খবরের বিস্তারিত...


ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আলফেসানী হযরত শায়েখ আহমদ ফারুকী সেরহিন্দী (রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

সম্রাট ফিরোজ শাহ্‌ তুঘলকের রাজত্বকালে একদল শাহী কর্মচারী লাহোর থেকে দিল্লী যাওয়ার পথে পূর্ব পাঞ্জাবের সিরহিন্দের জঙ্গল অতিক্রম করেছিলেন। তৎমধ্যে একজন কামেল ব্যক্তি অন্তর্দৃষ্টিতে দেখতে পেলেন গভীর জঙ্গল থেকে একটি উজ্জ্বল নূর বিকিরিত হচ্ছে। দিল্লী পৌঁছেই তিনি সম্রাটের মুর্শিদ সৈয়দ জালালুদ্দীন বুখারী (রহ.) কে এই অলৌকিক ঘটনা অবহিত করলেন। পীর ছাহেব বিস্তারিত শুনে সম্রাটকে দ্বিতীয় সহস্রের ইসলামের মুজাদ্দেদ আগমনের সুসংবাদ প্রদান করে বললেন, ‘জমানার মুজাদ্দেদ ও ইমাম যাঁর ঐশী নূরে সমস্ত পৃথিবী আলোকিত হবে, যিনি পূর্ববর্তী সমস্ত অলি এবং কুতুবগণের কালামাত লাভে ধন্য হবেন, তিনি এই সিরহিন্দেই জন্ম লাভ করবেন।’ যুগপৎ চমকিত ও বিস্মিত সম্রাট পীর ছাহেবের কথা শুনে পুণ্য লাভের মানসে সিরহিন্দের জঙ্গল কেটে সেখানে একটি শাহী দূর্গ নির্মাণে মনোনিবেশ করলেন। এদিকে পীর ছাহেব তদীয় খলিফা হজরত ইমাম রফিউদ্দীন (রহ.)কে সিরহিন্দের কুতুব মনোনীত করে বললেন, ‘মনে রেখো সেই মুজাদ্দেদ এর জন্ম তোমার বংশেই হবে’।

ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মুমিনীন হজরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) এর সুযোগ্য বংশধর হজরত ইমাম রফিউদ্দীন (রহ.) এর আওলাদ হজরত মখদুম আবদুল আহাদ সিরহিন্দি (রহ.) এর ঔরসে হিজরী ৯৭১ সনের ১৪ই শাওয়াল শুক্রবার এই উপমহাদেশে নক্‌শবন্দিয়া তরীকার মহান বুজর্গ হজরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রহ.) পূর্ব পাঞ্জাবের সিরহিন্দ শরীফে জন্ম লাভ করেন। যে সমস্ত মহা পুরুষ কালের প্রবাহে নিজেদের অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের দ্বারা, জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ডের ফলে, সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার এবং বেদআত সমূহের মূল উৎপাটন করে মানুষের কল্যাণ সাধনে সক্ষম হয়েছিলেন তাদের মধ্যে হজরত মুজাদ্দেদ আলফেসানীর নাম প্রণিধানযোগ্য।

হজরতের জন্মের পূর্বে তদীয় পিতা একদিন মুরাকাবা অবস্থায় অবলোকন করলেন, জগতের পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত নিকষ কালো আঁধারে ছেয়ে গেছে এবং নানাবিধ হিংস্র শাপদ মানুষের নিশ্চিহ্ন করে চলেছে। সেই মুহূর্তে তাঁর বুকের মধ্যখান থেকে একটি উজ্জ্বল আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হয়ে সমস্ত পৃথিবী আলোকিত করে ফেলে। তিনি আরো লক্ষ্য করলেন ঐ আলোর ভিতর থেকে একটি সিংহাসন বের হয়ে এলো, তথায় উপবিষ্ট এক জোতির্ময় মহাপুরুষ। তাঁর সামনে অত্যন্ত নম্র এবং আদরের সাথে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য বেহেস্তী লোক এবং ফিরিস্তাকূল। তিনি আরো লক্ষ্য করলেন, উক্ত বুজর্গ তাঁর হস্তস্থিত লাঠির আঘাতে মানুষ হত্যাকারী শাপদদের পিটিয়ে মারছেন আর উচ্চ শব্দে ঘোষণা করছেন, সত্যের আবির্ভাব ঘটেছে ও মিথ্যা দূরীভূত হয়েছে।

