আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির জীবন পরিক্রমা
আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ১৩৩৬ হিজরী অনুসারে ১৯১৬ সালে বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে হাজারা জিলার সিরিকোট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি ছিলেন প্রখ্যাত অলি-ই কামিল কুতুবুল আউলিয়া আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র দ্বিতীয় পুত্র। বংশ পরম্পরায় তিনি ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র ৩৭তম বংশধর। তিনি পিতৃকুল-মাতৃকুল দিক দিয়ে ছিলেন সৈয়্যদ বংশীয়। তাঁর শিরা-উপশিরায় সঞ্চালিত বংশ পরম্পরায় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র পূতঃপবিত্র রক্তধারা ও পুরুষানুক্রমে লব্ধ মহাসাধকের শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক সোপান অতিক্রমে সক্ষম হন। তাঁর জন্মের পূর্বে ও শৈশবে সংঘটিত ঘটনাসমূহ দ্বারা এ কথা প্রতীয়মান হয়। সে সব ঘটনা হতে কয়েকটি উদ্ধৃত করা হল :
১.একদা আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর পীর খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র খিদমতে উপস্থিত হন, তখন খাজা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি নিজের পৃষ্ঠদেশে আল্লামা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র শাহাদাত আঙ্গুলি রেখে ঘর্ষণ করে বলেন- ‘يه پاك چيزتم لے لو’ “এ পবিত্র বস্তু তুমি নিয়ে নাও”। যেমনটি গাউসুল আযম শায়খ আবদুল ক্বাদির জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এরূপে শায়খ আলী ইবন মুহাম্মদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র পৃষ্ঠদেশ ঘর্ষণ করে সন্তান দান করেছিলেন। পরে ঐ সন্তান ইবনুল আরবী নামে খ্যাতি লাভ করেন।
২. আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র জন্মের ৬/৭ মাস পর খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সিরিকোটে আগমন করেন। তখন তাঁকে শিরণী খাওয়ানোর সময় খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেন, ‘طيب تم نهيں كهاتے تم هم بهى نهيں كهائنگے’ “তৈয়্যব তুমি না খেলে আমরাও খাব না” এ কথা শুনে তিনি শিরণী খেতে লাগলেন।
৩. আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র বয়স যখন প্রায় দু’বছর, তখন তাঁর আম্মাজান তাঁকে নিয়ে খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র খিদমতে উপস্থিত হন। সেখানে অবস্থানকালে খাজা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র সম্মুখে তিনি শিশুসূলভ অভ্যাসে মায়ের দুধপান করতে চাইলেন। তখন খাজা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেন, ‘تم بڑهاهوگيا دوده مت پيو ’ “ তুমি বড় হয়েছ, দুধপান কর না”। পরে তিনি আর মায়ের দুধ পান করেননি। শত চেষ্টা করেও তাঁকে আর দুধ পান করানো সম্ভব হয়নি।
এখানে উল্লেখ করা যায় যে, আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ছিলেন মূলত: আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র প্রতি তাঁর পীর খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র আল্লাহ্ প্রদত্ত উপহার। কেননা তখন আল্লামা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র বয়স ছিল প্রায় ৬০ বছর। সাধারণত বৃদ্ধ বয়সের সন্তান দুর্বল হয় এবং বংশ পরম্পরা দীর্ঘ হয় না। তাই তা খণ্ডন পূর্বক আল্লামা চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ‘পাক ছিজ’ উল্লেখ করে পুত্র ও নাতি উভয়ের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। কারণ ‘পাক’ শব্দের আরবী প্রতিশব্দ ‘তৈয়্যব’ ও ‘তাহির’ যেমনটি আল্লাহ্ ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম-এর নিকট ইসহাক আলায়হিস্ সালামকে দান করার ক্ষেত্রে ইয়াকুব আলায়হিস্ সালাম-এর কথা উল্লেখ করেছেন।
