হযরত মাওলানা শাহ ইনায়তুল্লাহ খান রামপুরী নখশেবন্দী মুজাদ্দেদী ( রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ
খানকাহ-ই-ইনায়তিয়া মুজাদ্দেদিয়ার প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা শাহ ইনায়তুল্লাহ খান রামপুরী নখশেবন্দী মুজাদ্দেদী ( রহঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনীঃ
বংশগত দিক থেকে শাহ ইনায়তুল্লাহ খান একজন আফগান। তার পরিবার আফগানিস্তান থেকে ভারতে এসেছে। রামপুর স্টেটের শাসনকর্তা নওয়াব ফয়জুল্লাহ খান এর শাসন আমলে হুজুরের দাদাজান শায়েখ রহমতুল্লাহ খান আফগানিস্তান থেকে রামপুরে আসেন।
শায়েখ রহমতুল্লাহ খান একজন সুদক্ষ সৈনিক ছিলেন। একই সাথে তিনি ছিলেন অসাধারণ ধার্মিক ব্যাক্তি।স্বভাবগতভাবে তিনি ছিলেন কঠোর ধর্মনিষ্ঠ। পীর দরবেশদের মেহমানদারী করতে অভ্যস্ত ছিলেন এবং নিয়মিত তাঁদেরকে নিজ বাসায় দাওয়াত করতেন।আল্লাহর বন্ধুদের সেবা করা বৃথা যায় না।এই দুনিয়াতেও কখনো কখনো এর প্রতিদান পাওয়া যায়।
একদিন হযরত ভোলা শাহ (রহঃ) নামে একজন কাদেরিয়া তরিকার দরবেশ তার বাড়ি তে আসলে তিনি পীর সাহেবকে জানান, তার আফগান স্ত্রীর গর্ভে কোন সন্তান জন্ম গ্রহন করছে না। তিনি পীর সাহেবকে দোয়া করতে অনুরোধ করেন যেন আল্লাহ তায়ালা একটি পুত্র সন্তান দান করেন।
হযরত ভোলা শাহ (রহঃ) তার পক্ষ থেকে দোয়া করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যান। এর কিছুদিন পর আল্লাহ্ পাক শায়েখ রহমতুল্লাহ খান কে একজন পুত্র সন্তান দান করেন। কিছুদিন পর পুনরায় হযরত ভোলা শাহ (রহঃ) ফিরে আসলে তিনি এই সন্তানের নাম রাখেন, হাবিবুল্লাহ খান এবং স্বহস্তে নিজের টুপি শিশুটির মাথায় পরিধান করে দিয়ে বলেন, এই শিশু এতই সৌভাগ্যশালী যে, আল্লাহ পাক এনাকে একটি পুত্র সন্তান দিবেন যিনি হবেন একজন কামেল ওয়ালী আল্লাহ্।
হযরত ভোলা শাহ (রহঃ) এর দোয়ার বরকতে হাবিবুল্লাহ খান ধার্মিকতা, নিষ্ঠা, ধন সম্পদ, সুনাম সুখ্যাতি, এবং সন্তান সন্ততি সকল দিক থেকে যথা সম্ভব রহমত ও বরকত লাভ করেন। পেশাগত দিকথেকে হাবিবুল্লাহ খান ছিলেন জমিদার এবং কৃষি নির্ভর। এই পেশায় তিনি এতই অর্থ শালী হয়েছিলেন যে রাম পুর স্টেটের মধ্যে তিনি ছিলেন বিত্তশালীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
