খবরের বিস্তারিত...


মাইজভাণ্ডারী দর্শন নিয়ে জার্মান অধ্যাপক ড. হান্স হার্দার’র গবেষণা

বছরখানেক আগে ইউটিউবে ‘অ্যামেজিং স্পিচ অব জার্মান প্রফেসর ড. হান্স হার্দার’ শিরোনামে একটি ভিডিও তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। ২০১৫ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ড. হান্স হার্দার বাংলায় যে অনবদ্য ভাষণ দিয়েছিলেন তা শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন উপস্থিত সহস্রাধিক শ্রোতা। অমর একুশে গ্রন্থমেলার সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হার্দারের বাংলায় দেওয়া ভাষণ শুনে অভিভূত হয়েছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
অধ্যাপক ড. হান্স হার্দার জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক দক্ষিণ এশীয় ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের প্রধান। এর আগে তিনি হালে/জালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতবর্ষ বিষয়ক দর্শন শাস্ত্রের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। এই জার্মান শিক্ষাবিদের অনবদ্য কীর্তি হলো- বাংলা সাহিত্যের অনুপম সখা চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য তথা মাইজভাণ্ডারী দর্শন নিয়ে নিরন্তর গবেষণা ও সমৃদ্ধ প্রকাশনা। গত দুই যুগের গবেষণার পর ড. হান্স হার্দার ÔSufism and Saint Veneration in Contemporary Bangladesh : The Maijbhandaris of Chittagong. ও ‘ডার ফেরুখটে গফুর স্প্রিখট’ (পাগলা গফুর, বলে) শিরোনামে দুটি অসাধারণ গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। বই দুটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দারুণ সমাদৃত হয়। হান্সের গবেষণায় চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য-সংস্কৃতি তথা এর পুরোধা ব্যক্তিত্ব আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি লাভ করেছেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ও মাইজভাণ্ডারী গানের কিংবদন্তি রচয়িতা ও শিল্পী আবদুল গফুর হালীর জীবন ও সঙ্গীত নিয়ে প্রকাশিত ‘ডার ফেরুখটে গফুর স্প্রিখট’ গ্রন্থটি বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্বপরিসরে চট্টগ্রামের লোকসাহিত্যকে মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। ড. হান্স হার্দার ১৮ বছর ধরে বাংলা সাহিত্য ও ভারতীয় উপমহাদেশের সুফিবাদ নিয়ে গবেষণা করছেন। হার্দার হালে/জালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করার সময় ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ ও ভারত ভ্রমণ করেন। ওই সময় তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন এবং বাঙালির জীবন, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সঙ্গীত ইত্যকার বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডার দরবার শরিফে এসে তিনি সেখানকার সুফিবাদ-প্রেমবাদে আকৃষ্ট হন। মাইজভাণ্ডারী দর্শন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে মাইজভাণ্ডারী গানের কিংবদন্তি শিল্পী আবদুল গফুর হালীর সঙ্গে তার দেখা ও পরে সখ্যতা। ২০০৪ সালে গফুর হালীর ৭৬টি মাইজভাণ্ডারী গান জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে গফুর হালীর জীবন ও দর্শন নিয়ে ‘ডার ফেরুখটে গফুর স্প্রিখট’ নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশ করেন। বর্তমানে তিনি সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ মন্দিরসহ দুই বাংলার ‘দেবালয়’ নিয়ে গবেষণা করছেন।
