যেন আমি টুকরো হয়ে যাব। তারপর যখন তার পার্শ্বে আপনার জামালী নামের অংশটুকু- ‘মোহাম্মদ রাসুলুল্লাহ’ লিখে দিলেন- তখন আমার কম্পন বন্ধ হয়ে গেল (শানে হাবীব)! সুতরাং আপনি আমার জন্য বিরাট রহমত।

লা মাকানের উদ্দেদ্দ্যে রওনা
আরশ মোয়াল্লা হতে এবার লা-মাকানের দিকে- অজানা পথে রওনা দিলেন নবী করীম [ﷺ]-যেখানে স্থান-কাল বলতে কিছুই নেই। সমগ্র সৃষ্টি জগতই তখন নবীজির কদমের নীচে। আসমান, জমিন, চন্দ্র-সূর্য্য আরশ কুর্ছি- সবকিছু, এমন কি-আলমে খালক (সৃষ্টি জগত) ও আলেমে আমর (নির্দেশ জগত) সবকিছু নবী করীম [ﷺ]- এর পদতলে রয়ে গেল। তিনি সমস্থ কিছু অতিক্রম করে আল্লাহর এত নিকটবর্তী হলেন যে, দুই ধনুকের চার মাথার ব্যবধান বা তার চেয়েওে কম ব্যবধান রয়ে গেল। এটা রহস্য জগত। এ অবস্থাকে মুতাশাবিহাত বা দুর্বোধ্য অবস্থা বলা হয়। কোরআন মজিদে এই মাকামকে قاب قوسين বলা হয়েছে।

 (সংগৃহীত)

Comments

comments