১৯১২ সালে পীরের দরবারে আসার পর হতে তাঁর উপর সদা পীর-মুরশিদের সদয়দৃষ্টি বিরাজমান ছিল বিধায় মাত্র চার বছরে আল্লামা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি স্বীয় পীরের দরবার হতে প্রাপ্ত হন এমন এক পবিত্র সন্তান, যিনি জন্ম থেকেই আধ্যাত্মিক চর্চায় তৎপর এবং আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের অনুগত। প্রয়োজন ও চাওয়ার আগে প্রাপ্ত দান বরকতপূর্ণ, পূতঃপবিত্র এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞান-গরিমায় পরিপূর্ণ হবেন, তা উপরিউক্ত কর্ম দ্বারা সুস্পষ্ট। অধিকন্তু আল্ল¬ামা চৌহরভীর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র তাওয়াজ্জুতে আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বড় হন। এছাড়াও আয়াতের আলোকে বলা যায় আল্লাহ্ তা‘আলার প্রদত্ত এ ধরনের বংশধরগণ হয়ে থাকেন জন্মগতভাবে হিদায়তপ্রাপ্ত, সৎকর্মশীল, মর্যাদাবান এবং হিদায়তকারী। তাই শৈশব কাল থেকেই আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র মাঝে সুপ্ত আধ্যাত্মিক প্রতিভা বিকশিত হয়ে আসছিল। তিনি শৈশবে পিতার সান্নিধ্য লাভ করেছেন মাত্র চার বছর বয়স পর্যন্ত; কিন্তু ইতিমধ্যে পিতার নিকট আরজ করে বসলেন, ‘نماز ميں اپ الله كو ديكهتے هيں مجهے ديكهنا هے ’ “ নামাযে আপনি আল্লাহকে দেখেন, আমারও আল্লাহকে দেখা চাই”।
আরো উল্লেখ আছে যে, আল্লামা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি স্বীয় পীরের নির্দেশে ১৯২০ সালে বার্মায় গমনের আগে কোন এক সময় সপরিবারে আজমীর শরীফ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে গমন করেন। সেখানে খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র মাযার চত্বরে শিশু তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি আপন মনে ঘুরাফেরা করতে থাকেন; তখন হঠাৎ এক নূরানী লোক এসে তাঁকে পাশে বসায়ে কিছু দু‘আ পড়লেন-পড়ালেন, ঐ সময় আল্লামা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এক খাদিমের ঘরে অবস্থান করছিলেন। পরে তিনি জানতে পেরে বললেন, ‘ بيٹها وه تو خواجه تهے’ ‘‘বৎস! উনি তো খাজা ছিলেন”।
বস্তুত এ সবই ছিল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র প্রতি মহান আল্লাহ’র বিশেষ অনুগ্রহ। তাই এভাবে শৈশব হতে তাঁর থেকে অলিত্ব ও আধ্যাত্মিকতা প্রকাশ হতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন মহানবীর নূরের আলোকচ্ছটা, আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র আর্শীবাদ, মাতৃগর্ভজাত অলি এবং পিতার যোগ্য উত্তরসূরি। প্রাথমিক শিক্ষা তিনি পিতার নিকট হতে গ্রহণ করেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। তবে তিনি স্থানীয় উস্তাদের নিকট মাত্র ১১ বছর বয়সে কুরআন মজিদ হিফয সমাপ্ত করেন। কুরআন মজিদ হিফয করার সময় সংঘটিত একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ঘটনাটি এই- একদা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র সম্মানিত শিক্ষক স্বপ্নযোগে প্রিয়নবী হযরত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’র সাক্ষাত লাভে ধন্য হন। ঐ সময় প্রিয়নবী উক্ত শিক্ষককে খবর প্রদান করেন যে, ছাত্রদের মধ্যে তাঁর একজন বংশধর আছেন, যেন তাঁর যত্ন নেয়। অতঃপর উক্ত শিক্ষকের ঘুম ভেঙ্গে যায়। