খবরের বিস্তারিত...


ছারছীনা দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা পীরে কামেল শাহ সূফী নেছারুদ্দীন আহমদ (র:) এর জীবনী

জন্ম ও বংশ পরিচয়:
বাংলা ১২৭৯ সাল মোতাবেক ইংরেজি ১৮৭৩ সালে (বর্তমান) বাংলাদেশের বাকেরগঞ্জ জেলার (বর্তমান পিরোজপুর) নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠী) উপজেলার কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়া সন্ধ্যা নদীর তীরে অবস্থিত মাগুরা (বর্তমানে ছারছীনা গ্রামে) মুসলিম সমাজের এক ক্লান্তিলগ্নে এক আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে হাদী হিসেবে আবির্ভূত হলেন বাংলার গৌরব, ভাগ্যবান মহাপুরুষ, ওলীকুল শিরোমণি, মুজাদ্দিদে যামান- হযরত মাওলানা শাহ সূফী নেছারুদ্দীন আহমদ রহ.। পিতার নাম মরহুম হাজী সদর উদ্দীন এবং মাতার নাম মরহুমা জোহোরা বেগম।
ইলমে শরীয়ত অর্জন:
 হযরত পীর সাহেব কেবলা বার বছর পর্যন্ত পিতামাতার কাছেই ইলমে দীন শিক্ষা করেন। চৌদ্দ বছর বয়সে তাঁর পিতা হজ্জ আদায় করতে গিয়ে সেখানেই ইন্তেকাল করেন। এরপরে কিছুদিন তাঁর সৎ চরিত্রা উন্নতমনা মহিয়সী জননীর কাছে ইলমে দীন শিক্ষা করেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর মায়ের দোয়া নিয়ে মাদারীপুরে এক মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখান থেকে শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি ঢাকায় আহমদিয়া মাদ্রাসায় (বর্তমান হাম্মাদিয়া স্কুল, নয়াবাজার) ভর্তি হয়ে কিছুদিন অধ্যায়ন করে, চলে যান কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায়। এরপরে হুগলী মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে পড়াশুনা করেন। বৃত্তি সহকারে সেখান থেকে ১৮৯৬ খ্রিস্টব্দে ফাজিল (তৎকালীন মাদ্রাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি) লাভ করেন এবং ইলমে হাদীসের গভীর পান্ডিত্য অর্জন করেন। ইলমে তাছাউফ অর্জন: পীরে কামেল আল্লামা নেছারুদ্দীন আহমদ রহ. ছোট বেলা থেকেই মহান আল্লাহ তা’য়ালার নৈকট্য লাভ করার জন্য সর্বদা ধ্যানমগ্ন থাকতেন। আল্লাহ তা’য়ালাও দয়া পরবশ হয়ে ছাত্র অবস্থাতেই তাকে সে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন। হুগলী মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত অবস্থায় ফুরফুরা শরীফের পীর শাহ সূফী আবূ বকরছিদ্দীক রহ. এর সাথে হঠাৎ করে এক জলসায় তার সাক্ষাত হয় এবং তার সান্নিধ্য লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। ফুরফুরার মহান ওলী মুজাদ্দেদে যামান র. নিজে সাগ্রহে তাঁকে বায়আত করান, পরম ¯েœহ তরীকতের তালীম প্রদান করতে থাতেন, মূলত দয়াময় প্রভুর মদদ তাঁর ওপর এত প্রবল ছিলো যে, তা লক্ষ্য করেই তার পীর সাগ্রেহে তাঁকে কাছে ডেকে নেন। পীরের হাতে হাত রেখে বাইয়াত গ্রহণ করে নিয়মিত তরীকা চর্চা করে অল্প দিনেই তিনি চার তরীকায় কামালাত নিয়ে চলে এলেন বাংলায়। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত তিনি তাঁর মোর্শেদ এর কাছে থেকেছেন।
বিবাহ ও আওলাদ:
হযরত পীর সাহেব কেবলা সর্বমোট তিনটি বিবাহ করেন। তাঁর প্রথম বিবাহ ছিল স্থানীয় সিকদার পরিবারে। এই ঘরে তাঁর দুই ছেলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রথমা স্ত্রী ইন্তেকাল করার পর দ্বিতীয় বিবাহ করেন ফরিদপুরের কুশলা গ্রামে। এই ঘরে তার তিন ছেলে ও ছয় কন্যা- সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি আরো একটি বিবাহ করেছিলেন এবং সেই ঘরে কেবলমাত্র একটি কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মরহুম শাহ আবূ জাফর মুহাম্মদ ছালেহ রহ. ছিলেন দ্বিতীয় ঘরের সন্তান।
তাবলীগ ও হেদায়াত:
