খবরের বিস্তারিত...


বরজখ বা কবরের জীবন

এপ্রিল 22, 2019 আক্বীদা

বিশ্ব নবী (সঃ) এর হাদিস দ্বারা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে- যদিও মৃত্যুর পর আমরা মানুষকে পচনশীল লাশ মনে করি। বস্তুত তারা লাশ নয়।বরং জীবিত থাকে ।তবে তাদের জীবন আমাদের এই পার্থিব জীবনের সম্পূর্ণ বিপরিত । বিশ্ব নবী (সঃ) বলেছেন –
মৃতের হাড় ভাঙ্গা, জীবিতের হাড় ভাঙ্গার মতই।
— মেশকাত,আবু দাউদ,ইবনে মাজা, মালেক
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) একদিন হযরত আমর ইবনে হজম (রাঃ) কোন একটি কবরের সাথে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখে বললেন ,
এই কবরে সমহিত ব্যাক্তি কে কষ্ট দিয়ো না
— মেশকাত
মৃত্যুর পরে মানুষ এই পার্থিব জগত থেকে পর জগতে চলে যায় ।তাঁকে কবরে সমাহিত করা না হলেও বা চিতার আগুনে জ্বলানো হলেও তাঁর অবস্থান পরলোকে । সেখানে অবস্থান কালে তাঁর চেতনা উপলব্ধি ও বিদ্যমান থাকে ।
রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন , মৃতের লাশ চৌ খাটে রেখে কবরস্থানে নেয়ার জন্য যখন তা কাধে করে বহন করে । তখন সে পুণ্যবান হলে বলে , আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে চলো ।আর যদি সে পুণ্যবান না হয়, তাহলে নিজের পরিবার পরিজন কে বলে , হায় ! আমার ধংস , তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? মানুষ ছাড়া প্রত্যেক প্রাণী তাঁর এই কথা শুনতে পায় । আর মানুষ যদি শুনত অবশ্যই সে বেহুশ হয়ে পরত ।
— বুখারি শরীফ
মৃত্যুর পর থেকে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মানুষের জীবনে যে সময় অতিবাহিত হয় তাঁকে বরজখ বা কবরের জীবন বলে । বরজখ শব্দের অর্থ – পর্দা বা আড়াল । যেহেতু এই সময় কাল টি দুনিয়া ও আখিরাতের মধ্যে পর্দা বা আড়াল বিশেষ , এ জন্য একে বরজখ বলা হয় ।
সাধারনত মানুষ যেহেতু মৃতদের কে কবরে সমাহিত করে , সেহেতু হাদিসের ভাষায় বরজাখকালের শান্তি ও সাস্তি কে কবরের আজাব নামেই উল্লেখ করা হয়েছে। এর মর্ম এই নয় যে , যেসব মৃত কে আগুনে জালান হয় , বা গভীর পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয় , তারা বরজাখের সময়কালে জীবিত থাকে না । আসলে তারাও বরজখে জিবন্ত কাল কাটায় । তারা হয় শান্তি তে অথবা শাস্তির মধ্যে নিপতিত থাকে । যারা কাফের মুশরেক অবস্থায় মারা যায় ,তারা বরজখের জীবনে কোন আরাম শান্তি ভোগ করতে পারে না ।তাদের জন্য রয়েছে শাস্তি আর শাস্তি । আল্লাহ্‌ তায়ালা মানব দেহের ভস্ম কে একত্রিত করে শাস্তি বা শান্তি দিতে পুরো মাত্রায় সক্ষম । হাদিসে আছে ,