কথা হয় ড. হান্স হার্দারের সঙ্গে। ‘মাইজভাণ্ডারের কোন বিষয়টা আপনাকে আকৃষ্ট করে?’ এমন প্রশ্নের একটা দীর্ঘ উত্তরই দেন ড. হানস। বলেন, ‘মাইজভাণ্ডারের যে জিনিসটা আমাকে মুগ্ধ করেছে সেখানকার অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সব ধর্মের সব বর্ণের মানুষের জন্য স্থান আছে ওখানে। এমন চিত্র হয়তো আরও অনেক জায়গায় দেখা যাবে কিন্তু আমি মনে করি মাইজভাণ্ডার এ ক্ষেত্রে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। আর আসাকে সবচেয়ে বেশি টেনেছে মাইজভাণ্ডারী গান। ভক্তরা নেচে নেচে এ গান করেন, এখানে ভক্তির কথা আছে, আছে প্রেম-বিচ্ছেদের কথা। আর সেসব গানে আছে লোকায়ত বাংলার সুর-সেই ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া ও মুর্শিদি গানের ছোঁয়া।’
হান্স জানালেন, গবেষণার কাজে মাইজভাণ্ডারের সবাই তাকে খুব সহায়তা করেছেন। অনেক শিল্পী তাকে গান দিয়ে গানের অর্থ বুঝিয়ে সহযোগিতা করেছেন।
মাইজভাণ্ডারী গানের অনেক প্রসিদ্ধ শিল্পী আছেন, তাদের মধ্য থেকে আবদুল গফুর হালীকে বেছে নিলেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘গফুর ভায়ের গানে পুরুষ প্রেমিকের জন্য নারীর কান্নাকাটি আছে, ভোলা-ভালা (সহজ-সরল) মানুষের কথা আছে। এগুলো খুব ভালো লাগে আমার।’
এক ফাঁকে হান্স জানালেন, পাহাড় তার খুব ভালো লাগে। তিনি সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে গেছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান চন্দ্রনাথ পাহাড় নিয়ে গবেষণা করছেন। বললেন, ‘জার্মানিতে আমার জন্ম সমতলে হলেও আমি বড় হয়েছি পাহাড়ি একটি এলাকায়। এখানকার পাহাড়িদের দেখে আমি মুগ্ধ। আমি মনে করি, চট্টগ্রাম শহরে পাহাড় হলো একটি দেখার মতো জিনিস।’
হান্সের কথা, বাংলাদেশের মধ্যে চট্টগ্রাম তার খুব পছন্দের। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান নিয়েও তার কাজ করার ইচ্ছা। কিন্তু ভাষাটা রপ্ত করতে পারেননি এখনও। হান্স বলেন, সিলেটের হযরত শাহজালালের (র.) মাজারে গেছেন, পটিয়ার আমির ভাণ্ডারে গেছেন। মাইজভাণ্ডারী গানের ভাবে, চন্দ্রনাথ পাহাড়ের গাছের মায়ায় মজে গেছেন তিনি।
ড. হান্স হার্দার বলেন, ‘আমি ১৯৯৯ সালে যখন মাইজভাণ্ডার গিয়ে মাইজভাণ্ডারী দরবার-দর্শন-তরিকা নিয়ে গবেষণা শুরু করি, তখন এসব কিছুই বুঝতাম না। মদ্যযুগীয় বাংলা ভক্তিগীতি অল্প-একটু পড়ে গিয়েছিলাম বটে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে গেলে ‘পরশ’ লাগেনি। আবদুল গফুর হালীর গান পড়তে, তার সংস্পর্শে এসে, তার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই আমি উপলব্ধি করতে পারলাম যে, বিচ্ছেদের গানের বিচ্ছেদটা কত তীব্র, কত সার্বভৌমিক, কত আধুনিক হতে পারে।’
চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য সম্পর্কে ড. হান্স বলেন, ‘আবদুল গফুর হালীর গানের একটি কলি এমন- ‘টলমল মানব জীবন/কচুপাতার পানি যেমন।’ এমন সমাজ ব্যবস্থা, প্রাচীন হোক বা আধুনিক হোক, কল্পনা করা মুশকিল যেখানে এমন কথা ভাবের আলোড়ন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়।
ড. হান্স হার্দার জানান, ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলায় ভাষণ প্রদান সম্পর্কে ড. হান্স হার্দার বলেন, ‘সেবার বাংলা একাডেমি বাংলাচর্চায় বিশিষ্ট চারজন বিদেশিকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ যে আতিথেয়তা দিয়েছে তা জীবনেও ভুলতে পারব না। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ গুণীজনদের সামনে বাংলায় ভাষণ দিতে পেরে আমি গর্বিত। প্রধানমন্ত্রী মুগ্ধ হয়ে আমার ভাষণ শুনেছেন, বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে বলা আমার দু’চার কথা মানুষকে আকৃষ্ট করেছে, এ পরম পাওয়া। আমি সারাজীবন বাংলা ও বাঙালি নিয়ে কাজ করতে চাই।’

Comments

comments