আসুন জেনে নিন। রাস্তার হক্ সম্পর্কে ইসলাম কি বলে
রাস্তা দিয়ে আমরা প্রতিনিয়তই যাতায়াত করি; কিন্তু অধিকারগুলো কি আদায় করি?
بِسْمِ اللَّهِ، وَالصَّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ
বিসমিল্লা-হি ওয়াসসালাতু; ওয়াসসালা-মু ‘আলা রাসূলিল্লা-হি [আল্লাহ্র নামে (শুরু করছি), সালাত ও সালাম আল্লাহ্র রাসূলের উপর বর্ষিত হোক]
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এমন দ্বীন দান করেছেন, যা শুধু কিছু ইবাদত-আকীদার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। এর বিধানাবলী জীবনের সকল বিষয়কে বেষ্টন করে। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের যত ধাপ ও স্তর সবক্ষেত্রেই রয়েছে ইসলামের শিক্ষা ও নির্দেশনা। ফলে একজন মুসলিম জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে হেদায়েত গ্রহণ করতে পারে এবং তা মেনে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী জীবন যাপন করতে পারে।
এই নিবন্ধে পথ ও পথিকের হকের বিষয়ে ইসলামের কিছু নির্দেশনা তুলে ধরা হচ্ছে।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إِيَّاكُمْ وَالجُلُوسَ عَلَى الطُّرُقَاتِ، فَقَالُوا: مَا لَنَا بُدٌّ، إِنَّمَاهِيَ مَجَالِسُنَا نَتَحَدَّثُ فِيهَا، قَالَ: فَإِذَا أَبَيْتُمْ إِلَّاالمَجَالِسَ، فَأَعْطُوا الطَّرِيقَ حَقَّهَا، قَالُوا: وَمَا حَقُّالطَّرِيقِ؟. قَال: غَضُّ البَصَرِ، وَكَفُّ الأَذَى، وَرَدُّ السَّلاَمِ،وَالأَمْرُ بِالْمَعْرُوفِ، وَالنَّهْيُ عَنِ المُنْكَرِ.
তোমরা রাস্তার পার্শে বসে থেকো না। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমাদের তো এর প্রয়োজন হয়। পরস্পরে প্রয়োজনীয় কথা বলতে হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বসতেই যদি হয় তবে রাস্তার হক আদায় করে বস। সাহাবীগণ বললেন, আল্লাহর রাসূল! রাস্তার হক কী?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, রাস্তার হক হল-
১. দৃষ্টিকে অবনত রাখা।
২. কাউকে কষ্ট না দেওয়া।
৩. সালামের জবাব দেওয়া।
৪. সৎ কাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজ হতে বিরত রাখা। [সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ ৪৬/ অত্যাচার, কিসাস ও লুণ্ঠন (كتاب المظالم), হাদিস নম্বরঃ ২৪৬৫, পরিচ্ছেদঃ ৪৬/২২. ঘরের আঙিনা এবং সেখানে রাস্তায় বসা। আরো দেখুনঃ হাদীস নম্বর ৬২২৯; (আধুনিক প্রকাশনীঃ ২২৮৬, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ২৩০৩)]
বিভিন্ন বর্ণনায় আরো কিছু বিষয় এসেছে। যেমন-
৫. পথহারাকে পথ দেখিয়ে দেওয়া।
৬. মযলুম ও বিপদগ্রস্তের সাহায্য করা।
৭. বোঝা বহনকারীকে (বোঝা উঠানো বা নামানোর ক্ষেত্রে) সহযোগিতা করা।
৮. ভালো কথা বলা।
৯. হাঁচির জবাব দেয়া। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নম্বর ৪৮১৯; মুসনাদে বাযযার, হাদীস নম্বর ৫২৩২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নম্বর ২১৬১; মুসনাদে আবি ইয়ালা, হাদীস নম্বর ৬৬০৩]
১০. দম্ভভরে না চলা (বিনয় অবলম্বন করা)। [কুরআন মাজীদ, সূরা বনী ইসরাঈল (ইহুদী জাতি)/ ইসরা (উর্ধ্বগমন), সূরা নম্বর ১৭, আয়াত নম্বর ৩৭, মক্কায় অবতীর্ণ]
প্রথম নির্দেশনাঃ
রাস্তায় বসো না, কারণ এতে যাতায়াতকারীদের কষ্ট হয়। রাস্তা তো বৈঠকখানা নয়; চলাচল করার জন্য।
কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সাহাবায়ে কেরামের অপারগতা দেখলেন, হক আদায় করার শর্তে প্রয়োজন পরিমাণ বসার অনুমতি দিলেন।