পূর্ব জামানায় এক ব্যাক্তি খুব গোনাহর কাজ করত । তাঁর মৃত্যুর সময় উপস্তিত হলে সে তাঁর পুত্র দের এই অসিওত করল যে , তোমরা আমার মর দেহ টি আগুনে জালিয়ে দেবে। আর আমার চাই ভস্মের অর্ধেক বায়ু মন্দলে উড়িয়ে দেবে। এবং বাকি অর্ধেক সমুদ্রের গভীর পানিতে মিশিয়ে নিঃশেষ করে ফেলবে। । এরপর সে আরও বলল , আল্লাহ্‌ তায়ালা যদি এর পরেও আমাকে জীবিত করতে সক্ষম হন , তাহলে অবশ্যই আমাকে এমন কঠোর শাস্তি দেবেন , যা আমাকে ছাড়া ত্রিভুবনে আর কাউকে দেবেন না ।
লোকটির মৃত্যুর পর পুত্র গন পিতার অন্তিম কালের অসিওত মতো কাজ করল । অতঃপর আল্লাহ্‌ তায়ালা সমুদ্রকে ওই ভস্ম গুলো একত্রিত করার নির্দেশ দিলে সমুদ্র তা একত্রিত করল।এমনি ভাবে স্থল্ভাগের বায়ু মণ্ডলকে ভস্ম গুলো একত্রিত করার নির্দেশ দিলে সে ও তা একত্রিত করল। তখন আল্লাহ্‌ তায়ালা উভয় স্থানের ভস্ম একত্রিত করে তাঁকে জীবিত করলেন । অতঃপর তাঁকে জিজ্ঞেশ করলেন, তুমি এমন অসিওত কেন করলে? সে বলল, হে আমার প্রতিপালক ! আমি যে তোমার শাস্তির ভয়ে এরুপ করেছি। তাত তুমি ভালো ভাবেই অবগত আছো ।অতঃপর আল্লাহ্‌ তায়ালা একে ক্ষমা করে দেন ।
— বুখারি, মুসলিম
হাদিসের বর্ণনা দ্বারা এও জানা যায় যে, মৃত্যুর পর মুমিন বান্দা রা একে ওপরের সাথে দেখা সাক্ষাত করেন। আর নবাগত মৃত মুমিন ব্যাক্তির কাছে অপরাপর মুমিন ব্যাক্তিরা জিজ্ঞেস করে- অমুকের অবস্থা কি? সে কি অবস্থায় আছে?
হযরত সাইড ইবনে জুবায়ের (র) বলতেন, কারো মৃত্যু হলে কবরের জীবনে তাঁর মৃত সন্তানেরা তাঁকে এমন ভাবে সংবরধনা জানায়, যেরূপ পার্থিব জীবনে কোন বহিরাগত লোক কে সংবর্ধনা জানানো হয় ।
— সরহে সুদূর
হযরত ছাবেত বানানি (র) বলেছেন , কারো মৃত্যুর পর কবর জীবনে তাঁর পূর্বে মৃত নিকট-আত্মীয় গন তাঁর কাছে এসে তাঁকে ঘিরে ধরে । তারা পরস্পর এতো বেশি খুশী হয় , যেমন পার্থিব জীবনে বহিরাগত কারো আগমন হলে তাঁর সাথে সাক্ষাতে খুশী হয়ে থাকে ।
— সরহে সুদূর
হযরত কায়েস ইবনে কবায়সা (রা) বলেন রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন ,কেউ মুমিন অবস্থায় মৃত্যু বরন না করলে তাঁকে অন্যান্য মৃতদের সাথে কথা বলার অনুমতি দেয়া হয় না । জনৈক সাহাবী (রাঃ) জিজ্ঞেশ করলেন , ইয়া রাসুলাল্লাহ ! মৃতের সাথে কি অন্যান্য মৃতরা কথা বলতে পারে? রাসুলুল্লাহ (সঃ) বললেন, হা কথা তো বলেই, তদুপরি তাদের পরস্পরের সাথে, দেখা সাক্ষাতও হয় ।
