ইসলাম প্রচারে হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহঃ) এর অবদান
মহান রাব্বুল আলামিন যুগে যুগে মানুষের পথ প্রদর্শন ও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের নিমিত্তে অসংখ্য নবী ও রাসুল পৃথিবীর বুকে প্রেরণ করেছেন। মানব সমাজ ভুল ভ্রান্তির দিকে ধাবিত হওয়ার ফলে সারা জগত যখন অন্ধকার হয়ে যায়, তখন খলকে খোদার পথপ্রদর্শক ও ত্রাণকর্তা হিসাবে নবী ও রাসুলের আবির্ভাব হয়। এইভাবেহযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম পর্যন্ত একজনের পর একজন নবী ও রাসুলের আগমনের হক সিলসিলা জারি থাকে। নবী- রাসুলগণের ধারবাহিকতা সমাপ্ত হবার পর আরম্ভ হয় বেলায়তের সিলসিলা। ঠিক তেমনিভাবে পাক-বঙ্গ-ভারত তথা উপমহাদেশে হেদায়তের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন খোরাসানের অন্তর্গত সঞ্জর এর আবির্ভাবvনামক গ্রামে আতায়ে রাসুল হিন্দল অলী হযরত খাজা গরীব এ-নেওয়াজ ঘটিয়েছেন। পাক ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারে যার অবদান ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণারে লিপিবদ্ধ রয়েছে তিনি হলেন সুলতানুল হিন্দ আতায়ে রাসুল গরীবে ।vনেওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
জন্ম ও বংশধারা
১১৩৮ ইংরেজিতে (৫৩৭ হিজরী) মধ্য এশিয়ায় খোরাসানেরvখাজা মঈনুদ্দীন চিশতী অন্তর্গত সিস্তান রাজ্যের সানজার নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ খাজা গিয়াস উদ্দীন, মাতার নাম সৈয়দা উম্মুল ওয়ারা মাহেনুর। পিতার দিকে তিনি শেরে খোদা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর চতুর্দশতম এবং মাতার দিকে তিনি খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা জোহরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার দ্বাদশতম বংশধর। মাতৃকুল হযরত হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও পিতৃকুল হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু পর্যন্ত যাওয়ায় তিনি বংশে হাসানী-হোসাইনী আওলাদে রাসুলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অশেষ সৌভাগ্যের অধিকারী। তদুপরি তিনি উভয়দিকে এর বংশধর। পিতৃকূল ও মাতৃকূল উভয়vঅলিকুল সম্রাট গাউছুল আজম হযরত বড়পীর দিক থেকে। বস্তুত এসব কারণেই তিনি আল্লাহ প্রদত্ত অলৌকিক শক্তি বলে কামালিয়াতের উচ্চতম শিখরে আরোহণ করেছিলেন। পরে সপরিবারে খোরাসান শহরে (বর্তমান আফগানিস্তান) হিজরত করেন। মাত্র ১৫ বৎসর বয়সে বাবা মা উভয়কেই হারান।