পিতার বেসালতে হাকিকী লাভের পরে হজরত পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে দিল্লী এসে স্বীয় বন্ধু হজরত হাসান কাশ্মিরী (রহ.) এর আতিথ্য গ্রহণ করেন। বন্ধুর মুখেই শুনেন সদ্য কাবুল প্রত্যাগত নক্‌শবন্দীয়া তরীকার স্বনামধন্য বুজর্গ হজরত খাজা মুহাম্মদ বাকী বিল্লাহ (রহ.) এর নাম। এই মহান সাধকের নামের মধ্যে এতই আকর্ষণ শক্তি ছিল হজরত শায়খ আহমদ তাঁর সাথে সাক্ষাৎ লাভের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। বন্ধু সমভিব্যবহারে তিনি হজরত খাজার দরবারে এসে পৌঁছলে হজরত তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে কিছুকালের জন্যে মেহমান হওয়ার অনুরোধ জানালেন। অত্যন্ত আগ্রহ চিত্তে তিনি হজরত খাজার আতিথ্য গ্রহণ করে সপ্তাহকাল অবস্থানের আগ্রহ প্রকাশ করলেন। ইতোমধ্যে হজরত খাজা ইস্তখারা ব্যতীত হজরতকে নক্‌শবন্দীয়া তরীকায় মুরিদ করেন। অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই হজরত শায়খ আহমদ নক্‌শবন্দীয়া তরীকার কামালাত ও ফইউজাত এর বন্যায় নিজেকে সমাহিত করে প্রেম সাগরে ডুবে রইলেন। এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হলে হজরত খাজা তদীয় বিশিষ্ট মুরিদদের বললেন, কাশ্মির সিরহিন্দ পৌঁছার পরে আমি অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম আমার আশেপাশে একজন কুতুব অবস্থান করছেন এবং উক্ত কুতুবের চেহারা মুবারক শায়খ আহমদ এর সাথে মিলে গেলে আমি বুঝতে পেরেছিলাম উনার আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ দানের জন্যেই আমার ভারতে আগমন’। নক্‌শবন্দীয়া তরীকায় অসাধারণ উন্নতি লাভের ফলে মাত্র তিন মাসের মধ্যে হজরত এই তরীকার মাকামাত সমূহ সফলভাবে অতিক্রম করে নিসবত লাভ করলে বাকী বিল্লাহ (রহ.) খাজা হজরতকে ফেলাফত প্রদান করেন। দ্বিতীয়বার তিনি পীর ছাহেবের সান্নিধ্য লাভার্থে দিল্লী তশরীফ নিয়ে এলে হজরত খাজা যুগশ্রেষ্ঠ এই মুরিদের অভ্যর্থনার জন্যে বুলন্দ দরওয়াজা পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মুর্শিদ কেবলা খাজা বাকী বিল্লাহ বলেছেন শায়খ আহমদ সিরহিন্দির হাতে এ তরীকার আমানত সমূহ সোপর্দ করতে পেরে আমি দায়মুক্ত হয়েছি। তিনি তদীয় মুরিদদের বলতেন, ‘যদি তোমরা তোমাদের ঈমানের নিরাপত্তা কামনা করো তবে শায়খ আহমদ সিরহিন্দর নম্রতা, আদব ও আজিজির প্রতি খেয়াল রেখো। তিনি রূহানী জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র স্বরূপ। তাঁর নূরে তেজস্ক্রীয়তার সামনে আমাদের মতো শত সহস্র তারকা নিষ্প্রভ ও অস্তিত্বহীন বটে।

হজরত তদীয় মুরিদদের জন্যে অত্যন্ত সহজ পদ্ধতিতে শিক্ষা লাভ করতে পারে এমন একটি তরীকা গঠনে সচেষ্ট হন। অতঃপর নক্‌শবন্দীয়া তরীকার অঙ্গসৌষ্ঠবকে আরো মহিমামণ্ডিত করে এক নতুন তরীকার প্রচলন করেন, যা বিশ্বব্যাপী মুজাদ্দেদীয়া তরীকা নামে খ্যাতি লাভ করে। বস্তুতঃ এলম মারিফাতের সকল তরীকা আরব এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে আগত কিন্তু এটাই একটি মাত্র তরীকা যা ভারত থেকে প্রকাশ লাভ করে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মূলতঃ এ যাবত কালের সমস্ত

