খবরের বিস্তারিত...


মহান আধ্যাত্মিক সাধক শাহ আব্দুল মালেক আল কুতুব (রহ.)

মহান আধ্যাত্মিক সাধক শাহ আব্দুল মালেক (রহ.)

এইচ এম মুজিবুল হক শুক্কুর

****************

***************

মহামহিম রাব্বুল আলামীনের পেয়ারা হাবিব,বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী, রাহমাতুল্লিল আলামীন, শফিউল মুজনেবীন, হুযুর পুরনূর (দ.), এর মাধ্যমে নবুওয়তী ধারা সমাপ্তির পর মওলা আলী, শেরে খোদা (ক.) এর মাধ্যমে শুরু হলো বেলায়তী ধারাবাহিকতা।
যুগে যুগে এই বেলায়তী ধারার জ্ঞান বিকাশে গাউস-কুতুব-অলি-আবদাল-মোজাদ্দেদ তথা আধ্যাত্মিক সাধকগণ এ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তারই ধারাবাহিকতায় গাউছে মুখতার, মোজাদ্দেদে আখেরুজ্জামান, মুসলিহে আজম, আল্লামা শাহ আব্দুল মালেক মুহিউদ্দিন আল-কুতুবী (রহ.) হচ্ছেন অন্যতম দীপ্ত আলোকবর্তিকা। তিনি তাঁর উপর অর্পিত ঐশী দায়িত্ব পালনে নিরলস সাধনা করে গেছেন জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি। তাঁর আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়ায় পথহারা মানুষ পথের সন্ধান পেয়েছেন। একজন প্রকৃত অলিয়ে কামেল হিসেবে দ্বীনি ইলম চর্চা ও মানবতার কল্যাণে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। তাঁর প্রতি কথা ও কাজে কারামত পরিদৃষ্ট হতো। খোদায়ী প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে মানুষের কল্যাণ সাধনে রত ছিলেন এ মানবকল্যাণকামী সাধক।
কবির ভাষায়- ‘নেগাহে ওলিমে ইয়ে তাছিরো দেখি,
বদল-তি হাজারো তকদীরো দেখি’
তারই বাস্তব প্রতিফলন যেন আল্লামা শাহ আব্দুল মালেক মুহিউদ্দিন আল-কুতুবি (রহ:)-এর জীবনী। তাঁর প্রকাশিত অসংখ্য, দুর্বোধ্য করামতের যৎকিঞ্চিৎ যদি বক্ষমান প্রবন্ধে উল্লেখ করি, অনেকেই আমাকে হয়তো শিরকের ফতোয়া দিতে উদ্যত হবেন, তা জানি। এতদসত্তে¡ও যেহেতু আমার শৈশব-কৈশোর-যৌবনের প্রতিটি পরতে পরতে পারিবারিকভাবেই এ দরবারের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে খুব কাছে থেকে দেখা অনেক অবিশ্বাস্য, করামতের চাক্ষ্যুস আমি ও আমার পরিবারবর্গসহ দরবারে উপস্থিত নানা স্থান থেকে আসা ভক্তবৃন্দ । আল্লাহর রাসূল (দ.) এর হাদিস,”আমার উম্মত শিরিক করবেনা। তবে তারা ফ্যাসাদে লিপ্ত হবে।” কিন্তু আমাদের সমাজে এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা কথায় কথায় শিরিকের ফতোয়া দিতে কুন্ঠাবোধ করে না, যা কখনো কাম্য নয়। ইতিপূর্বে আমরা আউলিয়া কেরামের জীবনীতে, নানা প্রকাশনায়, গ্রন্থে, বয়ানে, বিভিন্ন দরবারে আনাগোনায় নানাস্তরের ওলীয়ে কামেলদের কারামত প্রকাশের বিষয় অবগত হয়েছি। কিন্তু মানবতার কল্যাণে অসংখ্য,অবিশ্বাস্য, জীবন্ত কারামতসমূহ দর্শন করে অবাক হয়েছি বহুবার। এ মহান দরবারে হজরত বাবাজান কেবলার সংস্পর্শে এসে তকদির বদলাতে দেখেছি অসংখ্য দোয়াপ্রার্থীর। অনেক নিঃসন্তান দম্পতির আর্জির প্রেক্ষিতে সন্তান জন্মের জন্য অব্যর্থ দোআ সাথে আগাম ভবিষ্যতবাণী বাস্তবায়িত হতে দেখেছি। মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের হায়াৎ বৃদ্ধির দোয়া’সহ বাকি কত বছর