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন, কে সেই ? তাই দেরী না করে পরীক্ষা করলেন এভাবে – তিনি প্রত্যেক ছাত্রকে একটি করে কমলা দিয়ে বললেন, যাও! তোমাদের হাতের কমলা এমনভাবে খাও, যাতে আল্লাহ তা‘আলা না দেখেন। শিক্ষকের নির্দেশ পেয়ে প্রত্যেক শিশু নিজ নিজ মত করে কমলা খেয়ে আসল; কিন্তু শিশু তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি কমলাটি উক্ত শিক্ষককে ফেরত দিয়ে বললেন-‘আল্লাহ হার জাগা মে হ্যায়’ “আল্লাহ প্রত্যেক জায়গায় আছেন”। এ কথা শুনে শিক্ষক মহোদয় আওরাদ-ই রাসূলের পরিচয় পেয়ে গেলেন।
কুরআন মজিদ হিফয সমাপ্ত করার পর আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে সকল শাখা-প্রশাখায় প্রায় ষোল বছর যাবৎ বুৎপত্তি অর্জন করেন। প্রখর মেধা, তীক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তা ও অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী এ মহান ব্যক্তি সাতাশ বছর বয়সে যাহিরী জ্ঞার্নাজন সম্পন্ন করেন ও সর্বশেষ সনদ লাভ করেন। তাঁর উস্তাদগণের মধ্যে আল্লামা হাফিয আবদুর রহমান, আল্লামা হাফিয আবদুল হামিদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও তিনি এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে দু’শতাধিক নবী, সাহাবী ও অলির মাযার শরীফ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করেন ও তাঁদের ফয়েজ লাভে ধন্য হন।
তিনি ছিলেন আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’আতের একনিষ্ঠ সেবক, হানাফী মাযহাবের অনুসারী, ক্বাদিরীয়া ত্বরীকার সফল প্রচারক, সুন্নত-ই রাসুলের জীবন্ত কায়া, যুগের মুজাদ্দিদ (সংস্কারক) এবং অসহায় মুসলিম জনতার দিশারী। ১৯৫৮ সালে তিনি পিতা হতে খিলাফতপ্রাপ্ত হন। এ যাবৎ যাঁরা আল্ল¬ামা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হতে খিলাফত প্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁদের আমন্ত্রণে পিতার ইন্তেকালের পর ১৯৬১ সালে তিনি অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য এ বাংলাদেশে শুভাগমন করেন। অবশ্য ইতিপূর্বে ১৯৪২ সনে চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম তাঁর আগমনের তথ্য পাওয়া যায়। স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৭৬ সালে আগমন করেন এবং ১৯৮৬ অবধি এ দেশে এসে শরী‘আত-ত্বরীকতের দিক-নির্দেশনা প্রদান করে সুন্নীয়তের নেতৃত্ব দেন। অধিকন্তু তাঁর পিতা আল্লামা সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি জীবদ্দশায় অসুস্থতা থাকার সময়ে কেবল তাঁকেই ইমামতির স্থলাভিষিক্ত করা হয়।
মূলত এখানেও বিষয়টি মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসরণ। যেমন, মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর চার খলীফাদের হতে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে প্রধান খলিফা বলেননি কিন্তু তাঁর মহান মর্যাদা তুলে ধরেন এবং ইমামতির মত গুরু দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকে নির্দেশ প্রদান করেন। এ ছাড়াও তিনি যে এ সিলসিলার অসর্ম্পূণ কাজ সম্পাদন করবেন, তা ইতিপূর্বে তাঁর পিতা ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন এবং তাঁর মহান মর্যাদা তুলে ধরেছেন। শরীয়ত-ত্বরীকত ভক্তকুলের মাঝে প্রচার-প্রসারের জন্য এ দেশে অর্ধশতাধিক মাদ্রাসা, মসজিদ, খানকাহ প্রতিষ্ঠিত করে তিনি এ কথার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
