খবরের বিস্তারিত...


ছারছীনা পীর শাহ্‌ মুহাম্মদ ছিদ্দিক (র.) এর জীবন ও কর্ম

ছারছীনা শরীফের পীরে কামেল কুতুবুল আকতাব আলহাজ হজরত মাওলানা শাহ নেছারুদ্দীন আহমদ (র.) ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের এক মহান বুজুর্গ ব্যক্তি। তার জীবন ইতিহাস শুধু তার মুরিদদের জন্যই নয় বরং সব মানুষের জন্য এক অনন্য পাথেয়। এ বুজুর্গ ব্যক্তির বংশধারাতে আরেকজন মহান ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেন যার জীবন আলেখ্য আধুনিক ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য অনুসরণীয় হতে পারে। এ মহান ব্যক্তি ছিলেন শাহ মুহাম্মাদ ছিদ্দিক (র.)।
তিনি মেজ পীর সাহেব নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। তিনি আনুমানিক বাংলা ১৩২৯ সনে জন্মগ্রহণ করেন। বাড়ির মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর শাহ মুহাম্মাদ ছিদ্দিক (র.) বাড়ির কামিল মাদরাসা থেকে এলেম হাসিল সমাপন করেন। ১৯৪৮ সালের ৪ ডিসেম্বর বর্তমান শরিয়তপুর জেলার ডামুড্যা থানাধীন সিড্যা গ্রাম নিবাসী সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের কর্ণধার বণিক মরহুম হাজি মেছের আলী মুনসী সাহেবের প্রথমা মেয়ে মোহতারামা মোসাম্মাৎ আমেনা বেগমকে বিয়ে করেন।

ফুরফুরা শরীফের মোজাদ্দেদে জামান মুর্শিদে কামেল পীর মরহুম হজরত আবু বকর ছিদ্দিক (র.)-এর কাছ থেকে কুতুব উপাধি প্রাপ্ত শাহ মুহাম্মাদ ছিদ্দিক (র.) ছিলেন জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তি। তিনি শিক্ষা জীবনের প্রাথমিক কাল থেকেই জ্ঞানচর্চার জন্য একটি মজলিশ প্রতিষ্ঠা করেন। তার পরিচালিত এ মজলিশে তার সহপাঠীরা ছাড়াও কতিপয় পি ত বুজুর্গ ব্যক্তি সর্বদা উপস্থিত থেকে আল-কোরআন, আল-হাদিস ও ইসলামের বিধি-বিধানের জটিল সমস্যাগুলো নিয়ে জ্ঞানগর্ব আলোচনায় নিমগ্ন থাকতেন। অনেক বিজ্ঞ আলেম, অধ্যাপক, অধ্যক্ষ এ মজলিশের আলোচনায় অংশগ্রহণ করতেন এবং নানা বিষয়ে জটিল প্রশ্নগুলো উপস্থাপন করতেন। মজলিশে অংশগ্রহণকারী পি তবর্গ পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে এসব জটিল প্রশ্নের সমাধানের চেষ্টা করতেন। মজলিশ পরিচালনা করা ছাড়াও জ্ঞানপিপাসু শাহ মুহাম্মাদ ছিদ্দিক (র.) এক বিশাল লাইব্রেরি গড়ে তোলেন। বিদ্যাচর্চার পাশাপাশি ইসলাম ধর্মের অনুশাসনগুলো তিনি কঠোরভাবে পালন করতেন। তিনি ১৯৫০ সালে প্রথম হজ পালন করেন। এ ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, তিনি শুধু নিজে হজ পালন করেছেন এমন নয় অন্য মুসলিমদের হজ পালনে সহযোগিতা করেছেন। তিনি বাংলা ১৩৫৬ সনের হজ কাফেলার কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

