খবরের বিস্তারিত...


হজে সেলফি ও ফেসবুক/ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার?

হজে সেলফি ও ফেসবুক/ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার?

লেখক — গোলাম দস্তগীর লিসানী ।
—–

এই ধরনের লেখা লিখতে অস্বস্তি হয়, কিন্তু লজ্জা করে সত্য বলতে না থাকলে ওই অবস্থার কাছাকাছি হবে যে অবস্থা ছিল ইসলামপূর্ব মানুষের হজ করার মধ্যে।
জেনে রাখুন,
আমাদের এই উম্মাহ্’র আগে যেসব মানুষ চলে গেছে, তারা আল্লাহ্’র উদ্দেশে ইব্রাহিম ইসমাঈল হাজিরা আ.’র সুন্নাহ্ ধরে রাখার জন্য হজ করত। ক্রমে ক্রমে লুজ হতে হতে তারা সেখানে খোদ ইব্রাহিম ইসমাঈল আ.’র মূর্তি পর্যন্ত বসিয়ে ফেলে। কাবার ভিতরে ৩৬০ মূর্তি বসিয়েই ক্ষান্ত হয় না, উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফও শুরু করে দেয়।
আমাদের আগের মানুষরা যেমন একটু একটু করে অপকর্ম বাড়িয়ে গেছে এবং ‘সবাই তো খায়’ ‘আমি তো এম্নি এম্নি খাই’ বলে হালাল করে নিয়েছে, আমরা এখন কি সে পথ ধরিনি?

একজন হাজী হজের স্মৃতি ধরে রাখার উদ্দেশ্যে, মাওলার নৈকট্যে যাবার কথা মনে করে দেশে ফিরে নিভৃতে কাঁদার উদ্দেশ্যে, সন্তান বা মা বাবা দেখতে চাইলে তাদের জন্য দু একটা ছবি তুলতেই পারেন। এটা ভাল না মন্দ সে প্রশ্নে যাবার মত কট্টর হওয়া অস্বাভাবিক। তাই বলে হজে যখন তখন পটাপট সেলফি তোলা আর ঠকাঠক ফেসবুকে ঠুকে দেয়া আর তারপর লাইক কমেন্ট গোণা অত্যন্ত বাজে এবং প্রায় ঘৃণ্য একটা ব্যাপার।

বিশেষত আপনি যদি হারামাইন শরীফাইন তথা মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববী’র আশেপাশে বা ভেতরে থাকেন।

হজটা আসলে কী?
হজটা তো লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক?
তাই যদি হয়, আল্লাহ্ কে দেখানোর জন্য সেলফি তুলছেন?
আর যদি আল্লাহ্ কে দেখানোর জন্য তোলা না হয়, তবে কি বান্দাকে দেখানোর জন্য?
তাই যদি হয়, লাব্বাইক কার প্রতি হল?
যদি বিরাট বড় ওয়ালী হয়ে থাকেন তো আল্লাহ্ কে ভয় না করলেও অন্তত তাজিম লজ্জা তো করবেন? এম্নিতে মুমিনের জন্যও আল্লাহ্ কে অপকর্ম করার বেলায় ভয় করতে বলা হয়েছে, তাও অপকর্মর কথা উহ্য রেখেই ভয় করতে বলা হয়েছে, তাফসীরে সেটাকে অপকর্ম করার সময়ের সাথে যুক্ত করা হয়েছে।

এটা আমাদেরকে নবীজী দ.’র ওই হাদীস মনে করিয়ে দেয়,
শয়তান অতি উত্তম কাজের রূপে আমাদের দিয়ে অতি খারাপ কাজ করিয়ে নিবে।
আমরা পাগলের মত আগ্রহ করে ভাল মনে করে সুবিধাজনক মনে করে সবচে নিকৃষ্ট আবর্জনা গায়ে মাখব। আমাদের আত্মীয়স্বজন প্রিয় ফেবুবন্ধুরা দেশ-বিদেশ থেকে তাগাদা দিবে একটাও সেলফি দিলা না যে খানায়ে কাবার সাথে? যেন তারা বলছে, আহা, হজে গেছ, একটুও নর্দমার ময়লা গায় মেখে রাষ্ট্র করে দিলা না? তাইতো, তখন আমাদের সবচে পবিত্র অবস্থায় সবচে অপবিত্রতা গায় মেখে তা সারা দুনিয়ায় সাথে সাথে ছাপায় দিতে হবে। দুনিয়া তুমি সাক্ষী থাকো, আমি ক্বাবা আরাফায় রিয়া করি।
এজন্য হজে আসার আগে ফেসবুক ভালভাবে ব্যবহার করা যায় এমন একটা স্মার্টফোন কিনতে হবে। হজে ওমরায় মক্কা মদীনায় সাপ্টে সেলফি তুলতে হবে আর ফেসবুকে সাথে সাথে আপ করতে হবে।