প্রথম হকঃ দৃষ্টি অবনত রাখা
সেই হকের একটি হচ্ছে, নযরের হেফাজত। যে ব্যক্তি রাস্তায় চলবে বা দাঁড়াবে কিংবা বসবে সে নজর নিচু রাখবে। কারণ রাস্তায় বেগানা নারী যাতায়াত করবে, নাজায়েয দৃশ্য নজরে পড়তে পারে। এসব থেকে নজরের হেফাজত করবে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
قُلْ لِّلْمُؤْمِنِیْنَ یَغُضُّوْا مِنْ اَبْصَارِهِمْ وَ یَحْفَظُوْافُرُوْجَهُم ذٰلِكَ اَزْكٰی لَهُمْ اِنَّ الله خَبِیْرٌۢ بِمَا یَصْنَعُوْنَ
মুমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য উৎকৃষ্ট পন্থা। তারা যা কিছু করে আল্লাহ সে সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবগত। [কুরআন মাজীদ, সূরা আন-নুর (আলোক), সূরা নম্বর ২৪, আয়াত নম্বর ৩০, মদীনায় অবতীর্ণ, বাংলা অনুবাদঃ মুহিউদ্দিন খান]
নারীদের ব্যাপারে বলেছেন-
وَ قُلْ لِّلْمُؤْمِنٰتِ یَغْضُضْنَ مِنْ اَبْصَارِهِنَّ وَ یَحْفَظْنَفُرُوْجَهُنَّ وَ لَا یُبْدِیْنَ زِیْنَتَهُنَّ .
এবং মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন দৃষ্টি অবনত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে এবং নিজেদের ভূষণ প্রকাশ না করে।…………… [কুরআন মাজীদ, সূরা আন-নুর (আলোক), সূরা নম্বর ২৪, আয়াত নম্বর ৩০, মদীনায় অবতীর্ণ, বাংলা অনুবাদঃ মুহিউদ্দিন খান]
এই দুই আয়াতে আল্লাহ তাআলা নারী ও পুরুষদের আলাদাভাবে সম্বোধন করেছেন। যাতে তারা যথাযথভাবে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে। অন্যান্য আহকামের ক্ষেত্রে সাধারণত নারী-পুরুষকে একত্রে সম্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু এই হুকুমের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা নারী-পুরুষকে ভিন্ন ভিন্ন সম্বোধনে উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা বিষয়টির গুরুত্ব বোঝা যায়। এর উপর আমল করলে অসংখ্য গুনাহ থেকে বাঁচা যাবে ইন-শা-আল্লাহ।
চোখের গুনাহের একটি বড় কারণ
অনেক নারী সেজেগুজে বেপর্দা হয়ে বের হয়, ফলে সে নিজেও গুনাহগার হয়, অন্যের গুনাহেরও কারণ হয়। পরপুরুষের সাথে পর্দা করা ফরজ। এই ফরজ ত্যাগ করা নামায, রোযা, হজ্ব বা যাকাত ত্যাগ করার মতই কবিরা গুনাহ। নামায-রোযা ছাড়লে শুধু নিজে গুনাহগার হয়, কিন্তু পর্দা না করলে নিজেও গুনাহগার হয় সাথে অসংখ্য মানুষেরও গুনাহের কারণ হয়। এ জন্য ঘর থেকে বের হতে হলে শরয়ী পর্দার সাথে ঘর থেকে বের হওয়া প্রত্যেক মুসলিম নারীর জন্য ফরজ। এই ফরজ আদায় করা হলে অনেক মানুষ চোখের গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে।
কুদৃষ্টি গুনাহের প্রথম ধাপ। যদি প্রথমেই নজর নিচু করে নেয়া হয়, সামনের সকল গুনাহ হতে বেঁচে যাবে। আর যদি আল্লাহ না করুন প্রথমেই সর্তকতা অবলম্বন না করে তখন একটি গুনাহ থেকে আরেকটি গুনাহ, এভাবে অসংখ্য গুনাহের ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে যায় এবং একপর্যায়ে শয়তান চরম গুনাহে পৌঁছে দেয়।
দ্বিতীয় হক : কাউকে কষ্ট না দেওয়া
রাস্তায় দাঁড়ানো বা বসা ব্যক্তির খেয়াল রাখা উচিত, যেন তার দ্বারা কোনো চলাচলকারীর সামান্য কষ্টও না হয়।
কষ্ট দেওয়ার বিভিন্ন পন্থা