— শরহে সুদুর,বুশরাল কাতিব বিলিকায়েল হাবিব -সুয়ুতি
নবী পত্নি হযরত আয়েশা (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, যে ব্যাক্তি তাঁর মুসলিম ভাইয়ের কবর জেয়ারত করে এবং তাঁর কবরের পাশে বসে , কবরে সমাহিত ব্যাক্তি তাঁকে তাঁর সালামের জবাব দেয় । এবং জেয়ারত কারি চলে আসা পর্যন্ত তাঁকে চিনতে ও বুঝতে সক্ষম হয়।
— ইবনে আবি দুনিয়া ও শরহে সুদূর
হযরত উম্মে বাসার (রা) বলেছেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর কাছে জিজ্ঞেস করলাম , হে আল্লাহর রাসুল ! মৃতরা কি একে অপরকে চিনতে পারে ? তিনি বললেন , তোমার কল্যাণ হোক । মুত্‌মাইন আত্মা (যে সব মুমিনের আত্মা আল্লাহ্‌ তায়ালার ওপর সন্তুষ্ট থাকে,তা ) জান্নাতে সবুজ পাখির হৃদয় অভ্যন্তরে অবস্থান করে। এখন বুঝে নাও পাখিরা যদি বৃক্ষে থাকতে একে অপরকে চিনতে পারে , তাহলে মুমিনের আত্মা সমুহ ও একে অপরকে চিনে নিতে পারবে।
— ইবনে সায়াদ , শরহে সুদূর
হযরত আবু সাইদ খুদরি (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন , যে ব্যাক্তি কুরআন মজিদ পাঠ শিক্ষা শুরু করে শেষ করার পূর্বেই মারা যায় , কবরে একজন ফেরেশতা তাঁকে কোরআন মজিদ শিক্ষা দেন। আর সে আল্লাহ্‌ তায়ালার সাথে এমন অবস্থায় সাক্ষাত করবে যখন সে সম্পূর্ণ কোরআন মজিদের হাফেজ হবে।
— শরহে সুদূর
যারা এই পার্থিব জীবন পুণ্য ময় কর্মে অতিবাহিত করেন এবং মৃত্যুর পরের জীবনের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেন , এই দুনিয়ার প্রতি তাদের মন আকৃষ্ট হয় না ।তারা ইহকালের চেয়ে পরকালের জীবন কে বেশি প্রাধান্য দেন। আর যারা পার্থিব জীবন কে খারাপ ও অন্যায় কাজে অতিবাহিত করে । তারা মৃত্যুর কথা স্মরণেই ভয় পায়।
সলায়মান ইবনে আব্দুল মালেক আবু হাজেম (রঃ) কাছে জিজ্ঞেস করলেন , আমরা মৃত্যু সম্পর্কে কেন ভীত হই বলবেন কি? তিনি বললেন এর কারন হচ্ছে , তোমরা দুনিয়া কে খুব সুন্দর ভাবে আবাদ করো এবং পরকালকে বরবাদ করো । এবং আবাদ কৃত জায়গা হতে বরবাদ কৃত জায়গায় যাওয়া পছন্দ হয় না । সলায়মান বললেন আপনি যথার্থ ই বলেছেন।
— ফিকাতুস সাফওয়াহ্‌, ২য় খণ্ড , ৮৯ পৃষ্ঠা
কবর জীবনের প্রতি যে সন্দেহাতিত ভাবে বিশ্বাস রাখে এবং নিজের পুন্নময় কর্মের প্রতিদানে সেখানে ভালো অবস্থায় থাকার আশা পোষণ করে । আর মনে করে যে পার্থিব জগতের ভাই বন্ধু আত্মীয় স্বজন পরিত্যাগ করে চলে যেতে হবে , কবরের জীবনেও ভাই বন্ধু আত্মীয় স্বজন পরিবার বর্গ সাথে দেখা সাক্ষাত লাভ করে । সুতরাং মৃত্যু কে তারা ভয় কেন পাবে? আর এই ক্ষণস্থায়ী জীবন কে কেনই বা কবরের জীবনের ওপরে প্রাধান্য দেবে? রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন,