তারপর লাইক কমেন্ট শেয়ার পড়তে হবে।
হজটা করবেন কখন?
আপনি শরীর নিয়ে হজে হাজির তো হলেন, মন ও আত্মা পড়ে আছে ফেসবুকে। মানুষের বাহবা নেয়ায়। এত কষ্ট কেন বরবাদ করা? শরীরকে লাব্বাইক তো করিয়ে ছাড়লেন, মন লাব্বাইক কখন হবে? নাকি মন একই সাথে মাওলার প্রতি এবং কুল মাখলুকের প্রতি লাব্বাইক আছে? প্রভুর প্রতি রুজু থাকার খাস সময়টায় কি বিনোদনের প্রতি রুজু থাকারও নিয়ম আছে?
হজে পর্দার কড়াকড়ি থাকে না, কারণ সেখানে বান্দা মালিকের প্রতি এতটাই রুজু হয়ে পড়ে, যে নাফসানিয়াত তার উড়ে যায়। এই কি নাফসানিয়াত উড়ে যাবার লক্ষণ? যে সেলফি ও লাইক কমেন্ট সামলাতে পারে না, তার কাছে কি হজে থাকা বাকী নারী-পুরুষ হাজীরা নাফসানিয়াত থেকে নিরাপদ?

এই সেলফি ফেবু হজ না করে বাবা মায়ের চেহারা দেখতে থাকুন ভালবাসা নিয়ে, কাউকে না জানিয়ে, সেগুলো কবুল হজ হবে। এই হজ বরবাদ হজ হবার সম্ভাবনা ৮০%। টাকাও গেল, হজও গেল। যাক, সেলফি তুলে সাথে সাথে আপ তো করা হল, অন্তত মানুষ তো দেখল, তাই না?

আহহা, আমাদের তো একটু বোধবুদ্ধি আছে, রাসূল দ., আবু বকর রা., উমার রা., আলী রা., হাসান রা., হুসাইন রা.- তাঁদের একজনও যদি এটা করতে দেখতেন তাঁদের সময়ে, কী বলতেন?
আল্লাহ্ ভাল জানেন, তবু এইভাবে সেলফি তুলে তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় সয়লাব করাকে হয়তো তাঁরা রিয়ায়ে আযম, রিয়ায়ে আকবরই বলতেন।

হয়তো ইসলামের সর্ব্বোচ্চ অথরিটিরা, নবী দ. ও তাঁর পর খুলাফায়ে রাশিদরা, যাঁদের সুন্নাহ্ মানা আমাদের উপর অবশ্যম্ভাবী, তাঁরা হয়তো এটাকে সবচে বড় ‘ছোট শিরক’ ই বলতেন।

খোদার কসম, আমরা মুসলিমরা জাতিগতভাবে মালিক থেকে কত দূরে চলে গেছি এবং কত দূরে গিয়ে স্থির হয়ে গঁ্যাট হয়ে বসে আছি সেটার সবচে বড় প্রমাণ হজে লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি সেলফি।

রাসূল দ. বলেছেন না, শেষ জামানার লক্ষণ হল মসজিদ হবে সবচে বড়, অতিকায়, বিশাল, সুরম্য কিন্তু সেখানে ইবাদাত থাকবে না? থাকবে না কেন, আত্মপূজা তো আছে। হ্যা, আল্লাহ্’র ইবাদাত বিলুপ্ত হওয়ার মত।
আমাদের আগের উম্মাহ্ যেমন কাবার ভিতরে নবীদের মূরতি বসিয়ে মনে করত বেশ ভাল একটা সাচ্চা কাজ করলাম, আপনি আমি এখন কাবার দরজা ধরে নিজের মূরতি সারা দুনিয়ায় রাষ্ট্র করে দিয়ে বেশ বাহাদুরির কাজ করছি।
তারা যেমন উলঙ্গ হয়ে তাওয়াফ করে বেশ ভাল কাজ করছে মনে করতো, আমরা এখন মুখে লাব্বাইক আল্লাহ্ লাব্বাইক আল্লাহ্ বলতে বলতে তাওয়াফ করতে করতে সেলফি তুলে তুলে নিজের হাজিরির নামে উলঙ্গপনা আত্মপূজাই করছি।
সব পূজা থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ, আত্মপূজা হল ছদ্মপূজা তাই এ থেকে মুক্তি পাওয়া সবচে কঠিন, মানুষ বোঝেও না, দেখিয়ে ভাল কাজ করে সে আসলে পূজাই করছে, যেহেতু সে বোঝে না, সেহেতু রাসূল দ. বলেছেন এটাকে ‘ছোট শিরক’।

যাক, সবচে বড় জায়গায় বারংবার ছোট শিরক করতে থাকা হল “সবচে বড় ‘ছোট শিরক”।

Comments

comments