এমনভাবে দাঁড়ানো বা বসা যে যাতায়াতকারীর কষ্ট হয়। কিংবা রাস্তায় গাছের গুড়ি ফেলা, টায়ার জ্বালানো, অহেতুক রাস্তা বন্ধ করা, ফলের খোসা, ময়লা, উচ্ছিষ্ট খাবার ফেলা আল্লাহ রক্ষা করুন পানের পিক ফেলা, দুর্গন্ধ ছড়ায় এমন কোনো জিনিস ফেলে রাখা সবই কষ্ট দেওয়ার নানা উপায়। তেমনি ফুটপাতে বা রাস্তায় হকার মার্কেট বসানো, যার কারণে চলাচলের পথ সংকীর্ণ হয়ে যায় এটিও কষ্ট দেওয়ার অন্তর্ভুক্ত।
(দোকানের) সীমানা বাড়ানো কষ্টদায়ক
দোকানের সীমানা বাড়াতে বাড়াতে রাস্তার মধ্যে চলে যাওয়া, যে কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় বা সংকীর্ণ হয়ে যায়। এটিও পথিকের কষ্টের কারণ।
আমাদের বাজারগুলোতে দেখা যায়, দোকানের অর্ধেক ভেতরে আর অর্ধেক বাইরে ফুটপাতে। মনে হয় যেন ফুটপাত দোকানদারের হক! অথচ সবাই জানে এটি দোকানের অংশ নয়; ক্রেতাদের জন্য বানানো হয়েছে, যাতে যাতায়াত সহজ হয়। কিন্তু এখন ফুটপাতই দোকান বনে গেছে। অনেকে তো ফুটপাতে ঘর বানিয়ে শাটার লাগিয়ে রীতিমত মার্কেট বানিয়ে ফেলে।
যাদের দোকান নেই তারা ফুটপাত দখল করে ভ্যান দাঁড় করিয়ে দোকান খুলে বসে। এতে রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যায়। অথচ এটি সরকারীভাবে নিষিদ্ধ। আইন থাকতেও আমাদের এই অবস্থা। এ কারণে বাজারে আসা-যাওয়ার সময় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
একটি হুকুমের উপর আমল না করার কারণে সকল মুসলমান কষ্ট পাচ্ছে। আমরা যদি রাস্তার এই হক বুঝে এর উপর আমল করি, তাহলে আমাদের রাস্তাগুলো প্রশস্ত হয়ে যাবে, চলাচলে কষ্ট হবে না।
ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা
রাস্তা বন্ধ করে কষ্ট দেওয়া তো দূরের কথা রাস্তায় কোনো কষ্টদায়ক জিনিস দেখলে ঈমানের দাবি হল তা সরিয়ে দেওয়া, এটি ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
باب بَيَانِ عَدَدِ شُعَبِ الْإِيمَانِ وَأَفْضَلِهَا وَأَدْنَاهَا وَفَضِيلَةِ الْحَيَاءِ وَكَوْنِهِ مِنْ الْإِيمَانِ حَدَّثَنَا عُبَيْدُ اللَّهِ بْنُ سَعِيدٍ، وَعَبْدُ بْنُ حُمَيْدٍ، قَالاَ حَدَّثَنَا أَبُو عَامِرٍ الْعَقَدِيُّ، حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ بِلاَلٍ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ دِينَارٍ، عَنْ أَبِي صَالِحٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ “ الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ شُعْبَةً وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنَ الإِيمَانِ ”
আবূ হুরাইরাহ (রাদ্বিঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ঈমানের শাখা সত্তরটিরও কিছু বেশি। অথবা ষাটটির কিছু বেশি। এর সর্বোচ্চ শাখা হচ্ছে (আল্লাহ ব্যতীত প্রকৃত কোন ইলাহ নেই) এ কথা স্বীকার করা, আর এর সর্বনিম্ন শাখা হচ্ছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা। আর লজ্জা ঈমানের একটি বিশেষ শাখা। [সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ ১। ঈমান (বিশ্বাস) (كتاب الإيمان), হাদিস নম্বরঃ ৫৯, পরিচ্ছেদঃ ১২. ঈমানের শাখা-প্রশাখার সংখ্যা, তার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন শাখার বর্ণনা, লজ্জা শরমের ফায়ীলাত এবং তা ঈমানের অঙ্গ হওয়ার বর্ণনা। (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৬০, ইসলামিক সেন্টারঃ ৬১)]
আরেক রেওয়ায়েতে আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু যর গিফারী রা.-কে নসীহত করেন; তার মাঝে একটি উপদেশ ছিল
وَإِمَاطَتُكَ الحَجَرَ وَالشَّوْكَةَ وَالعَظْمَ عَنِ الطَّرِيقِ لَكَصَدَقَةٌ.