শিা অর্জন: হুজুর গরীবে নেওয়াজ পিতার সান্নিধ্যে প্রাথমিক দ্বীনি শিা অর্জন করেন। ৯ বছর বয়সে তরজমাসহ পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্থ করেন। অতঃপর ১৩ বছর পর্যন্ত পিতার সার্বিক তত্ত্বাবধানে কুরআন, হাদিস, ফিকহ্, উসুল, তাফসীর, আরবী সাহিত্য- ব্যাকরণ, মানতিক, হিকমত দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে গভীর ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি প্রখ্যাত হাদিসবেত্তা ইমামুল হারামাইন হযরত আবুল এর নিকট শরীয়তের বিভিন্ন সূাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে পান্ডিত্য লাভ করেন।vমা’আলী সমরকন্দের প্রখ্যাত আলেম হযরত শরফুদ্দীন ও বোখারার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত হুসামুদ্দীন (রহঃ) এর নিকট দীর্ঘ পাঁচ বছর অধ্যয়ন করে আনুষ্ঠানিক শিারকৃতিত্বপূর্ণ পূর্ণতা অর্জন করেন।
ইলমে মা’রেফত বা দিব্যজ্ঞান ও বাইয়াত গ্রহণ
পিতার ওয়ারিশ সূত্রে তিনি একটি ফলের বাগানপ্রাপ্ত হন। বাগানের পরিচর্যা ও দেখাশোনা করে এর উৎপাদনে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। একদিন ওই বাগানের নামে এক মাযযুব কলন্দর অলিআল্লাহvপরিচর্যাকালে হযরত ইব্রাহীম কান্দুজী সেখানে উপস্থিত হন। খাজা বাবা দরবেশকে তাজিমের সঙ্গে বসিয়ে তৃপ্তি সহকারে বাগানের ফল খেতে দেন। দরবেশ খুশি হয়ে নিজ ঝুলি থেকে এক টুকরো রুটি বের করে নিজ মুখে চিবিয়ে কিছুটা খাজা মঈনুদ্দীনকে খেতে বললেন। খাজা বাবাও পরম আদব ও ভক্তির সঙ্গে সাগ্রহে তা খেয়ে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনের রাজ্য খোদায়ী নূরে আলোকিত হল। আল্লাহ প্রেমের প্রবল তরঙ্গে তার সব অজুদ প্লাবিত হল।
এরপর আধ্যাত্মিকতার অদম্য আকর্ষণে তিনি বাগান বিক্রি করে তা আল্লাহর নামে দান করে সামান্য রাহ খরচ নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। অভাবনীয় ও অবর্ণনীয় রুহানি আকর্ষণ নিয়ে তিনি আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্বেষায় নিমগ্ন হলেন। আল্লাহর ভাবে ব্যাকুল হয়ে তিনি দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। বুখারা, ইরাক, নিশাপুর প্রভৃতি জায়গায় যেখানে অলি বুযুর্গ, দরবেশের সন্ধান পান, সেখানেই অবস্থান নিয়ে ইলমে মা’রেফত অর্জনে আল্লাহর সন্ধানে সফর অব্যাহত রাখেন।
বোখারা থেকে নিশাপুরে আসেন। নিশাপুর এসেvএভাবে হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী এখানকার ‘হারূন’ নামক একটি ছোট শহরে সেখানে যুগশ্রেষ্ঠ ওলী হযরত ওসমান এর শিষ্য ও প্রধানv’র সন্ধান পান, যিনি হাজী শরীফ জিন্দানী vহারুনী খলীফা। তিনি ছিলেন তৎকালীন ইলমে মা’রেফতের রহস্যজ্ঞানী মহান আধ্যাত্মিক এ মহাপুরুষের দরবারে উপস্থিত হন। আর একান্ত আগ্রহেvতাপস। খাজা গরীব নওয়ায তাঁর নিকট দীা গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। গরীব নওয়াযের চেহারায় দৃষ্টি করতেই তিনি বুঝেছিলেন, এ যুবক কালে একজন অসাধারণ কামিল দরবেশ হয়ে উঠবেন। তাই তিনি পরম আগ্রহে তাঁকে শিষ্যত্বে কবুল করে নিলেন। ওলীয়ে কামেল খাজা তার শিষ্যের মধ্যে বেলায়েতের ঝলক দেখতে পেয়ে খাজা মঈনুদ্দীনvওসমান হারুনী কে খিলাফত প্রদান করেন। তখন থেকেই তাঁর আধ্যাত্মিক সাধনার শুরুvচিশতী হয়। তাঁর জীবনী গ্রন্থে জানা যায়, প্রায় বিশ বছর তিনি পীরের খেদমত করে তাঁর সোহবতে থেকে নিজের আধ্যাত্মিকতার উৎকর্ষ সাধন করেন।