হযরত শাহ ইনায়তুল্লাহ খান ( রহঃ) এর জন্মের পুর্বে হাবিবুল্লাহ খান একদিন সপ্নে দেখেন, তার কোলের মধ্যে পুর্নিমার চাঁদ হাসছে। তার এই সপ্নের মর্ম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তার পীর সাহেব জানালেন, ” তুমি এমন এক পুত্র সন্তান লাভ করবে যার মাধ্যমে পুর্নিমার চাঁদ এর ন্যায় সারা পৃথিবী আলোকিত হবে। তার আধ্যাতিক দীপ্তি এতো প্রখর হবে যে, গোটা পৃথিবী তার দ্বারা উপকৃত হবে। ”
১২৫৯ হিজরীতে হযরত হাফেজ শাহ ইনায়তুল্লাহ খান ( রহঃ) এর জন্মের মধ্য দিয়ে হযরত ভোলা শাহ (রহঃ) এর ভবিষৎবাণী বাস্তবায়িত হয়।
বাল্যকাল থেকে তিনি ক্রিড়া কৌতুকের প্রতি অনাগ্রহী ছিলেন এবং সদা বিহ্বল অবস্থায় কাটাতেন। সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআন মজিদ হেফজ করেন। রামপুরের বড় বড় আলেমদের কাছে ফার্সী শিখেন। তার আব্বা চাইতেন তিনি যেন জমিদারী দেখাশুনার কাজে আব্বাকে সহযোগীতা করেন কিন্তু হযরত শাহ ইনায়তুল্লাহ খান (রহঃ) সে কাজের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না।
যে ব্যাক্তি যে পথ অন্বেষন করে, মহান আল্লাহ তাকে সেই পথ লাভের সুযোগ করে দেন।
হযরত মাওলানা ইরশাদ হুসাইন নখশেবন্দী মুজাদেদী (রহঃ) এর সান্নিধ্য লাভঃ
( হাফেজ শাহ ইনায়তুল্লাহ খাঁন মুজাদ্দেদী (রহঃ) এর জীবনি ২য় অংশ….. )
মাওলানা ইরশাদ হুসাইন মুজাদ্দেদী (রহঃ) এর সান্নিধ্য লাভঃ
হযরত মাওলানা ইরশাদ হুসাইন মুজাদ্দেদী (রহঃ) মদীনা শরীফ থেকে রামপুরে এসে জমিদারবাড়িরর পাশ্ববর্তী একটি মসজিদে অবস্থান নেন। শরীয়তের একটি মাছ য়ালা ফায়সালার জন্য শাহ ইনায়তুল্লাহ একদিন কয়েকজন বন্ধু সহ হুজুরের সাথে সাক্ষাত করেন। এই প্রথম সাক্ষাতেই মাওলানা ইরশাদ হুসাইন (রহঃ) শাহ ইনায়তুল্লাহ খান এর অসীম যোগ্যতা উপলব্ধি করে তার সাথে সদয় ব্যাবহার করেন। হুজুর জিজ্ঞেস করেন, ” তুমি নিজেই এই বিষয়ে লেখাপড়া কর না কেন?”
ইনায়তুল্লাহ জবাবে বলেন, আমার এখন বেশ বয়স হয়েছে। আমার আব্বা চান আমি তার জমিদারী কাজে সহযোগীতা করি। তাছাড়া আমি এই বয়সে শরীয়তের প্রাথমিক বিষয় নিয়ে পড়তে লজ্জাবোধ করছি।
মাওলানা ইরশাদ হুসাইন (রহঃ) বলেন, আমি তোমাকে এমন একটি কিতাব পড়াবো, যা এখন পর্যন্ত কেউ পড়েনি।”
শাহ ইনায়তুল্লাহ খাঁন এই প্রস্তাবে গভীরভাবে আলোড়িত হলেন এবং হুজুরের কাছে অধ্যায়নের জন্য মন স্থির করলেন। পড়াশোনা শুরু হল।
ইরশাদ হুসাইন (রহঃ) তাকে একটি অপ্রকাশিত আরবী ব্যাকরণ গ্রন্থ পড়ালেন। পরবর্তীতে এটি এরশাদুছ ছরফ নামে প্রকাশিত হয়। পর্যায় ক্রমে তিনি আরবি ভাষা, তাফসীর , হাদীস, ফিকাহ, উসুলে ফিকাহ, এবং অন্যান্য ইসলাম বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। এভাবে দশ বছর যাবত নিয়মিত কঠোর অধ্যাবসায় চালিয়ে লেখাপড়া শেষ করেন।