মানুষ এই পার্থিব জীবন কে খুব পছন্দ করে ও ভালবাসে । অথচ ম্রিত্তুই হচ্ছে তাঁর জন্য উত্তম ।
— বায়হাকি- শোয়া বুল ঈমান ।
কোন কোন বর্ননায় আছে রাসুলুল্লাহ (সঃ) মুমিনের জন্য মৃত্যুকে উপঢৌকন বলেছেন ।
— বায়হাকি , মেশকাত
তিনি এও বলেছেন ,
যে মানুষ মৃত্যুকে খারাপ জানে ও অপছন্দ করে , অথচ দুনিয়ার ফেতনা – ফাসাদ ও আল্লাহর পরীক্ষায় নিপতিত হবার চেয়ে তাঁর জন্য মৃত্যু উত্তম । মৃত্যু যত তাড়াতাড়ি হবে , তত তাড়াতাড়ি দুনিয়ার ফেতনা ফাসাদ থেকে নিরাপদ হওআ যাবে ।
— শরহে সুদূর
হযরত আনাস (রা) বলেন , রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন , মানুষের দুনিয়া হতে ইন্তেকাল করে পরকালে চলে যাওয়ার উদাহহরন হচ্ছে – শিশু যেমন মায়ের সংকীর্ণ ও অন্ধকার জঠর হতে জন্ম লাভ করে পার্থিব জগতের আলো বাতাসের আরামপ্রদ ও সুন্দর পরিবেশে চলে আসে , অনুরুপ ভাবে মানুষ দুনিয়ার অসান্তিময় জীবন হতে ইন্তেকাল করে, এক বিরাত প্রসস্ত ময় জীবনে পদারপন করে । মত কথা মুমিনের জন্য মৃত্যু খুব উত্তম বিষয় কিন্তু শর্ত হচ্ছে তাঁর জীবন হতে ,হবে পুণ্য ময় জীবন । এবং তাঁর ও আল্লাহ্‌ তায়ালার , মধ্যে কার সম্পর্ক সঠিক ও সুন্দর রাখতে হবে । আল্লাহ্‌ তায়ালার যেসব বান্দা পুন্নময় কর্মে জীবন অতিবাহিত করেন , তারা মৃত্যু কে পার্থিব জীবনের ওপরে প্রাধান্য দেন। পার্থিব জীবনের বিপদ আপদ , ফেতনা ও অস্থিরতা পূর্ণ জীবন থেকে বের হয়ে খুব তাড়াতাড়ি পরকালের চির শান্তি ও সুখ ময় জীবনে পদার্পণ করতে আগ্রহি থাকেন ।
কোন এক সময় হযরত আবু হরায়রা (রা) জনৈক ব্যাক্তি কে জিজ্ঞেশ করলেন কোথায় যাচ্ছ? সে বলল বাজারে যাওয়ার ইচ্ছা রাখি । তখন তিনি বললেন ঃ যদি তোমার পক্ষে সম্ভব হয় , তাহলে আমার জন্য মৃত্যু ক্রয় করে নিয়ে আসবে।
— ইবনে আবু শায়বা , বায়হাকি
এ কথার মর্মার্থ হচ্ছে এ দুনিয়ায় বসবাস করা আমার পছন্দ নয় , যদি মূল্য দ্বারাও মৃত্যু ক্রয় করা যায় , তবে তা ক্রয় করে নেব। হযরত খালেদ ইবনে মায়াদান (রা) বলতেন , যদি কেউ একথা বলে , অমুক জিনিস যে স্পর্শ করবে , তৎক্ষণাৎ সে মারা যাবে । তাহলে আমার পূর্বে কেউ তা স্পর্শ করতে পারবে না । তবে কেউ যদি আমার চেয়ে বেশি দৌড়াতে পারে এবং আমার পূর্বেই তাঁর নিকত পৌঁছে যায় , তাহলে অন্য কথা ।

(সংগৃহীত)

Comments

comments