খাজায়ে খাজেগান আপন পীর মুর্শিদের অনুমতিক্রমে জ্ঞানী, গুণী, পন্ডিত, দার্শনিকসহ অসংখ্য ওলীর সাথে সাাৎ করেন। খাজা বাবা বাগদাদ শরীফে গাউছুল আজম এর সাহচর্যে ৫৭ দিন অবস্থান করেন। এ সময়vবড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী গাউসে পাক খাজা বাবাকে উদ্দেশ্যে করে বলছিলেন, ইরাকের দায়িত্ব শায়েখ শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দীকে আর হিন্দুস্থানের দায়িত্ব আপনাকে দেওয়া হলো। একই সুসংবাদ খাজা বাবা মদীনা শরীফে (অবস্থানকালে) রওজায়ে আকদাস জিয়ারতকালে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প থেকে পেয়েছিলেন।
প্রিয় নবীর দরবারে খাজা গরীবে নেওয়াজ
হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন মক্কায়। হজ্বvখাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী পর্ব শেষ করে মক্কা শরীফ থেকে হযরত খাজা বাবা মদিনা শরীফে আসেন এবং অতিশ্রদ্ধাভক্তি এবং নম্রতার সহিত হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাজার শরীফে হাজির হন। প্রত্যেক দিনের ন্যায় নামাজের জন্য মসজিদে নববীতে উপস্থিত। হঠাৎ খাদিম সাহেবকে হুজুর করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দেশ করলেন: “মঈনুদ্দিন চিশতিকে উপস্থিত কর”। হযরত খাজা গরীব এ এই শব্দ শুনা মাত্রই তিনি খাদিম সাহেবের নিকটে পৌঁছলেন। খাদিমvনেওয়াজ সাহেব তাকে রওজা শরীফে পৌঁছিয়ে আরজ করলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মঈন উদ্দীন চিশতি উপস্থিত”। এ কথা বলা মাত্রই রওজা শরীফ এর দরজা নিজ হতেই খুলে গেল। হুজুরে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জ্যোতির্ময় চেহারায় আবির্ভুত হয়ে এরশাদ ফরমান: “হে কুতুবুল মশায়েখ, ভিতরে এসো”। হযরত খাজা বাবা আত্মহারা হয়ে রওজা শরীফের ভিতরে প্রবেশ করলেন। সেখানে এর হুশvনূর ও জ্যোতি দেখে তিনি বিমুগ্ধ ও বিমূঢ় হয়ে যান। যখন খাজা বাবা অর্থাৎ জ্ঞান ফিরল তখন হুকুম হল, “হে, মঈনুদ্দিন, তুমি আমার দ্বীনের মঈন(সাহায্যকারী) আজ আমি তোমাকে হিন্দের বেলায়েত দান করলাম। তুমি হিন্দুস্থানে যাও এবং আজমির নামক স্থানে দ্বীনের প্রচার কর। খোদা তোমাকে বরকত দান । পরণেইvকরবেন”। সুসমাচার শুনে পরিতৃপ্ত হলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী চিন্তিত হলেন তিনি। কোথায় আজমির? বিশাল হিন্দুস্থানের কোথায় রসূল করিম এরনির্দেশিত আজমীর? চিন্তিত অবস্থায় তন্দ্রাছ্ছন্ন হয়ে পড়লেন খাজা মইনুদ্দিন । সেই অবস্থায় তিনি দেখলেন, হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াvচিশ্তী সাল্লাম তার শিয়রে উপবিষ্ট। তিনি তাকে আজমীর শহরের দৃশ্য দেখিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে দিয়ে দিলেন প্রয়োজনীয় পথ নির্দেশনা। এরপর দয়াল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার হাতে দিলেন একটি সুমিষ্ট আনার। তারপর তার জন্য দোয়ায়ে খায়ের করে যাত্রা শুরু করার নির্দেশ দিলেন।