রাস্তা থেকে পাথর, কাঁটা, হাড্ডি সরানোও সদাকা। [জামে তিরমিযী, হাদীস নম্বর ১৯৫৬]
মুমিনের কাছে ঈমানের ন্যূনতম দাবি হল, সে যখন রাস্তায় চলবে কষ্টদায়ক কিছু দেখলে সরিয়ে দেবে। হতে পারে এই ওসীলায় সে নাজাত পেয়ে যাবে।
রাস্তা থেকে কাঁটাদার গাছ কাটার পুরস্কার
এই ঘটনা একাধিক হাদীসে এসেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি এক ব্যক্তিকে জান্নাতের গালিচায় গড়াগড়ি খেতে দেখলাম (অর্থাৎ শান্তি ও আরামের সাথে সুখময় জীবন কাটাচ্ছে)। মানুষের চলাচলের পথে একটি গাছ ছিল, যার কারণে চলাচলে কষ্ট হচ্ছিল। এ ব্যক্তি তা কেটে দিয়েছিল। (ফলে আল্লাহ খুশি হয়ে তাকে জান্নাতে দাখেল করেন।) [সহীহ মুসলিম, হাদীস নম্বর ১৯১৪]
কোনো বড় আমলের কারণে নয়; বরং মানুষের যাতায়াতের রাস্তায় একটি কাঁটাদার গাছ ছিল, এ ব্যক্তি সেটি কেটে দিয়েছিল, যাতে পথিকের পথ চলা নির্বিঘ্ন হয় এই আমলের বরকতেই আল্লাহ তাকে জান্নাতে পৌঁছে দিয়েছেন।
আমরা রাস্তায় চলার সময় কত কষ্টদায়ক বস্তু নজরে পড়ে, কিন্তু আমরা মনে করি এটা তো সরকারের কাজ, তারা করবে। ঠিক আছে তাদের করা উচিত, কিন্তু আমরা মুসলমান সুতরাং এটা আমাদেরও দায়িত্ব। কারণ এটি ঈমানের দাবি।
গাড়ি পার্কিংয়ের দ্বারা মানুষকে কষ্ট দেওয়া
রাস্তায় কষ্টদায়ক কাজের মধ্যে সাইকেল, মোটর সাইকেল, গাড়ি পার্ক করাও শামিল। আমরা নিষিদ্ধ জায়গায় গাড়ি পার্ক করব না। আর যেখানে অনুমতি আছে সেখানেও এমনভাবে করব, যেন অন্য গাড়িওয়ালাদের কষ্ট না হয়। অনেক সময় আমরা কারো দোকানের সামনে এমনভাবে গাড়ি রাখি যে, দোকান বন্ধ হয়ে যায়। গ্রাহক আসতে পারে না বা আসতে কষ্ট হয়। আমি তো গাড়ি রেখে চলে গেলাম, দোকানদার কিছু বলতে পারল না বা কাজে ব্যস্ত ছিল, পরে পেরেশান হল। এভাবে যাতায়াতের রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করানো হতে বেঁচে থাকব।
গাড়ি চালানোর সঠিক পদ্ধতি
হযরত ডা. হাফিজুল্লাহ ছাহেব রাহ. বলেন, মুফতী মুহাম্মাদ হাসান রাহ.-এর একজন খাদেম ছিলেন বাঁট সাহেব। তিনি বলেন, আমার প্রতিদিনের রুটিন ছিল মুফতী ছাহেবকে গাড়িতে করে বাড়ি থেকে মাদরাসায় নিয়ে যাওয়া ও বাড়িতে নিয়ে আসা। একবার মুফতী ছাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি গাড়ি চালাতে পার? হযরতের এ প্রশ্ন শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম, কী জবাব দিব? চিন্তা করতে লাগলাম, প্রতিদিন হযরতকে নিয়ে আসা যাওয়া করি, আর তিনি বলছেন গাড়ি চালাতে পারি কি না! ভয়ে ভয়ে বললাম, কিছু কিছু পারি। আপনি বলে দিন কীভাবে চালাতে হয়। তিনি বললেন, ‘এমনভাবে চালাতে হয় যেন কোনো মানুষ ও প্রাণী কষ্ট না পায়’।
এভাবে গাড়ি চালাবে যে, কুকুর বিড়াল সামনে দিয়ে গেলে তাদেরও পেরেশানি না হয়।
তৃতীয় হক : সালামের জবাব দেওয়া
রাস্তার তৃতীয় হক وَرَدُّ السَّلاَمِ সালামের জবাব দেওয়া-
সালামের সাধারণ নিয়ম হল, আরোহী ব্যক্তি পায়েহাঁটা ব্যক্তিকে আর হেঁটেচলা ব্যক্তি বসা ব্যক্তিকে সালাম দিবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
يُسَلِّمُ الرَّاكِبُ عَلَى المَاشِي، وَالمَاشِي عَلَى القَاعِدِ،وَالقَلِيلُ عَلَى الكَثِيرِ.
