খবরের বিস্তারিত...


মোগল আমলের ঐতিহাসিক সাতগম্বুজ মসজিদের ইতিহাস

সেপ্টে. 06, 2018 আক্বীদা

দেড় হাজার বছর আগে হেরা পর্বতের গুহায় যে নূর জ্বলে উঠেছিল, তা ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।পবিত্র হাদিস শরীফ উনার মাঝে আছে- “যেখানে সূর্যের আলো পৌঁছবে, সেখানেই ইসলামের আলো পৌঁছবে”। নূরে মুজাসসাম হুজুরপাক ছল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম উনার জীবদ্দশায় এ অঞ্চলের লোকজন ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ করেন, এটি আমাদের পরম সৌভাগ্যের বিষয়। বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলায় প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায়- সাহাবিগন এখানে মসজিদও নির্মাণ করেছিলেন। তাই আমাদের দেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস অনেক পুরানো। শুধু বিক্ষিপ্তভাবেই নয়, খ্রিষ্টীয় দশম শতকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি মুসলিম রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণ পাওয়া যায়।

প্রথম চীনে ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন একদল সাহাবি। ৬১৫-৬১৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে উনারা আসেন। এ দলে ছিলেন নূরে মুজাসসাম হুজুরপাক ছল্এলাল্রলাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম উনার চাচাতো ভাই জাফর ইবনে আবি তালিব রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এবং আবদুল্লাহ ইবনে জাহাশ রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু উনাদের মতো সাহাবি্গন। কোনো কোনো বর্ণনায় কায়েস ইবনে হুজায়ফা রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু, উরয়োহ ইবনে আসামা রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ও আবু কায়েস ইবনে হারেস রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু উনাদের নামও এসেছে।
নূরে মুজাসসাম হুজুরপাক ছল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম উনার জীবদ্দশায় নবুয়তের পঞ্চম বর্ষে (৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে) ইসলাম প্রচারের জন্য সাহাবি আবি ওয়াক্কাস রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু উনার নেতৃত্বে সাহাবিগনের একটি দল হাবশায় (বর্তমান ইথিওপিয়া) অঞ্চলে গমন করেন। চীনে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সাহাবিগনের একটি দল ৯ বছর সময় নেয়। হাবশার সুলতান আল নাজাশির দানকৃত নৌযানে চড়ে ৬১৬ মতান্তরে ৬১৭ খ্রিষ্টাব্দে সাহাবিগন পূর্বদিকে সমুদ্রযাত্রা করেন। বিশিষ্ট সাহাবি আবু ওয়াক্কাস মালিক বিন ওয়াইবের নবুয়তের সপ্তম বর্ষে (খ্রিষ্টীয় ৬১৭ সনে) কাসেম ইবনে হুজায়ফা রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু, উরওয়াহ ইবনে আসাসা রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ও আবু কায়েস ইবনুল হারিস রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সহ উনারা চীনের পথে পাড়ি দেন। সমুদ্রতীরে কেয়াংটা মসজিদ সাহাবঙ্গনই নির্মাণ করেন। আল নাজাশি মৃত্যুর আগে ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর দলটি তৎকালীন হিন্দের (ভারতের) মালাবারে বর্তমান কেরালা এসে পৌঁছে এবং সেখানে থেকে ৬১৭ (মতান্তরে ৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে) চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছে। এ দলটি চট্টগ্রামে ৯ বছর অবস্থান করায় এ সময়ে অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেন। অষ্টম হিজরিতে ক্যান্টন থেকে চীনের রাজা তাইশাং আবু কাবশা রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু উনার মারফতে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং দক্ষিণ এশিয়ায়ও সাহাবায়ে কেরামগন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এসেছিলেন। চীনের ক্যান্টন সমুদ্র তীরে সাহাবি আবু ওয়াক্কাস মালিক বিন ওহাইব রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু উনার মাজারও রয়েছে।
নূরে মুজাসসাম হুজুরপাক ছল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম উনার বিছাল শরীফের পর যেসব সাহাবি চট্টগ্রামে এসে ইসলাম প্রচার করেন, তারা হলেনঃ ১. আবদুল্লাহ ইবনে উতবান রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু,
২. আসেম ইবনে আমর তামিমি রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু,
৩. সাহল ইবন আবদি রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু,
৪. সুহায়েল ইবনে আদি রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এবং
৫. হাকিম ইবনে আবুল আস সাকাফি রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু। উনারা কিছুদিন চট্টগ্রাম থেকে পরে চীনে গিয়ে ইসলাম প্রচার করেন।