আজমিরে শুভাগমন
খাজা গরীবে নেওয়াজ নবীজির নির্দেশেই সুদূর আরব হতে ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান হয়ে প্রথমে লাহোর পরে দিল্লী হয়ে আজমিরে শুভাগমন করেন। ভারতবর্ষে চলছিল তখন অত্যাচারী বিধর্মী শাসকদের কুশাসন। সঙ্গী সাথীসহ দিল্লী এসে উপস্থিত । দিল্লীর শাসক তখন হিন্দুরাজা খান্ডরাও।vহলেন হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী আজমীর অধিপতি পৃথ্বিরাজের ভাই। রাজমহলের অদূরেই নির্মিত হলো ফকির দরবেশদের ডেরা। নির্ভয়ে শুরু করলেন তাদের নিয়মিত ইবাদত-বন্দেগী। ক্রমে ক্রমে ইসলামের আলো প্রসারিত হতে থাকলো। পিতৃ ধর্ম ত্যাগ করে দলে দলে লোক এসে প্রবেশ করতে থাকলো আল্লাহর মনোনীত একমাত্র ধর্ম ইসলামের সুবাসিত কাননে। কিন্তু গন্তব্য তো এখানে নয়। এগিয়ে যেতে হবে আরো সম্মুখে। রসুল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশিত সেই আজমীরের আকর্ষণ এক সময় এর অন্তরকে। দিল্লীর কুতুবvউদ্বেলিত করে তুললো খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী কে। দিল্লীর দ্বীনvহিসেবে নির্বাচিত করলেন হযরত কুতুবুদ্দিন বখতিয়ার কাকী র উপর।vপ্রচার ও নওমুসলিমের বিরাট কাফেলার হেফাজতের দায়িত্ব হযরত কাকী । সফর সঙ্গীগণন সবাইvআজমীর শহরের উপকন্ঠে এসে উপস্থিত হলেন খাজা পরিশ্রান্ত। বিশ্রামের ব্যবস্থা করতেই হয়। এই সেই বেলায়াতের প্রতিশ্রুত কেন্দ্রভুমি আজমীর। চারিদিকে পাহাড়,পাথর মরুভূমি। নিকটেই বৃছায়া। এখানেই বিশ্রামের জন্য উপবেশন করলেন দরবেশদের কাফেলা। স্থানটি ছিল রাজা পৃথ্বিরাজের উষ্ট্র পালের বিশ্রামস্থল। রাজার লোকেরা কিছুণ যেতে না যেতেই । উটেরvসবাইকে স্থান ত্যাগ করতে বলল। বিস্মিত হলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশতী দলতো এসে পৌঁছবে সেই সন্ধ্যাবেলায়। অথচ লোকগুলো তাদেরকে এখনই তাড়িয়ে দিতে চায়। তিনি বললেন” ঠিক আছে আমরা চললাম, তোমাদের উটই এখানে বসে বসে বিশ্রাম করুক।” সে রাতেই মুখে মুখে আগন্তুক দরবেশের আগমন সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো সর্বত্র। সকালে মহারাজ পৃথ্বিরাজও শুনতে পেলেন এক অদ্ভুত সংবাদ। উষ্ট্রশালার কর্মচারীগণ এসে জানালো, গতকাল সন্ধ্যায় যে উটগুলো উষ্ট্রশালায় আনা হয়েছিলসবগুলো এখনও শুয়ে আছে। কিছুতেই উঠবার নাম করছে না। সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান দরবেশ দলের ঘটনাও বর্ণিত হলো রাজার কাছে। দরবেশ দলের নেতা উষ্ট্রশালা পরিত্যাগের সময় বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের উটই এখনে বসে বসে বিশ্রাম করুক।”