তরীকার নির্যাস নিয়ে মুজাদ্দেদীয়া তরীকা গঠিত হয়েছে বলে বিভিন্ন তরীকার মশায়খগণের ফয়ুজাত ও কালামাত সমূহ এ তরীকায় প্রবিষ্ট করা হয়েছে।

সম্রাট আকবরের একান্ত চাটুকার মোল্লা মুবারক নাগোরী এবং তৎপুত্রদ্বয় আবুল ফজল ও ফৈজী প্রভৃতি দুনিয়া লোভী আলেমদের কুপ্ররোচণায় সম্রাট বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর মনোরঞ্জনের জন্য দীন ই ইলাহী নামে একটি মিশ্র এবং অভিনব ধর্মের অবতারণা করেন। এ ধর্মের বিশেষত্ব হলো পুনর্জন্মে বিশ্বাস স্থাপন, গাভী ও গোবরের পূজা পালন, সুদ ও জুয়া ব্যবসায়ের জন্যে হালাল, বাঘ ও ভালুকের মাংস হালাল। মেষ, উট ও গাভীর মাংস হারাম বলে ফতোয়া জারী করা হয়। ভারতবর্ষের নিরীহ মুসলমানদেরকে বাধ্য করা হলো শরীয়ত বিরুদ্ধ এ ধর্ম পালনে। এ সমস্ত কুসংস্কারকে একত্রিত করে সম্রাট ইসলামী শরীয়তের প্রতি প্রচণ্ড আঘাত করেন। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে সম্রাট ও তার আমাত্যরা সম্রাজ্যের সকল সুবিধা ভোগ করতে থাকলো বেচারা জনগণ একান্ত ভীত সন্ত্রস্তভাবে সম্রাটের পূজায় রত থাকলো। মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.) অত্যন্ত স্থির মস্তিষ্কে দীন ই ইলাহীর প্রতিটি আঙ্গিকের অসারতা ব্যাখ্যা করে সম্রাটের দরবারের আমীর উমরা এবং তৎকালীন দীনদার আলেম ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছেএমন সাবধানমূলক পত্রাদি লিখলেন যে তাঁর ক্ষুরধার যুক্তির সামনে এ বানোয়াট ধর্মের কোন সারবত্তা খুঁজে পাওয়া গেল না। তিনি সম্রাটের এ সমস্ত অনৈসলামিক কাজের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন। এ কাজের শুরুতে তিনি বিভিন্ন এলাকাতে ঈমানী জজবা সম্পন্ন খলিফা, মুয়াল্লিম প্রেরণ করেন। আমীর ওমরাহদের দরবারে শরীয়তের যুুক্তিপূর্ণ মাস্‌আলাহ প্রেরণপূর্বক দীন ই ইলাহীর অসারতা প্রমাণ করেন। স্বয়ং সম্রাটের কাছে এ ব্যাপারে শরীয়তের নির্দেশ সম্বলিত বার্তা প্রেরণ করলে সম্রাট কিছুটা নমনীয় হয়ে তাঁর স্বঘোষিত ধর্মকে ঐচ্ছিক ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন।