আরোহী পায়দলকে, পায়দল উপবিষ্টকে ও অল্প মানুষ বেশি মানুষকে সালাম দিবে। [সহীহ বুখারি, হাদীস নম্বর ৬২৩২; সহীহ মুসলিম, হাদীস নম্বর ২১৬০]
আরেক রেওয়ায়েতে আছে-
يُسَلِّمُ الصَّغِيرُ عَلَى الْكَبِيرِ وَالْمَاشِي عَلَى القاعدوالقليل على الكثير.
ছোট বড়কে, গমনকারী উপবেশনকারীকে ও কমসংখ্যক বেশি সংখ্যককে সালাম দিবে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নম্বর ৬২৩২]
রাস্তায় বসা অবস্থায় থাকলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালামের জবাব দিতে বলেছেন। কারণ সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, হেঁটে চলা মানুষ উপবিষ্টকে সালাম দিবে। তাহলে বসা ব্যক্তির দায়িত্ব সালামের জবাব দেওয়া।
সালামের বিভিন্ন স্তর
এক হাদীসে আছে, এক ব্যক্তি একদিন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসে এসে বলল, السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ নবীজী জবাব দিয়ে বললেন, তার দশ নেকি লেখা হয়েছে। এরপর আরেক ব্যক্তি এসে বললেন,
السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ
নবীজী জবাব দিয়ে বললেন, তার জন্য বিশ নেকী লেখা হয়েছে। এরপর আরেকজন এসে বলল,
السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ
নবীজী জবাব দিয়ে বললেন, তার জন্য ত্রিশ নেকী লেখা হয়েছে। [জামে তিরমিযী, হাদীস নম্বর ২৬৮৯]
বেশি বেশি সালাম দেওয়া
সালামের ফায়েদা অনেক বেশি। দুনিয়াতে ও আখিরাতে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
আবূ হুরাইরাহ (রাদ্বিঃ) বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ঈমানদার ছাড়া কেউই জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, আর তোমরা ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না একে অন্যকে ভালোবাসবে। আমি কি তোমাদের তা বলে দিব না, কি করলে তোমাদের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসার সৃষ্টি হবে? তা হলো, তোমরা পরস্পর বেশি সালাম বিনিময় করবে*। [গ্রন্থঃ সহীহ মুসলিম (হাঃ একাডেমী), অধ্যায়ঃ ১। ঈমান (বিশ্বাস) (كتاب الإيمان), হাদিস নম্বরঃ ৯৮ (ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১০০, ইসলামিক সেন্টারঃ ১০২)]
* প্রথমে ঈমান আনতে হবে, তারপর মুসলিম ব্যক্তি পরিচিত হোক আর না হোক সালাম বিনিময় করবে, সালাম বিনিময় ঈমান লাভের উপকরণ।
আরেক রেওয়ায়েতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
وَتَقْرَأُ السَّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ.
পরিচিত-অপরিচিত সবাইকে সালাম দিবে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নম্বর ৬৫]
হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِذَا لَقِيَ أَحَدُكُمْ أَخَاهُ فَلْيُسَلِّمْ عَلَيْهِ، فَإِنْ حَالَتْ بَيْنَهُمَاشَجَرَةٌ أَوْ جِدَارٌ أَوْ حَجَرٌ ثُمَّ لَقِيَهُ فَلْيُسَلِّمْ عَلَيْهِ أَيْضًا.
কারো সাথে তার (মুসলিম) ভাইয়ের দেখা হলে তাকে সালাম দিবে। যদি তাদের মাঝে কোনো গাছ, দেয়াল বা (বড়) পাথর আড়াল হয় এবং আবার দেখা হয় তাহলে (আবার) সালাম দিবে। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নম্বর ৫২০০]
চতুর্থ হক : সৎ কাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা
এ এমন এক আমল, যা প্রত্যেক মুমিন ও মুসলমানের জন্য সর্বদা জরুরি। বিশেষত রাস্তা-ঘাটে। কারণ সেখানেই সব শ্রেণীর মানুষের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। তাই ‘সৎ কাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা’কে বিশেষভাবে রাস্তার হকের মাঝে গণ্য করা হয়েছে।
হযরত হামযা ইবনে আবু উসাইদ রাহ. তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন-
أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ:وَهُوَ خَارِجٌ مِنَ الْمَسْجِدِ فَاخْتَلَطَ الرِّجَالُ مَعَ النِّسَاءِفِي الطَّرِيقِ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَلِلنِّسَاءِ: اسْتَأْخِرْنَ، فَإِنَّهُ لَيْسَ لَكُنَّ أَنْ تَحْقُقْنَ الطَّرِيقَعَلَيْكُنَّ بِحَافَّاتِ الطَّرِيقِ فَكَانَتِ الْمَرْأَةُ تَلْتَصِقُبِالْجِدَارِ حَتَّى إِنَّ ثَوْبَهَا لَيَتَعَلَّقُ بِالْجِدَارِ مِنْ لُصُوقِهَابِهِ
একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদ থেকে বের হয়ে দেখতে পেলেন, রাস্তায় নারী-পুরুষ মিলেমিশে চলাফেরা করছে, তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা পুরুষের পরে যাও। তোমাদের জন্য রাস্তার মাঝভাগে দিয়ে চলাচল করা উচিত নয়। বরং তোমাদের উচিত পথের একপাশ দিয়ে চলাচল করা। হযরত আবু উসাইদ রা. বলেন, এরপর থেকে মহিলারা এতই দেয়াল ঘেষে চলতেন যে, তাদের কাপড় দেয়ালের সাথে ঘষা খেত। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নম্বর ৫২৭২]
আর এটা শুধু রাস্তায় চলার আমলই নয়, বরং সব অবস্থায়ই এটি মুমিনের দায়িত্ব; কোনো অন্যায় দেখলে সাধ্যমত তা দূর করার চেষ্টা করা।
পঞ্চম হক : পথহারাকে পথ দেখিয়ে দেওয়া
পথ চলতে এমন অনেক মানুষ পাওয়া যায়, যারা পথ চেনে না। এমন পথিকদের পথ দেখিয়ে দেওয়া মহৎ নেক কাজ। এর গুরুত্ব কেবল পথহারা লোকেরাই উপলদ্ধি করতে পারে। এটিকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সদাকা বলে গণ্য করেছেন। তিনি বলেছেন-
وَإِرْشَادُكَ الرَّجُلَ فِي أَرْضِ الضَّلاَلِ لَكَ صَدَقَةٌ.
পথ না চেনা ব্যক্তিকে পথ দেখিয়ে দেয়া তোমার জন্য একটি সদাকা।[জামে তিরমিযী, হাদীস নম্বর ১৯৫৬]
এলাকার বাইরে থেকে কোনো লোক কোনো এলাকায় এল। সে ঠিকানা বলতে পারে বা ব্যক্তির নাম বলতে পারে, কিন্তু তার বাড়ি চেনে না বা খুঁজে পাচ্ছে না। আমি এলাকার সব চিনি, শুধু একটু আন্তরিকতা থাকলেই তাকে পেরেশানী থেকে বাঁচাতে পারি।
হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত. তিনি হযরত আবু যর রা. থেকে তাঁর ইসলাম গ্রহণের পুরো ঘটনা বর্ণনা করেন। সে দীর্ঘ ঘটনার মাঝে রয়েছে যে, হযরত আবু যর রা. বলেন, নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পুরোপুরি খোঁজ-খবর নিতে আমি নিজেই মক্কা শহরে পৌঁছলাম। কিন্তু তাঁকে চিনলাম না। কাউকে যে তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করব সে সাহসও হচ্ছিল না। ফলে আমি মসজিদে বসে রইলাম। হযরত আলী রা. আমাকে দেখে বুঝলেন আমি মুসাফির। সাথে করে বাসায় নিয়ে গেলেন। পানাহারের ব্যবস্থা করলেন। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। দ্বিতীয় দিনও তিনি আমাকে মসজিদে ঐরকম দেখতে পেলেন, ফলে আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। আমি কাউকে কিছু না বলার শর্তে তা জানালাম। তিনি আমাকে বললেন-
أَمَا إِنَّكَ قَدْ رَشَدْتَ، هَذَا وَجْهِي إِلَيْهِ فَاتَّبِعْنِي، ادْخُلْحَيْثُ أَدْخُلُ.