ইতিপূর্বে বিপ্তিভাবে মুসলমান ফকিরদের সম্পর্কে এরকম অনেক কথা রাজার কর্ণগোচর হয়েছিল। চিন্তিত হয়ে পড়লেন রাজা পৃথ্বিরাজ। মনে পড়ে গেল তার রাজমাতার ভবিষ্যতবানীর কথা। তিনি বলেছিলেন ”এক মুসলমান ফকিরের অভিসম্পাতেই পৃথ্বিরাজের রাজ্য ধ্বংস হবে।” একি তবে সেই ফকির? সম্ভবত এই ফকিরের কথাতেই এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কর্মচারীদেরকে ফকিরদের কাছে মা চাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন রাজা। রাজ আদেশ পালন করল শ্রমিকেরা। হযরত খাজা মইনুদ্দিন বললেন: যাও, এ অবস্থা আর থাকবে না।“ উটশালায় ফিরে এসে বিস্ময়েরvচিশ্তী সঙ্গে সবাই ল্য করল উটগুলো স্বাভাবিকভাবে চলাচল শুরু করেছে। ফকিরের কারামতি দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল। কৌতূহল নিবারণের জন্য লোকজন যাতায়াত শুরু করে দিল হযরত খাজার আস্তানায়। তার পবিত্র চেহারা আর তার সাথীদের প্রাণখোলা মধুর চরিত্রের প্রভাবে সম্মোহিত হতে লাগলো আজমিরবাসী। হযরত খাজা মইনুদ্দিন এর সোহবতের (সাাৎ) বরকতে তাদের অন্তরের অন্ধকার দূর হতে লাগলো।vচিশ্তী জেগে উঠলো আজমিরের সত্যান্বেষী জনতা। কিন্তু আতংকিত হলো পুরোহিতরা, শোষক বর্ণবাদী হিন্দু সমাজ। ভীত হলো হিংস্র রাজপুরুষগণ এবং সামন্তবাদী সম্রাট।
ও তারvইসলাম বিদ্বেষী লোকজন রাজদরবারে গিয়ে হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী সহচরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলো। অভিযোগ শুনে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন রাজাপৃথ্বিরাজ। অহংকারের নীচে চাপা পড়ে গেল মায়ের সদুপদেশবাণী। রাজা একদল সৈন্যকে আদেশ দিলেন ফকির দরবেশদলকে এখনই রাজ্য থেকে বিতাড়িত করতে। রাজার vআদেশ পেয়ে শুরু হলো অভিযান। কিন্তু হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী নির্বিকার। আল্লাহ পাকের সাহায্য কামনা করলেন তিনি। সাথে সাথেইআক্রমনকারীদের কেউ হল অন্ধ, কারও শরীর হল নিঃসাড়। কেউ হলো ভূতলশায়ী। নিরুপায় হয়ে পায়ে পড়ে মা প্রার্থনা করলো তারা। দয়ার সাগর গরীবে নেওয়াজ হযরত মা করে দিলেন সবাইকে।vখাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী
রাজা পৃথ্বিরাজ ভেবে কুল পান না কি করবেন তিনি। সমরাস্ত্র, সুসজ্জিত সৈন্যদল কোন কিছুই যে আর কাজে আসছে না। এক দূরাগত ফকিরের নিকট পরাজয় বরণ করতে হবে তাকে? ঐশ্বরিক মতাধর এই ফকিরের আনুগত্য স্বীকার করবেন নাকি তাকে বিতাড়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন। এ কি বিস্ময়কর সংকট। চুপ করে থাকলেও বিপদ। বিরুদ্ধাচরণ করলেও সমস্যা। এদিকে দলে দলে লোকজন গ্রহন করছে ফকিরের প্রচারিত ধর্ম ইসলাম।
রাজা ভেবে চিন্তে ঠিক করলেন, হিন্দু ধর্মের আধ্যাত্মিক সিদ্ধপুরুষদের দ্বারা প্রতিরোধ করতে হবে ফকিরকে। তাই সিদ্ধপুরুষ বলে খ্যাত ‘‘রামদেও” কে অনুরোধ করলেন তার যোগমন্ত্র বলে এই যবন ফকিরকে বিতাড়িত করতে। রামদেও রাজী কে পরাস্তvহলেন। তার দীর্ঘ সাধনালব্ধ শক্তিতে হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী তখনvকরার বাসনায় হাজির হলেন হযরতের দরবারে। হযরত খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী ছিলেন ধ্যানমগ্ন। কিছুণ পর চোখ খুললেন হযরত। দৃষ্টিপাত করলেন রামদেও খাজা এর জ্যোতির্ময় চেহারার দিকে। মুগ্ধ হয়ে গেলেন রামদেও।