ধর্মপ্রাণ শাহ মুহাম্মাদ ছিদ্দিক (র.) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম অবদান রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে তিনি উত্তরবঙ্গের রাজশাহীতে অবস্থান করছিলেন। রাজশাহী থেকেই তিনি বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন। দেশের এ দুর্যোগকালীন সময়ে তিনি রাজশাহীতে অবস্থান করা নিরাপদ মনে করলেন না। এ জন্য ৫-৬ জনের কাফেলা সহযোগে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন। ৬-৭ দিন ধরে পথ চলে কিছু নৌকা, কিছু ট্রলারে এবং অধিকাংশ পথ পায়ে হেঁটে চলে অবশেষে বাড়িতে পৌঁছতে সক্ষম হন।

অন্যান্য ধর্মপ্রাণ মুসলিমের মতো মেজ পীর সাহেব ছিলেন প্রথম জীবনে পাকিস্তানিদের পক্ষে। এ ক্ষেত্রে তার চিন্তাধারা ছিল যে পাকিস্তান একটি ইসলামি রাষ্ট্র। শান্তির ধর্ম ইসলামের যাবতীয় বিধান চালু থাকবে এ রাষ্ট্রে। তিনি বিশ্বাস করতেন এ রাষ্ট্রে থাকবে না কোনো অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন এবং বৈষম্যের পাহাড় পরিমাণ ব্যবধান। এ রাষ্ট্রের সব জুলুম, নির্যাতন এবং বৈষম্যের পাহাড় পরিমাণ ব্যবধান। এ রাষ্ট্রের সব মুসলমান একটি উন্নত চরিত্রের অধিকারী হিসেবে, উন্নত মুসলমান হিসেবে জীবনযাপন করবে। পৃথিবীতে একটি উন্নত জাতি হিসেবে বাঙালি মুসলমান পৃথিবীর সর্বত্র পরিচিত হবেন।

কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে তার এ স্বপ্ন মরীচিকায় পরিণত হয়। পাকবাহিনী যখন নিরীহ মানুষের প্রতি নির্মম নির্যাতন শুরু করে, মা-বোনদের সম্ভ্রম লুণ্ঠন করে, সাধারণ বাঙালি নিধনজ্ঞে মেতে ওঠে, তখন তিনি পাকিস্তান সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নেন। মাওলানা মোহাম্মদ মোস্তফা তার পীরে কামেল শাহ্ ছুফী নেছারুদ্দীন আহমদ (র.) ও ছারছীনা দরবার শরীফের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে বলেছেন, ‘পাকিস্তানের পশ্চিমা নেতাদের আচরণ দেখিতে দেখিতে মেজ পীর সাহেব শেষ পর্যন্ত চরম পাকিস্তানবিরোধী হয়ে উঠলেন। অবশেষে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন জানাইলেন ও বিভিন্ন উপায়ে সহায়তা করলেন তিনি।

মহানবী (সা.)-এর দেশপ্রেমের বাণীতে উদ্দীপ্ত হয়ে শাহ মুহাম্মাদ ছিদ্দিক (র.) দেশমাতৃকার দুর্দিনে মুক্তি-সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য-সহযোগিতায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি অনুধাবন করেতে পেরেছিলেন দেশবাসীর এ দুর্দিনে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক যোগে দেশ স্বাধীন করতে হবে। তাই তিনি তার সামার্থ্যরে মধ্য থেকে যতোটুকু সম্ভব ততোটুকু সাহায্য-সহযোগিতা মুক্তিযোদ্ধাদের করেছিলেন। স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকরা প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি সেসব নবমুসলিমের সাহায্য-সহযোগিতা করেন। নবমুসলিমদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তিনি তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যান।