চীনে যাওয়ার পথে সাহাবি আবু ওয়াক্কাস মালিক বিন ওহাইব রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু উনি বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দরে নোঙর করেছেন বলে জানা যায়। উনার সঙ্গে আরও কয়েকজন সাহাবি ছিলেন। তাদের পবিত্র সাহচর্যে এসে এ দেশের কিছু মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সাহাবি আবি ওয়াক্কাস রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু উনার সম্পর্কে জানা যায়- তিনি ছিলেন মা আমেনা আলাইহহাস সালাম উনার চাচাতো ভাই। আবার তিনি ছিলেন প্রসিদ্ধ সাহাবি সাদের রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু উনার বাবা। সাহাবি আবু ওয়াক্কাস রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু উনার সঙ্গে যেসব সাহাবি ছিলেন বলে জানা যায় উনারা হলেন- ১. আবু ওয়াক্কাস মালিক রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু
২. কায়স ইবনে হুজাইফা রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু,
৩. উরওয়া ইবনে আসাসা রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু,
৪. আবু কায়স ইবনে হারিস রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এবং
৫. তামিম আনসারি রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু।
বিভিন্ন প্রাচীন শিলালিপি এবং ইতিহাসবিদদের লেখনীতে দশজন সাহাবি ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছিলেন বলে জানা যায়। প্রথম পর্যায়ে কয়েকজন সাহাবি নবীজি উনার নির্দেশে উনার জীবদ্দশায়ই বাণিজ্য ও ইসলাম প্রচারের কাজে হিজরত করেছিলেন।
রংপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়-
নূরে মুজাসসাম হুজুরপাক ছল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম উনার মামা বিবি আমেনা আলাইহাস সালাম উনার চাচাতো ভাই আবু ওয়াক্কাস রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু ৬২০-৬২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেন। কেউ কেউ অনুমান করেন তিনি লালমনিরহাটের “মসজিদ আবু ওয়াক্কাস রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু” নির্মাণ করেছিলেন।
অন্য একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, বিশিষ্টি সাহাবি আবু ওয়াক্কাস রাধিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু উনি ইসলাম প্রচারের জন্য চীন যাওয়ার পথে কিছুকাল রংপুর এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন।
নূরে মুজাসসাম হুজুরপাক ছল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম উনার বিছাল শরীফের পর (৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে) একটি প্রতিনিধি দল এ দেশে আসে। ৬৩৭ সালে শশাঙ্কের মৃত্যু হলে ঘোরতর নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ছোট রাজারা নিরীহ মানুষের ওপর অত্যাচার চালায়। এ অবস্থাটাকে ইতিহাসে ‘মাৎস্যন্যায়’ বলা হয়েছে। এ সময় উনারা ইসলাম গ্রহণ করেন।
কুড়িগ্রামের লালমনিরহাট জেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাশ গ্রামের ‘মজেদের আড়া’ নামক জঙ্গলে ১৯৮৭ সালে একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। ধ্বংসাবশেষে প্রাপ্ত শিলালিপিতে হিজরি ৬৯ সন লেখা ছিল। হিজরি ৬৯ মানে ৬৪৮ ইংরেজি। এ সময়টা ছিল বনু উমাইয়ার যুগ।
নূরে মুজাসসাম হুজুরপাক ছল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম উনার যুগের সঙ্গে এর ব্যবধান মাত্র ৫০ বছর। মসজিদটির নির্মাণকাজ ৬৯ হিজরিতে শেষ হলেও এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল অনেক আগে। কারণ সে সময় এ অঞ্চলে পাকা ঘর নির্মাণ করতে অনেক সময় লাগত। গোলাম সাকলায়েন তার ‘বাংলাদেশের সুফি সাধক’ গ্রন্থে লালমনিরহাট (সাবেক কুড়িগ্রাম) জেলার হারানো মসজিদ প্রসঙ্গে বলেন, এটি ৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তৈরি হয়েছিল।( দৈনিক বাংলা, ২৩ এপ্রিল বুধবার ১৯৮৬ সংখ্যায় এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম বিস্তারিত রিপোর্ট ছাপা হয়)।
এ মসজিদের ধ্বংসাবশেষের গম্বুজ থেকে প্রাপ্ত ইটগুলোতে নানা ধরনের ফুলের নকশা ও আরবি হরফে কলেমায়ে তৈয়্যেবাসহ হিজরি ৬৯ সন লেখা আছে। বর্তমানে রংপুর জাদুঘরে শিলালিপিটি সংরক্ষিত রয়েছে।
হারানো মসজিদটির দৈর্ঘ্য উত্তর-দক্ষিণে ২১ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১০ ফুট। মসজিদের ভেতরের পুরত্ব সাড়ে ৪ ফুট। মসজিদের চার কোণে আটকোণ বিশিষ্ট স্তম্ভ রয়েছে। মসজিদের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া যায় গম্বুজ ও মিনারের চূড়া। (রংপুর জেলার ইতিহাস : পৃ ১৬৪ )। মতিউর রহমান বসুনিয়া রচিত রংপুরে দ্বীনি দাওয়াত গ্রন্থেও মসজিদটির বিশদ বিবরণ রয়েছে।
স্থানীয় ভাষায় ‘আড়া’ অর্থ জঙ্গলময় স্থান। এতদিন কেউ হিংস্র জীবজন্তু, সাপ-বিচ্ছুর ভয়ে এর ভেতরে প্রবেশ করার সাহস পেত না। ১৯৮৭ সালে জমির মালিক তা আবাদযোগ্য করার চিন্তা করে জঙ্গল পরিষ্কার করতে গেলে বেরিয়ে আসে প্রাচীন আমলের ইট। এখানে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। যার মধ্যে স্পষ্ট অক্ষরে আরবিতে লেখা আছে আমাদের প্রিয় কলেমা। খননকাজে বিস্ময় বাড়তে থাকে। আরও খননের পর মসজিদের মেহরাব এবং মসজিদসংলগ্ন ঈদগাহ মাঠ ও ইমাম যে স্থানে খুতবা পাঠ করতেন তাও আবিষ্কৃত হয়। তারপর থেকে স্থানীয় লোকজন টিন দিয়ে একটি মসজিদ তৈরি করেন।