শাহ ইনায়তুল্লাহ খাঁন আলেমদের মধ্যে এক বিশেষ স্থান লাভ করেন। তার পীর হযরত ইরশাদ হুসাইন (রহঃ) তার সর্বাধিক ভাল ছাত্রদেরকে শাহ ইনায়তুল্লাহ খাঁন এর দায়িত্বে ন্যস্ত করতেন এবং শাহ ইনায়তুল্লাহ খাঁন ছাত্রদের পড়াতেন, তিনি উঁচু মানের কিতাবাদি পড়াতেন বিশেষ করে, তিনি তৃপ্তির সাথে আকর্ষনীয়ভাবে মকতুবাদ শরীফ পড়াতেন।
একদিন হযরত ইরশাদ হুসাইন (রহঃ) এক অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, ” এখন তোমার উচিত নখশেবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া তরীকায় এলমে মারেফাতের ছবক গ্রহন করা “। উস্তাদের নির্দেশ অনুসারে শাহ ইনায়তুল্লাহ খাঁন তরীকতের বাইয়াত গ্রহন করেন এবং আধ্যাতিক ছবকাদি শিক্ষা শুরু করেন হযরত মাওলানা ইরশাদ হুসাইন (রহঃ) এর কাছে। তিনি সর্বদাই পীরের লক্ষ্যবস্তু তে পরিনত হয়েছিলেন।শাইখের প্রতি তার প্রগাড় মুহাব্বত, ও নিজ ঞ্জ্যানার্জনের যোগ্যতা, এবং তার প্রতি শাইখের বিশেষ নজরের ফলে অতি অল্প দিনের মধ্যে আধ্যাতিক পথ পরিক্রমা সমাপ্ত করেন।
তিনি তার শাইখের অনুগ্রহ লাভ করে খলিফার মর্যাদায় ভুষিত হন।অন্যদের তালিম প্রদানের দায়িত্বও পালন করেন।শাহ ইনায়তুল্লাহ খান তার পীরের প্রতি অত্যাধিক অনুরক্ত ছিলেন। পীর তার মুরিদ দের কাছ থেকে যে এমন ভালবাসা পাবেন তা কোন আশ্চর্যকথা নয়, কিন্তু সেই ব্যাক্তি সৌভাগ্যের অধিকারী যাকে তার পীর স্বয়ং ভালোবাসেন।
একদিন এক লোক ইরশাদ হুসাইন (রহঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন, ” হযরত আপনার কি কোন বন্ধু আছে?”
তিনি উত্তরে বললেন, ” হ্যা। আমার কেবল একজন বন্ধু আছে, আর সে হচ্ছে ইনায়তুল্লাহ খাঁন।”
(তথ্যসূত্রঃ নূরে মারেফাত ৫৩-৫৪ পৃষ্ঠা )
প্রত্যেক পীরের বহু সংখ্যক মুরিদ থাকে। যাঁদের মধ্যে কেবল অল্প সংখ্যক ব্যাক্তি কামালত লাভ করতে পারেন। কামালত প্রাপ্তদের মধ্যে মাত্র এক ব্যক্তিই পীরের আধ্যাতিক শক্তির বিশিষ্ট উত্তরাধিকারী হয়ে থাকেন। শাহ ইনায়তুল্লাহ খাঁন (রহঃ) যথার্থ ই সকল দিক দিয়ে ইরশাদ হুছাইন মোজাদ্দেদী ( রহঃ) এর বিশিষ্ট উত্তরাধিকারী বা খাস খলীফা নিযুক্ত হন।
আধ্যাতিক শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে বিপুল সংখ্যক লোক হাফেজ ইনায়তুল্লাহ খাঁন ( রহঃ) এর দরবারে ছুটে আসতে লাগলো। হুজুরের সরাসরি তত্বাবধানে আধ্যাতিক শিক্ষা কোর্স সমাপ্ত করে খেলাফত প্রাপ্ত হয়েছিলেন, এমন ব্যাক্তির সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল কয়েক হাজারে। আর হুজুরের খলিফাগনের মুরীদের সংখ্যা কয়েক লক্ষ।