বাঁচবেন তার ভবিষ্যৎবাণী যা অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে, এমন অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। অগণিত দুরারোগ্য রোগীর পূর্ণ সুস্থতা কামনায় দোয়া ও উপশম, বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য বিপদমুক্তির দোয়া ও বিপদমুক্তি, ডুবন্ত নৌযান জানমালসহ উদ্ধার প্রাপ্তি, রাষ্ট্রীয় সংকট উত্তরণে, ক্ষমতার পটপরিবর্তনে তাঁর আধ্যাত্মিক প্রভাব ছিল বিশ্বব্যাপী বিধৃত।
তিনি ভক্তদের বলতেন, ‘আমার কাছে কে কিজন্য এসেছে, সেটা বলার প্রয়োজন নাই। তা যদি আমার জানা না থাকে, তাহলে আমি কিভাবে আল্লাহর অলি হলাম?’ ‘কারামাতুল আউলিয়ায়ে হাক্কুন’-এর প্রতিফলন তাঁর মাঝেই দেখতে পেয়েছি। অথচ তাঁর প্রাত্যাহিক জীবনধারণ, আচার-আচরণ ছিল একেবারেই সাদাসিধে,অনাড়ম্বর। ব্যাহ্যিক দৃষ্টিতে তাকে অনেকেই ‘মজযুব’ বলে চিহ্নিত করতে চাইলেও তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন যে, তিনি ‘মজযুব’ নন। তাঁর ঘোষণামতে, তিনি দুটি রূপের অধিকারী ছিলেন। যার একটি জামালী ও অপরটি জালালী রূপ। এই আধ্যাত্মিক সিদ্ধপুরুষ কেবল একজন আধ্যাত্মিক সাধকই ছিলেন তা নয়, তাঁর ছাত্রজীবন, শিক্ষকতা জীবন, বাস্তবিক কর্মমুখর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ছিল অবিশ্বাস্য সাফল্যে দীপ্তমান। জীবনে তিনি ছিলেন দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসার প্রখর মেধাবী ছাত্র, সংসদের জি,এস, স্বনামধন্য মুহাদ্দিস। হজরত সৈয়দ আজমগড়ি (রহ:)-এর খলিফা, হালিশহর দরবার শরীফের প্রখ্যাত ওলীয়ে কামেল,হজরত সৈয়দ হাফেজ মুনিরুদ্দীন নুরুল্লাহ (রহ:)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন ও খেলাফতে ধন্য হন। তাঁর মতো এত রেয়াজতে অভ্যস্ত অন্য কাউকে আমি কোনোদিন দেখিনি।
জাগতিক চিন্তা-চেতনার প্রেক্ষাপটেও আউলিয়ায়ে কেরামের কারামতগুলো সহজবোধ্য। যেহেতু ওলীউল্লাহগণ আল্লাহ প্রদত্ত আত্মিক শক্তির অধিকারী হন, সেহেতু তাঁদের দোয়া, আল্লাহর দরবারে মকবুল হয়ে যায়। হাদীছে কুদছীতে তার সুস্পষ্ট ঘোষণা আছে। আল্লাহ বলেন, “বান্দা যখন আমার অনুগত হয়ে যায়, তখন তার হাত আমার কুদরতের হাত হয়ে যায় যা দিয়ে সে স্পর্শ করে, বান্দার পা আমার কুদরতের পা হয়ে যায় যা দিয়ে সে চলাচল করে, বান্দার জবান আমার কুদরতের জবান হয়ে যায়, যে জবানে সে বলে,বান্দার চোখ আমার কুদরতের চোখ হয়ে যায় যা দিয়ে সে দর্শন করে। এতেও যদি সহজবোধ্য না হয়, তাহলে বিদ্যমান জাগতিক কর্মকাÐের দিকে দৃষ্টি ফেরালেই দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট প্রতিভাত হবে।
যেমন একজন দানবীর তার ধনভান্ডার থেকে দানের মাধ্যমে,অথবা একজন শিল্পপতি যদি তার প্রতিষ্ঠানে কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে সমসংখ্যক পরিবারের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন, আর তা যদি শিরক না হয়, তাহলে খোদা প্রদত্ত সম্পদে সম্পদশালী হয়ে ওলীউল্লাহদের প্রদত্ত সাহায্য কিভাবে শিরক হতে পারে?