মহান আল্লাহপাক উনি বলেন, ‘তুমি তোমার প্রভুর পথে (মানুষকে) হেকমত (প্রজ্ঞা) ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে ডাক।’ (সূরা নাহল : ১২৫)।
অন্যত্র আল্লাহপাক উনি বলেন, ‘তোমরাই উত্তম জাতি। তোমাদের বের করা হয়েছে মানুষদের সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজ থেকে নিষেধ করার জন্য।’ (সূরা আলে ইমরান : ১১০)।
‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল অবশ্যই থাকতে হবে, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে ডাকবে। সৎকাজের আদেশ দেবে এবং অসৎকাজে নিষেধ করবে।’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৪)।
অন্যত্র আল্লাহপাক উনি বলেন, ‘তার কথার চেয়ে আর কার কথা অধিক উত্তম হতে পারে, যে মানুষকে মহান আল্লাহপাক উনার দিকে ডাকে, সৎকাজ করে এবং বলে- আমি একজন মুসলমান।’ (সূরা হামিম : ৩৩)।

তথ্যসূত্রঃ গ্রন্থ সমূহ-
১. বাংলাদেশে ইসলামের আগমন।
২. বাংলায় ইসলামের আগমন।
৩. বাংলায় ইসলাম প্রচারে আরব বণিকদের ভূমিকা।
৪. সাহাবায়ে কেরাম রাধিয়াল্লাহু এর চট্টগ্রাম সফর এবং বাংলায় ইসলামের
আগমন।
৫. প্রাচীন জৈন্তিয়ারাজ্যে ইসলামের দীপশিখা।
৬. বাংলাদেশে ইসলামি দাওয়াতের আগমন।
৭. বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের ইতিহাস : রাসুল ছল্লাল্লাহু আলাহি
ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় ইসলাম এ দেশে আসে।
৮. বাংলাদেশে হারানো মসজিদ।

Comments

comments