হুজুরের সাক্ষাত প্রার্থী সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তিনি নিজ অর্থ ব্যায়ে একটি বিশাল এলাকা ক্রয় করেন।এবং সেখানে বিরাট খানকাহ নির্মান করেন। যাতে তালেবে মাওলা খোদা প্রেমিক ব্যাক্তিরা সেখানে অবস্থান করে পরিপুর্ন মননিবেশ সহকারে আধ্যাতিক শিক্ষা কোর্স সমাপ্ত করতে পারেন। পরবর্তী তে এটি খানকাহ -ই-ইনায়তিয়া নামে পরিচিত হয়। বিদেশী শিক্ষার্থী দের মধ্যে অধিকাংশ ছিল, বুখারা, কাবুল – কান্দাহার ( আফগানিস্তান) , চীন, তুরস্ক, এবং বর্তমান পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অধিবাসী। এনাদের মধ্যে অনেকেই নিজ দেশে ফীরে গিয়ে তরীকায়ে নখশে বন্দীয়া মুজাদ্দেদিয়া সিলসিলার ব্যাপক প্রসার ঘটান।
প্রতিদিন সকাল সন্ধায় হুজুরের খানকায় নিরব যিকির ও মোরাকাবার মাহফিল বসতো। এই সব মাহফিলে এমন আধ্যাত্মিক ফয়েজ নেমে আসতো যা ভাষায় বর্ননাতীত। এতে উপস্থিত প্রত্যেক ব্যাক্তির অন্তর অলোকিত ও পরিতৃপ্ত হয়ে যেত।
হযরত হাফেজ ইনায়তুল্লাহ খাঁন। (রহঃ) এর দৈনিক কর্মসুচীর মধ্যে ছিল ফজরের নামাযের পর কতিপয় দোয়া সমন্বয়ে খতম শরীফ পাঠ করা। ইশরাকের নামাজের পর হাল্কা চা নাস্তা সেরে হুজুর জিকির ও মোরাকাবার মাহফিলে বসতেন। দীর্ঘক্ষন যাবত এই মাহফিল চলতো। সবশেষে একজন কারীকে সুললিত কন্ঠে পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াত করতে বলতেন।হুজুর মাঝে মাঝে তেলাওয়াতকৃত আয়াতগুলোর অর্থ ব্যাখ্যা করে শোনাতেন, যার ফলে উপস্থিত সকল শিক্ষিত অশিক্ষিত ব্যাক্তিই সমভাবে উপকৃত হতেন। তাহাজ্জুদ শেষ করে ফজর পর্যন্ত কুরআন মজিদ তেলাওয়াত করতেন।
হুজুর প্রায় ৩৪ বছর যাবত নিয়মিত ভাবে নখশে বন্দিয়া মুজাদ্দেদিয়া তরীকার নিয়মানুসারে তালেবে মাওলাদের আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষন দান করেন। ছিয়াশি বছর বয়সে ১৩৪৫ হিজরী ১০ ই জিলহজ্ব পবিত্র ঈদ উল আযহার দিন বিকেল বেলা প্রিয়তম প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে আখিরাতের অনন্ত সফরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পরদিন হুজুরের জানাজার নামাজ স্থানীয় ঈদ গাহে অনুসঠিত হয়। খানকাহ -ই-ইনায়তিয়া প্রাংগনে হযরত শাহ ইনায়তুল্লাহ খাঁন (রহঃ) এর পবিত্র মাজার শরিফ অবস্থিত।
তথ্যসুত্র: নুরে মারেফাত