vমইনুদ্দিন চিশ্তী তার অলৌকিক শক্তি মুহূর্তের মধ্যে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। অন্ধকারে আলো জ্বললে মুহুর্তেই যেমন করে অন্ধকার অপসারিত হয়। হজরত খাজার কদম মোবারকে লুটিয়ে তার নামvপড়লেন রামদেও। স্বীকার করলেন ইসলাম। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী রাখলেন “মোহাম্মদ সাদী”। রামদেও এর ইসলাম গ্রহণের সংবাদ শুনে রাজা ােভে দুঃখে অস্থির হয়ে উঠলেন। কিন্তু বিদূষী মায়ের উপর্যুপরি উপদেশের কথা স্মরণ করে বাধ্য হয়ে সংযত হলেন রাজা। কিন্তু কিছুদিন পরই দেখা দিল আরেক বিপদ।
আনা সগর
পরিশ্রান্ত কাফেলা আবার এগিয়ে চললো সামনের দিকে। অদুরে ‘আনা সাগর’। সাগরতো নয় একটি বিশাল হ্রদ। লোকে বলে আনা সাগর। আনা সাগরের পাড় ঘেষে অজস্র মন্দির। আনা সগরের পানি শুধুমাত্র উচ্চ বর্ণের হিন্দু এবং পুরোহিত সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারতো না। নিম্ন বর্ণের হ্ন্দিুরা এটা তাদের ধর্মীয় বিধান বলে মনে করত। কিন্তু মুসলমানরা কি আর বর্ণভেদের ধার ধারে? একদিন আনা সাগরে অজু করতে গেলন হজরত খাজার একজন সাগরেদ। পুরোহিতরা অপমান করে তাড়িয়ে কে।vদিলো তাঁকে। সাগরেদ সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী তখন তিনি হযরত খাজা মোহাম্মদ সাদীকে‘‘আনা সাগর” থেকে এক ঘটি পানি আনার নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ মত মোহাম্মদ সাদী ‘আনা সাগর’ থেকে এক ঘটি পানি আনতেই দেখা গেলো এক আশ্চর্য দৃশ্য। কোথায় সাগর? সব পানি তার শুকিয়ে গিয়েছে একেবারে।
এই আলৌকিক ঘটনা রাজাকে জানালো প্রজারা। বিব্রত বোধ করলো রাজা। রাজা বাধ্য হয়ে আবারও তাদের প্রজাদের দুর্ব্যবহারের জন্য ফকিরের কাছে মা চাইতে নির্দেশ দিলেন। প্রমাদ গুনলেন পুরোহিত সম্প্রদায়। কিন্তু উপায়ন্তর না দেখে তারা এর কাছে গিয়ে মা ভিা করলেন। মানুষের দুর্দশা দেখে ওvখাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী পুরোহিতদের মার পরিপ্রেেিত মোহাম্মদ সাদীকে পুনরায় ঘটিতে ভরা পানি আনা সাগরে ঢেলে দিতে নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ পালিত হলো। ঘটির পানি ঢেলে দেয়ারসাথে সাথেই ভরে গেল বিশাল হ্রদ ‘আনা সাগর’। এই আলৌকিক ঘটনার পর বহুলোক এর হাত ধরে।vইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিল খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী
পৃথ্বিরাজ ভেবে পাননা কি করে এ মুসলমান ফকিরকে প্রতিহত করা যায়। কেউ কেউ রাজাকে বুদ্ধি দিলেন বিখ্যাত ঐন্দ্রজালিক অজয় পালকে দিয়ে কিছু করা যায় কিনা? রাজা তাকেই ডেকে পাঠালেন এবং রাজকীয় পুরস্কারের প্রস্তাব করলেন। অজয় কে ঘায়েল করার চেষ্টাvপাল তার সর্বশক্তি দিয়ে খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী করলেন। অজয় পালও তার ভুল বুঝতে পেরে তার সঙ্গী সাথীসহ ইসলাম ধর্ম গ্রহন অজয় পালের নাম রাখলেন ‘আব্দুল্লাহvকরলেন। খাজা মইনুদ্দিন চিশতী বিয়াবানী’।