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, বাবাজান কেবলার এ দরবার ছিল নানা দল-মত-আকীদা-তরিকতের মহামিলনস্থল। তিনি অনৈক্যের রশিগুলোকে একসূত্রে বাঁধতে সক্ষম হয়েছিলেন। মিলাদ-কেয়াম-সালাম বিরোধিতাকারীদের মিলাদ-কেয়াম-সালাম করিয়েছেন। দরবারের প্রতিটি বৈঠকের পর দরূদ-সালাম-কেয়াম-মুনাজাত করা হতো। তিনি অগণিত বেনামাজীকে নামাজী বানিয়েছেন। একজন প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতা আমাকে বলেছেন, ‘আমি ধর্মে বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু কুতুবশরীফ দরবারে এসে আমি ধর্ম-দর্শন পেয়েছি।’ বাবাজান কেবলার সান্নিধ্যে অবস্থান করলে আল্লাহর স্মরণ হতো। এ যেন শায়ের এর যথার্থ রচনা, ‘এক জামানা ছোহবতে বা আউলিয়া
বেহতর আজ ছদ ছালে তা আত বে-রিয়া’
(আল্লাহর ওলির সান্নিধ্যে এক মুহূর্ত অবস্থান করা শত বৎসরের নিস্কলুষ এবাদতের চেয়ে উত্তম) তিনি হাতের তালুতে চাপড় মেরে ‘আল্লাহ-বাজী’ জিকিরের যে অনুশীলন করাতেন এতে অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি হতো, যা কেবল এই দরবারেই দেখেছি। এ ব্যতিক্রমী জিকিরের সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়ে বলতেন, ‘আমি আল্লাহর গুনাগার বান্দাদের নফসকে দমন করার জন্য হাতের তালুতে এ আঘাত করছি।’ প্রতিদিন নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান দেয়ার হুকুম তিনি দিতেন। প্রতিবেলায় হাজার হাজার ভক্ত-জায়েরীন আশেকীনের তৃপ্তির সাথে খাবার পরিবেশনের আনজাম কোত্থেকে হতো তা অনুমান করাও দুরূহ ছিল। তাঁর ওফাতের পরও অদ্যাবধি তা চালু আছে এবং বাবাজান কেবলার ভবিষ্যতবাণী অনুসারে কেয়ামত অবধি এ মেহমান-নেওয়াজী চালু থাকবে ইনশাআল্লাহ।
লাখো কোটি টাকা তাঁর কদমে হাদিয়া পেশ করা হলেও দরবারের কোনো উদ্বৃত্ত তহবিল থাকতো না। মেহমান-নেওয়াজী, এতিম-মিসকিন, গরিব, মেহনতি জনগণকে অকাতরে দান, গৃহ নির্মাণ, অসংখ্য দরিদ্র পরিবারের কন্যাদের বিয়ের খরচের যোগান দিতে দেখেছি। তিনি অকাতরে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছেন যেন মানব সেবার কাজে। এর তুলনা মেলা ভার। জাগতিক কোনো বিষয়ে তাঁর কোনো শংকা ছিলোনা। তাইতো আল্লাহ্পাক কুরআনুল করিমে যথার্থই ঘোষণা করেছেন, ‘আলা ইন্না আউলিয়া আল্লাহে লা-খওফুন আলাইহিম ওয়ালাহুম ইয়াহজানুন’ (নিশ্চয় আল্লাহর ওলীগণের কোনো ভয় নাই এবং তারা চিন্তিতও নন।)
এ মহান অলি আল্লাহর সান্নিধ্যে ছুটে এসেছেন বুজর্গানেদ্বীন, পীর-মাশায়েখ, শীর্ষ ওলামায়ে কেরামসহ অসংখ্য খ্যাতনামা ব্যক্তি মন্ত্রী, এমপি, নেতা, রাজনীতিকগণ। অদ্যাবধি প্রতিদিন হাজার হাজার জিয়ারতপ্রার্থী দরবারে আসা-যাওয়া করছেন। তাই অবিলম্বে কুতুবদিয়া ধুরং-ছনুয়া রুটে ফেরি সার্ভিস চালু ও খ্যাতিমান এই মহাপুরুষের নামে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নামকরণের প্রত্যাশা আপামর জনসাধারণের। আল্লাহ আমাদেরকে বাবাজান কেবলার রূহানী ছায়াতলে থাকার তৌফিক দিন, আমীন। প্রতি বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি বাবাজান কেবলার  বার্ষিক ওরশ শরীফ কুতুবশরীফ দরবারে মহাসমারোহে অনুষ্ঠিত হই। (প্রধান দিবস ১৯ ফেব্রুয়ারি )

লেখক : প্রাবন্ধিক

Comments

comments