মোর্শেদের কাছ থেকে অনুমতি পেয়ে দেশে ফিরে মঠবাড়িয়া হতে তিনি তার দাওয়াত কাজ শুরু করেন। তিনি তার সারাটি জীবন এ কাজে ব্যয় করেছিলেন। হাদীসের আলোকে তাবলীগে দীনের জন্য এক ব্যাপক কর্ম পন্থা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। কেবল ওয়াজ নসীহত করেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ছারছীনা দারুস্সুন্নাত আলীয়া মাদ্রাসা’সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদ্রাসা মকতব, খানকাহ, মসজিদ।
সমাজ সেবা:
হযরত পীর সাহেব কেবলার যেমনি নাম ছিল নেছারুদ্দীন, তেমনি তিনি ছিলেন ধর্ম ও সমাজের জন্য উৎসর্গকৃত। ধর্ম ও সমাজের জন্য তিনি অসংখ্য প্রতিষ্ঠান কায়েম করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ছারছীনা দারুস্সুন্নাত আলীয়া মাদ্রাসা, লিল্লাহ বোডিং, কুতুবখানা, হেমায়েতে ইসলাম ফান্ড, এহইয়ায়ে সুন্নাত তহবিল, মক্কা- মদীনা শরীফ রিলিফ তহবীল ও মুসাফির খানা, সাধারণ দান তহবিল, পঞ্চগ্রাম সাহায্য সমিতি, বরিশালের লংগরখানা (১৩৫০),বার্ষিক ঈসালে সওয়াব মাহফিল, সিদ্দিকীয়া ফান্ড ও সিলেট রেফারেন্ডাম।
পুস্তক প্রণয়ন:
সকল বিদয়াতী ও গোমরাহী মতবাদের মোকাবিলা করতে পুস্তক প্রণয়ন আবশ্যক। এ সত্যটি বুঝতে পেরে তিনি অনেকগুলো বই লিখেছেন। তার লিখিত পুস্তকসমূহ হলো- তরীকুল ইসলাম (চৌদ্দ খ-), ইজহারুল হক (জুমার বাহাছ), মোসলেম রতœহার, নূরুল হেদায়েত, মাছায়েলে আরবায়া, তা’লীমে মা’রেফাত, জুমার সংক্ষপ্ত দলীল, গঞ্জেহক্ব, ফুটবলের ফতোয়া, নসবনামা, অসীয়ত নামা, দাঁড়ি ও ধুমপান, মজহাব ও তকলীদ, জামেউল উসূল, সমাজ দর্পণ, পীর- মুরীদি দ্বীধাভঞ্জন, আল-জুমুআ, মাসায়েলে ছালাছা, নারী ও পর্দা ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি শেষবার হজ্জে যাওয়ার সময় ‘তাবলীগ’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করে যান।
সংগঠন প্রতিষ্ঠা:
কুরআন ও হাদীসের আলোকে সকলকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার জন্য ১৯৪৩ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন “আঞ্জুমানে আল ইসলাম” নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। কিছুদিন পরে এর নাম রাখা হয় ‘হিযবুল্লাহ জমইয়াতুল মুজাহেদীন”। ১৯৫০ সালে এর নাম পুন:পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘পাকিস্তান জমিয়তে হিযবুল্লাহ’ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নাম রাখা হয় ‘বাংলাদেশ জমইয়তে হিযবুল্লাহ’। আর অঙ্গ সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘জমইয়তে তোলাবায়ে হিযবুল্লাহ’ । ১৯৮৭ সনে আধুনিকায়ন করে নাম রাখা হয় ‘বাংলাদেশ ছাত্র হিযবুল্লাহ’।
হজ্জব্রত পালন: 
হযরত পীর সাহেব কেবলা মোট তিনবার হজ্জ পালন করেন। প্রথমবার বাংলা ১৩০৮ সালে (১৯০১-০২ইং) স্ব- পরিবারে হজ্জ আদায় করেন। এরপরে মধ্যবয়সে একবার এবং বাংলা ১৩৫২ সনে ১৪০১ জন সঙ্গী নিয়ে শেষ হজ্জ পালন করেন।
ইবাদত বন্দেগী
হযরত পীর সাহেব কেবলা প্রায় সব সময়ই ইবাদত বন্দেগীতে কাটিয়ে দিতেন। ফরয ও ওয়াজিবতো আদায় করতেনই, নফল ইবাদতেও তিনি এত মশগুল থাকতেন যে, মনে হত যেন তিনি কেবল এ কাজের জন্যই দুনিয়াতে এসেছিলেন। অসুস্থ থাকা অবস্থায়ও তিনি নফল নামাজ, রোজা, কুরআন শরীফ তেলাওয়াত, ওজীফা পাঠ, মোরাকাবা-মোশাহা দা নিয়মিত করতেন।
জীবন যাপন:
হযরত পীর সাহেব কেবলা সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতেন। সাধারণ কাপড়ের কল্লীদার জামা- পায়জামা অথবা সেলাই বিহীন লুঙ্গী এবং পাগড়ী পরিধান করতেন। অন্তিমকাল:
বিধাতার অমোঘ বিধান মেনে সকলের এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে পরকালের উদ্দেশ্যে। হযরত পীর সাহেব কেবলাও এই নিয়মানুযায়ী ১৯৫২ সালের ১ফেব্রুয়ারী, বাংলা ১৩৫৮ সালের ১৮ মাঘ, হিজরীর ১৩৭১সনে ৪ জুমাদিউল আউয়াল রোজ বৃহস্পতিবার রাত নয়টা পয়তাল্লিশ মিনিটে বিশ্ববাসীকে কাঁদিয়ে মাহবুবের ডাকে সারা দিয়ে রফীকে আ’লার কাছে চলে গেলেন। [নেছারুদ্দীন র. এর জীবনী, মুহাম্মদ আব্দুল বারী খন্দকার / নেছারুদ্দীন আহমদ র. একটি জীবন, একটি আদর্শ / বংলাদেশের সূফী সাধক, ইফাবা]

Comments

comments