প্রকৃতপক্ষে পাকবাহিনীর ইসলাম রক্ষার নামে বর্বরোচিত হামলা ও নিধনজ্ঞ মেজ পরী সাহেব পছন্দ করেননি। এ জন্য তিনি দেশপ্রেমিক নাগরিক যারা সরাসরি মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করছেন তাদের আর্থিকভাবেও সহযোগিতা করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ৯নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর জলীলের কাছে বিশ্বস্ত লোক মারফত ২ হাজার) টাকা পাঠান। তিনি টাকা প্রেরণ করে মেজর সাহেবের কাছে এ ফরিয়াদ পাঠান, আমি একজন গরিব মানুষ, অগাধ ধন-সম্পত্তির মালিক নই, তাবলিগি ছফর করে হাদিয়া তোহফা যা কিছু পাই তা দ্বারাই জীবনযাপন করি। দেশ স্বাধীন ও মুক্ত করার কাজে আপনার সঙ্গে একত্মতা প্রকাশ করার জন্য যৎসামান্য আর্থিক অনুদান আপনার কাছে পাঠালাম। আশা করি তা সাদরে গ্রহণ করিবেন এবং আমার জন্য দোয়া করবেন, আমিও আপনার জন্য, আপনার সঙ্গী-সাথীদের জন্য দোয়া তথা দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য দোয়া করি। যতোটুকু জানা যায়, মেজর জলীল মেজ পীর ছাহেব কেবলার এ অনুদান এবং ফরিয়াদ অত্যন্ত গুরুত্ব ও আগ্রহের সঙ্গেই গ্রহণ করেছিলেন।

তিনি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদেরও সহযোগিতা করেন। ফলে ছারছীনা দরবার শরীফের প্রতি রাজকারদের দৃষ্টি পড়ে। তারা নানাভাবে ছারছীনার মেজ পরী সাহেবকে নাজেহাল করতে থাকেন। এসব হামলার মোকাবিলা মেজ পীর সাহেব অপরিসীম ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে মোকাবিলা করেন। উপরন্তু তিনি আগের মতোই মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সহযোগিতা অব্যাহত রাখেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার আর একটি উল্লেখযোগ্য অবদান আজও মুক্তিযোদ্ধা ও ছারছীনা দরবার ভক্তিভরে স্মরণ করে। তার আপ্রাণ প্রচেষ্টাতে ছারছীনা দরবার শরীফ রক্ষা পেয়েছিল। কারণ গদিনশীন পীর আল্লামা শাহ আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর। তিনি ছিলেন পুরোপুরি শাহ মুহাম্মাদ ছিদ্দিক (র.)-এর বিপরীত। ফলে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের কোপনলে তিনি পতিত হন। এমতাবস্থায় মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থনকারী শাহ মুহাম্মাদ ছিদ্দিক (র.) স্থানীয় রাজাকার ও ছারছীনাতে অবস্থানকারী পাকবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর মধ্যে সমঝোতা করেন। ফলে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমপর্ণ করেন। এভাবে ছারছীনা দরবার শরীফ রক্ষা পায় মুক্তিবাহিনীর রোষানল থেকে।

দেশপ্রেমিক মেজ পীর মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ গঠনে মনোনিবেশ করেন। তিনি শিক্ষা-দীক্ষার প্রসারে উদ্যোগী হন। তিনি যেসব ছাত্র-শিক্ষক ছারছীনা ছেড়ে চলে গেয়েছেন তাদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ছারছীনা মাদরাসা ও লিল্লাহ বোডিং পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তিনি লিল্লাহ বোডিংয়ে ছাত্রদের থাকা ও বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা করে দেন। তিনি মাদরাসা পরিচালনা করার পাশাপশি দীন ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত তাবলিগ ও হেদায়েতের দাওয়াত দেয়ার জন্য ভ্রমণ করেন। এভাবে তিনি দেশ, জনগণ ও ইসলামের সেবায় নিজেকে সর্বদা নিয়োজিত রেখেছিলেন। এ মহান ব্যক্তি বাংলার পথে-ঘাটে শহর-বন্দরে তাবলিগের দাওয়াত আহ্বান করতে করতে অবশেষে ১৯৮৯ সালের ২৯ জানুয়ারি বোরবার তাবলিগি ছফর অবস্থায়ই ‘নূরে ছারছীনা’ নামক তার নিজস্ব তাবলিগি লঞ্চে অবস্থানরত অবস্থায় বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন এলাকার গলাচিপা বন্দরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এভাবে এক কীর্তিমানে পুরুষের জীবন প্রদীপ থেমে যায়। কিন্তু তিনি দেশ ও জনগণ এবং ইসলামের খেদমতে নিজেকে যেভাবে নিয়োজিত রেখেছিলেন তার জন্য আজও লাখ লাখ ভক্ত অনুরাগী তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।

Comments

comments