আপনি সঠিকের সন্ধান পেয়েছেন। আমিও সেদিকেই যাচ্ছি। আপনি আমার সাথে চলুন। আমি যেখানে প্রবেশ করব আমার সাথে সাথে প্রবেশ করবেন। অতপর হযরত আলী রা. আমাকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পৌঁছে দিলেন।[সহীহ বুখারী, হাদীস নম্বর ৩৫২৮]
এ ছিল দুনিয়া ও আখেরাতের পথহারাকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় পথের সন্ধান দান।
এ আদবের অন্তর্ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হল, অন্ধ, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধিদের রাস্তা পারাপারে সাহযোগিতা করা।
ষষ্ঠ হক : মযলুম ও বিপদগ্রস্তের সাহায্য করা
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। অনেকসময়ই রাস্তা-ঘাটে মানুষ যুলুমের শিকার হয়। বিপদের সম্মুখীন হয়। ফলে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। আমি অন্যের সাহায্যে এগিয়ে গেলে আল্লাহ আমার সাহায্য করবেন। আমি অপর ভাইকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলে আল্লাহ কিয়ামতের দিন আমাকে মহাবিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ لَا يَظْلِمُهُ، وَلَا يُسْلِمُهُ، مَنْ كَانَفِي حَاجَةِ أَخِيهِ فَإِنَّ اللَّهَ فِي حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْمُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللَّهُ عَنْهُ بِهَا كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِالْقِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللَّهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
মুসলমানগণ পরস্পর ভাই ভাই। কেউ কারো প্রতি যুলুম করে না এবং শত্রুর কাছে হস্তান্তর করে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করবে আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণ করবেন। যে কোনো মুসলমানের একটি কষ্ট লাঘব করবে আল্লাহ তার কেয়ামতের দিনের একটি কষ্ট লাঘব করবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটিও গোপন রাখবেন। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নম্বর ৪৮৯৩]
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একদা পথে এক ব্যক্তির খুবই তৃষ্ণা পেয়েছিল। সে একটি কূপ দেখতে পেয়ে তাতে নামল এবং পানি পান করে উঠে আসল। তখন দেখতে পেল, একটি কুকুর তৃষ্ণার জ্বালায় জিহ্বা বের করে হাঁপাচ্ছে এবং তৃষ্ণা মেটাতে কাদামাটি খাচ্ছে। তখন লোকটি মনে মনে বলল; আমার যেমন ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছিল, এ কুকুরেরও ঠিক তেমনি তৃষ্ণা পেয়েছে। সে কূপে নেমে চামড়ার মোজা ভরে পানি নিয়ে এল এবং কুকুরকে পান করাল। ফলে আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হলেন এবং তাকে মাফ করে দিলেন। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন-
يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَإِنَّ لَنَا فِي البَهَائِمِ لَأَجْرًا؟ فَقَالَ: فِيكُلِّ ذَاتِ كَبِدٍ رَطْبَةٍ أَجْرٌ.
ইয়া রাসূলাল্লাহ! গবাদী পশুর ক্ষেত্রেও কি আমাদের জন্য প্রতিদান রয়েছে? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, প্রত্যেক প্রাণীতেই আজর-সওয়াব রয়েছে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নম্বর ২৪৬৬]
হযরত আবু মাসউদ আনসারী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি পথে বিপদে পড়েছি (অর্থাৎ আমার বাহন মারা গেছে), আমার জন্য একটি বাহনের ব্যবস্থা করে দিন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাকে দেওয়ার মত কোনো বাহন আমার কাছে নেই। তবে তুমি অমুকের কাছে যাও। আশা করি সে তোমাকে বাহনের ব্যবস্থা করে দিবে। অতপর সে ঐ ব্যক্তির কাছে গেল এবং সে বাহনের ব্যবস্থা করে দিল। পুনরায় সে (পথিক) নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এল এবং তা জানাল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি (যে কোনো উপায়ে) কোনো সৎকর্মের পথ দেখাবে সে ঐ সৎকর্মকারীর সমান প্রতিদান পাবে। [সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নম্বর ৫১২৯]
সপ্তম হক : বোঝা বহনকারীকে সহযোগিতা করা