এ সংবাদ শুনে মুচড়ে পড়লেন রাজা। নিজ রাজ্য রার কথা চিন্তা করে সংঘর্ষরে পথ অবলম্বন করলেন। রাজদরবারের একজন কর্মচারী ছিলেন মুসলমান, খাজা মইনুদ্দিন এর একান্ত অনুরক্ত। সেই কর্মচারীর উপর প্তি হয়ে উঠলেন রাজা। খাজাvচিশ্তী এর কাছে বার বার হেনস্ত হবার সমস্ত ােভ যেন গিয়ে পড়লোvমইনুদ্দিন চিশ্তী এরvতার উপর। মুসলমান কর্মচারী সমস্ত দুঃখের কথা খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী কাছে বর্ণনা করার পর খাজাকে অনুরোধ করলেন তার জন্য রাজার কাছে একটি সুপারিশ একান্ত বিনয় ও নম্রতার সাথে সেইvপত্র পাঠাতে। খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী কর্মচারীর পে একটি সুপারিশ পত্র পাঠালেন। সেই সঙ্গে রাজাকে জানালেন ইসলাম গ্রহণের একান্ত আহ্বান। চিঠি পেয়ে রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন পৃথ্বিরাজ। মুসলমান কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করলেন রাজা। সেই সঙ্গে খাজা এর বিরুদ্ধে উচ্চারণ করলেন অশালীন বক্তব্য। সংবাদ শুনেvমইনুদ্দিন চিশ্তী এর প্রেমময় অন্তরেও প্রজ্জলিত হলো রুদ্ররোষেরvখাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী আগুন। তিনি এক টুকরা কাগজে লিখে পাঠালেন রাজা পৃথ্বিরাজকে- ‘‘মান তোরা যেন্দা বদস্তে লশকরে ইসলাম বছোপর্দম”। অর্থাৎ আমি তোমাকে তোমারজীবিতাবস্থাতেই মুসলিম সেনাদের হাতে সুপর্দ করলাম।
ইতোপুর্বে দুই দুইবার হিন্দুস্থান আক্রমণ করেও সফল হতে পারেননি সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী। তিনি স্বপ্নে দেখলেন শ্বেত শুভ্র বস্ত্রাবৃত এক জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ তাকে ল্য করে বললেন, ‘‘যাও তোমাকে আমি হিন্দুস্থানের শাসন মতা দান করলাম।” এ শুভ স্বপ্ন দেখে সুলতান মনস্থির করলেন হিন্দুস্থান অভিযান শুরু করার। ৫৮৮ হিজরি সালে সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী তার বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে হিন্দুস্থান অভিমুখে রওয়ানা হলেন। এই বাহিনীর প্রধান সেনাপতি কুতুবুদ্দিন আইবেক। তারায়েনা প্রান্তরে দুই বাহিনীর মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হলো। মুসলমানদের প্রচন্ড আক্রমণের সামনে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল পৌত্তলিক সৈন্যবাহিনী। তারা যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে গেলো, পালিয়ে গেলো সেনাপতি খান্ডে রাও। রাজা পৃথ্বিরাজও সরস্বতী নদীর তীর ধরে পালাবার চেষ্টা করার সময় মুসলমানদের সৈন্যদের হাতে বন্দী হল। শেষাবধি নিহত হল রাজা। ৫৮৮ হিজরি সালে ভয়াবহ এ যুদ্ধে সুলতান সাহাবুদ্দিন ঘোরী বিজয় লাভ করলেন। আরো সামনে এগিয়ে চললো ঘোরী বাহিনী। এর পর সহজেই এক এক করে সরস্বতী, সামানা ও হাশিসহ অধিকৃত হল দিল্লী। সুলতান দিল্লীর দায়িত্ব দিলেন কুতুবুদ্দিন আইবেককে । তারপর সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী এগিয়ে চললেন আজমীরের দিকে।