একবার রমজান মাসের শেষের দিকে শরীয়তের বিধান মতে চন্দ্রের উদায় প্রমাণিত হওয়ার পূর্বেই সম্রাট আকবর ঈদের ঘোষণা দিয়ে জনগণের রোজা ভঙ্গ করেন। ঐদিন হজরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.) রোজা অবস্থায় আবুল ফজলের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। আবুল ফজলের শত মিনতিতেও হজরত পানি পান করলেন না। এতে আবুল ফজল চিন্তিত হন। হজরত বলেন বেদীন সম্রাটের ঘোষণা নির্ভরযোগ্য নয়। অতঃপর আবুল ফজল অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে হজরতের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। অন্য একদিন আবুল ফজল রিসালতের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করলে হজরত রাগে ক্ষোভে অস্থির হয়ে পড়েন। এর পরে আবুল ফজলের ক্ষমার প্রার্থনাও না মঞ্জুর হয়। মহানবী (দ.) এর প্রতি চরম অসম্মান এবং অবমাননা সহ্য করতে না পেরে হজরত অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ মন নিয়ে এ বিতর্ক খণ্ডন করে ‘এছবাতুন নবুয়ত’ রচনা করেন। এ ঘটনার ক’দিন পরেই ১৬০১ সনে জনৈক অমুসলিম কর্তৃক আবুল ফজল নির্মমভাবে নিহত হন।

আল্লাহপাক পৃথিবীর প্রত্যেক এলাকায় প্রত্যেক জাতির জন্যে নবী প্রেরণ করেছেন। প্রাচীন ভারতবর্ষেও নবীদের আবির্ভাব হয়েছিল। যদিও তাঁদের অনুসারীদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। এ সম্পর্কে হজরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.) বলেন, ‘আমি কাশফের মাধ্যমে জানতে পারি ভারতবর্ষে অনেক নবীর আবির্ভাব হয়েছিল। তাঁদের কবর থেকে নুর বিকশিত হচ্ছে। পরে তিনি সিরহিন্দের অনতিদূরে ‘বরাস’ নামক স্থানে চল্লিশজন নবীর মাজার শনাক্ত করে দেন। মাজারগুলো একটি উঁচু টিলার উপর অবস্থিত। পরবর্তীতে যুগ বরেণ্য আলেমগণ তথায় গিয়ে হজরতের বক্তব্যের স্বীকৃতি দেন। বর্তমানে স্থানটি মুসলমানদের জিয়ারতের স্থান হিসেবে বিবেচিত।

একদিন হজরত মুরাকাবায় হালতে নিজের দোষ-ত্রুটির দিকে খেয়াল করে অত্যাধিক বিনয় ও নম্রতা সহকারে কান্নাকাটি করছিলেন, এমন সময় ইলহাম হলো, ‘আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম এবং কিয়ামত পর্যন্ত যত লোক আপনার ওছিলা গ্রহণ করে আমার কাছে ক্ষমা চাইব তাঁদেরকেও ক্ষমা করলাম। তাঁরা আপনার সিলসিলাভুক্ত হোক অথবা সিলসিলা বহির্ভূত হোক।

হজরতের রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে মুকতবাত শরীফ, মাবদা ও মাআত, আআরিফে লাদুন্নিয়া, মুকাশিফাতে আয়নিয়া, ইস্‌বাতুন নবুয়ত এবং তাহলিলিয়া বিশেষ উল্লেখযোগ্য। হজরতের কঠোর কঠিন আন্দোলনের কারণেই মহাপরাক্রশশালী আকবরের দীন-ই-ইলাহীর কবর রচনা হয়েছিল এবং নেশাগ্রস্ত সম্রাট জাহাঙ্গীরের তওবা নসীব হয়েছিলো। এরপর পরই ধার্মিক শাহজাহান এবং বুজর্গ আওরঙ্গজেবের আবির্ভাব হয়ে ভারতবর্ষে ইসলামী শাসন কায়েম হয়েছিলো।

হজরত শায়খ আহমদ ফারুকী মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.) ৬৩ বছর বয়সে হিজরী ১০৩৪ সনে ২৭ সফর এই নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করে আল্লাহপাকের দরবারে উপনীত হন। পূর্ব পাঞ্জাবের সিরহিন্দ শরীফে তার রওজা শরীফ বিদ্যমান। হজরতের সাত পুত্র এবং তিন কন্যা ছিলেন। তাঁর পাঁচ হাজার খলিফা এবং অসংখ্য অনুসারীদের দ্বারা ইত্তেবায়ে সুন্নাহর আন্দোলন পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। হজরতের তৃতীয় পুত্র কাইউমে ছানী খাজা মুহাম্মদ মাসুম (রহ.) ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ আউলিয়া এবং নক্‌শবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া তরীকার মহান কাণ্ডারী।

(সংগৃহীত)

Comments

comments