রাস্তায় চলাচলকারীদের মধ্যে কেউ থাকে খালি হাতে, কারো সাথে থাকে ভারি বোঝা। ভারি বোঝা যদিও একা বহন করা যায়, কিন্তু উঠানো বা নামানোর সময় কারো না কারো সাহায্যের প্রয়োজন পড়েই। যে ব্যক্তি এ কাজে সাহায্য করে তার জন্য বোঝা বহনকারীর হৃদয় থেকে দুআ আসে, এটাই স্বাভাবিক। আর আমি আল্লাহ্র সন্তুষ্টির নিয়তে কারো মাথা থেকে ভারি বোঝা নামিয়ে দিলাম তো হতে পারে এর অছিলায় আল্লাহ আমার গোনাহের বোঝা নামিয়ে দিবেন, মাফ করে দিবেন।
মাথায় করে ভারি বোঝা বহন করা কষ্টকর। এক্ষেত্রে যদি এমন হয়, আমার বাহনে আমি কারো ভারি বোঝা বহন করে দিলাম। সেটা উঠানো-নামানোর চেয়ে আরো বেশি ফযীলতের। তেমনি আমার বাহন আছে, আরেকজনের নেই। আমার বাহনে আরেকজনকে নিতে পারি। এক ভাইয়ের সাথে দেখা হল, আমি ও সে একই দিকে যাচ্ছি। সেক্ষেত্রে যদি আমার বাহনে তাকে উঠিয়ে নেই এটা হবে অনেক বড় সওয়াবের কাজ। হাদীসে এসেছে-
وَتُعِينُ الرَّجُلَ فِي دَابَّتِهِ فَتَحْمِلُهُ عَلَيْهَا، أَوْ تَرْفَعُ لَهُعَلَيْهَا مَتَاعَهُ صَدَقَةٌ
কোনো ব্যক্তিকে সাওয়ারীতে ওঠানো বা তার সামানা বহনে সহযোগিতা করাও একটি সদাকা। [সহীহ বুখারী, হাদীস নম্বর ২৯৮৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নম্বর ১০০৯]
অষ্টম হক : ভালো কথা বলা
পথে একে অন্যের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। কুশলাদি বিনিময় হয়। এক্ষেত্রে সহাস্য বদনে সুন্দরভাবে কথা বলা উচিত। কারণ, অনর্থক, অশালীন, অন্যায় কথার কারণে অনেক সময় পথে ফ্যাসাদ হয়। আর মুমিনের শানই হল ভালো কথা বলা; অন্যথায় চুপ থাকা। হাদীস এসেছে-
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَاليَوْمِ الآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْلِيَصْمُتْ
যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান রাখে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে। [সহীহ বুখারী, হাদীস নম্বর ৬০৩১; ইসলামিক ফাউন্ডেশন]
আর সবচেয়ে ভালো কথা হল, আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করা। ভালো কাজের প্রতি আহ্বান করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ
আর কে তার চাইতে কথাবার্তায় বেশী ভাল যে আল্লাহ্র প্রতি আহ্বান করে এবং সৎকর্ম করে আর বলে, ”আমি তো নিশ্চয়ই মুসলিমদের মধ্যেকার’’ [কুরআন মাজীদ, সূরা হা-মীম আস-সাজদাহ/ সূরা ফুসিলাত (সুস্পষ্ট বিবরণ), সূরা নম্বর ৪১, আয়াত নম্বর ৩৩, মক্কায় অবতীর্ণ]
নবম হক : হাঁচির জবাব দেয়া
সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরণ, এটি মুসলিমের একটি বৈশিষ্ট্য। দৈনন্দিন জীবনের মাসনূন দুআগুলো আল্লাহর স্মরণের মাধ্যম। হাঁচি আসা, এটি আল্লাহর রহমত। এর মাধ্যমে শরীর থেকে অনেক জীবাণু বের হয়ে যায়। তাই হাঁচি এলে মুমিন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলে, আলহামদু লিল্লাহ। হাদীস শরীফে একেও পথ চলার হক বলা হয়েছে। সুতরাং পথেও এ সুন্নতের প্রতি খেয়াল রাখা কর্তব্য। হাদীসে এসেছে-
إِذَا عَطَسَ أَحَدُكُمْ فَلْيَقُلْ: الْحَمْدُ لِلَّهِ، وَلْيَرُدَّ عَلَيْهِ مَنْحَوْلَهُ: يَرْحَمُكَ اللَّهُ، وَلْيَرُدَّ عَلَيْهِمْ: يَهْدِيكُمُ اللَّهُوَيُصْلِحُ بَالَكُمْ
কেউ হাঁচি দিলে বলবে, আলহামদু লিল্লাহ। এর জবাবে আশপাশে যারা থাকবে, বলবে ইয়ারহামুকাল্লাহ। প্রতি উত্তরে হাঁচিদাতা বলবে, ‘ইয়াহদীকুমুল্লাহু ওয়া ইউছলিহু বা-লাকুম’। [সহীহ বুখারী, হাদীস নম্বর হাদিস নম্বরঃ ৬২২৪; আধুনিক প্রকাশনী- ৫৭৮৩, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৫৬৭৮]
দশম হক : দম্ভভরে পথ না চলা
দম্ভভরে পথচলার বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। রাস্তায় কাউকে পাশ না দেয়া। অন্যের চলাচলের পথে বাধা সৃষ্টি করা। অন্যের যানবাহন আটকে রেখে নিজের পথ সুগম করা। বুক ফুলিয়ে ও মাথা উঁচু করে হাঁটা ইত্যাদি। এ সবই বর্জনীয়। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
وَ لَا تَمْشِ فِی الْاَرْضِ مَرَحًا اِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْاَرْضَوَ لَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُوْلًا .
ভূপৃষ্ঠে দম্ভভরে চলো না। তুমি তো পদভারে ভূমিকে বিদীর্ণ করে ফেলতে পারবে না এবং উচ্চতায় পাহাড় পর্যন্তও পৌঁছতে পারবে না। [কুরআন মাজীদ, সূরা বনী ইসরাঈল (ইহুদী জাতি)/ ইসরা (উর্ধ্বগমন), সূরা নম্বর ১৭, আয়াত নম্বর ৩৭, মক্কায় অবতীর্ণ]
আল্লাহ তা’য়ালা আমলের তাওফীক দান করুন। আ-মীন।