তাঁর এই অপ্রতিরুদ্ধ অগ্রাভিযানের সামনে অবনত হলো যুদ্ধে নিহত হিন্দু রাজাদের পুত্রগণ। দেউল নামক স্থানে সম্রাটের সঙ্গে সাাৎ করলো রাজপুত্রগণ। মুসলিম শাসনের প্রতি তাদের আনুগত্যের বিনিময়ে সম্রাট তাদেরকে দান করলেন বিভিন্ন রাজ্যের জায়গীদার। সুলতান এগিয়ে চললেন আজমীরের দিকে।
এর কাফেলা। ইসলামvএদিকে আজমীরে ক্রমাগত বেড়েই চলছে খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী vকবুলকারীদের সংখ্যা এখন ল ল। শুধু আজমীরে নয় এখন খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী এর জামাত এখন ছড়িয়ে পড়েছে হিন্দুস্থানের কোণায় কোণায়। দর্শনার্থীদের ভিড় সব সময় লেগেই থাকে।
সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী অবশেষে আজমীর এসে পৌঁছলেন। তখন সন্ধ্যা আসন্ন। সূর্যাস্ত হওয়ার পর সচকিত হয়ে উঠলেন সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদঘুরী। দূরে কোথায় আজানের ধ্বনি শোনা যায়। সেদিকে এগিয়ে যেতেই তিনি দেখলেন একদল নুরানী লোক হাত বেঁধে দাঁড়িয়েছেন। দরবেশদের জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করলেন সুলতান। সালাত শেষে জামাতের ইমামের মুখের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলেন সুলতান শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ ঘুরী। এইতো সেই জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ, স্বপ্নে যিনি জানিয়েছেন হিন্দুস্থান বিজয়ের সুসংবাদ।
সুলতান শ্রদ্ধাভরে পরিচিত হলেন হজরত খাজার সাথে। সুলতান হযরতের মোবারক হাতে বায়াত গ্রহণ করে তার সোহবতে তিন দিন অতিবাহিত করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন । তার প্রতিনিধি হিসেবে দিল্লীতে রেখে গেলেন কুতুবুদ্দিন আইবেককে। ’র হাতে। এরvতিনিও বায়াত গ্রহন করলেন খাজার প্রতিনিধি খাজা বখতিয়ার কাকী পর কুতুবুদ্দিন আইবেক ক্রমে ক্রমে প্রসারিত করলেন মুসলিম রাজ্যের সীমানা। কনৌজ, বানারসসহ আরো বহু স্থানে উড়িয়ে দিলেন ইসলামের বিজয় পতাকা।
ইন্তেকাল
৬৩৩ হিজরীর ৫ রজব দিবাগত রাত অর্থাৎ ৬ রজবvহযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী সুবহে সাদেকের সময় ইন্তেকাল করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। ওফাতের সাথে সাথে তাঁর পবিত্র কপাল শরীফ-এ স্পষ্টভাবে আরবীতে স্বর্ণোজ্বল নূরানী অরে লিখা হয়ে যায় “হাযা হাবীবুল্লাহ মা-তা ফি হুব্বিল্লাহ” অর্থাৎ ইনি আল্লাহর বন্ধু আল্লাহর মুহব্বতেই তিনি বিছাল লাভ করেছেন। গরীবে নেওয়াজের বড় তার নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন।vসাহেবজাদা হযরত খাজা ফখরুদ্দীন চিশতী কে খিলাফতের জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি হযরত খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী দায়িত্ব অর্পণ করে সিলসিলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন।
(সংগৃহীত)