তাঁর মতে, হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি মুহাব্বত-ই প্রকৃত ঈমান। আন্তরিকতা, মুহাব্বত এবং ইশক্ব দ্বারা সে রাজ বা রহস্য অর্জন হয়; যা কারোর স্বপ্নে ও খেয়াল বা ধারণায়ও হয় না। সে জন্য আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর ভক্ত-অনুরক্তদের মাঝে লুকিয়ে থাকা সে ইশক্বকে উদ্দীপ্ত করতে তাঁর পিতা কর্তৃক প্রচারিত সিলসিলায়ে কাদেরিয়া আলীয়ায় প্রচলিত খতম-এ গাউছিয়া আদায় পদ্ধতি নতুনরূপে বিন্যাস করেন। হামদ-না‘ত, কাসীদা-দুরূদ পরিবেশন সংযোজন করেন এবং শায়খগণের নামের তালিকা তথা শাজরাকে ছন্দোবদ্ধ চিত্তার্কষক করে প্রণয়ন করেন। কারণ সুমধুর এবং ছন্দযুক্ত সুর শ্রবণে ও পাঠে মানব হৃদয়ে যে অনির্বচনীয় অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তা নিঃসন্দেহে অপ্রতিরুদ্ধ হয়। এ জন্য দেখা গেছে – এ অঞ্চলে প্রতিটি ঘরে ঘরে, পাড়ায়-মহল্লায় তাঁর নির্দেশিত খতম-এ গাউছিয়া শরীফ দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ফলে প্রত্যেক আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মুখে অশালীন গানের পরিবর্তে নবী-অলিগণের প্রশস্তি লক্ষ্য করা গেছে। অনেকেই এ গাউছিয়া ও শাজরা শরীফ শ্রবণে হিদায়তপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাদের মন-মগজে জাগরিত হয়েছে র্ধমীয় অনুভূতি। ইবাদত-বন্দেগী তাদের নিত্যসঙ্গীর রূপ লাভ করেছে।
শরীয়ত-ত্বরীকতের এ দিকপাল সরলমনা সাধারণ মুসলমানদের মনে খতম-এ গাউছিয়া শরীফের মাধ্যমে ইশক্ব-ই রাসূলের যে মশাল প্রজ্জলিত করেন, সে প্রেমানলকে আরো আন্দোলিত করতে তিনি এ দেশে প্রবর্তন করেন ৯ ও ১২ রবিউল আউয়াল জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং ইসলামের সঠিক রূপরেখা আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’আতের সাথে তাদের পরিচয় করে দিতে তিনি আযানের আগে সালাত ও সালাম পাঠ প্রচলন করেন। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে প্রতিষ্ঠা করেন গাউসিয়া কমিঠি বাংলাদেশ। শরিয়ত ও তরিকত বিষয়ে জ্ঞাণভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার উদ্দেশ্যে তরজুমান-এ আহলে সুন্নত ওয়াল জমা’আত নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশেরও ব্যবস্থা করেন তিনি। পাশাপাশি এ সবের স্থায়ী ব্যবস্থা করতে গড়ে তোলেন অসংখ্য দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ। তাঁরই অকান্ত পরিশ্রমে এ অঞ্চলের সুন্নী মুসলিম জনতার মুখে আজ অহরহ শোভা বর্ধন করছে পবিত্র কুর’আনের আয়াত, হামদ, না’ত এবং মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসুল, অলি-বুর্যগদের স্তুতি-গুণর্কীতন। সদা-সর্বদা তাঁর মাঝে বিরাজ করত এক ধরনের স্নিগ্ধ, শান্ত, মায়াবী ও নূরাণী আভা। এ জন্য তাঁর সান্নিধ্য প্রাপ্ত সকলকেই বলতে শুনা যায়, “তিনি আমাকেই বেশী ভালবাসতেন”। এ নিয়ে তাদের গর্ববোধের অন্ত নেই। কিন্তু যখনই নবী-অলির মান-মর্যাদা সম্পর্কে সামান্যতম অসঙ্গতিপূর্ণ একটি শব্দও শুনতেন, তৎক্ষণাৎ সকল প্রতিকূলতার মাঝেও প্রতিবাদ করতেন, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতেন এবং দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতেন।
তিনি ছিলেন যুগের শ্রেষ্ঠ বিদ্বান, বাগ্মী, যুক্তিবিদ ও চিন্তাবিদ। প্রত্যেহ তিনি ফজর নামাজের পর বক্তব্য পেশ করতেন। দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা অনেক আলিম তাঁর মজলিশে ভিড় জমাতেন এবং বসতে পেরে উৎফুল্ল¬ ও পরিতৃপ্ত হতেন। অনেকে আবার তাঁর মুরীদও হয়ে যান। র্নিভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে,তিনি অসংখ্য মাদ্রাসা ও দ্বীনি শিক্ষার্থীদেরকে সংগোপনে আর্থিক সাহায্য করতেন। তাই তারা তাঁকে একজন দানশীল ব্যক্তি হিসেবে জানতেন এবং সপ্তাহ/মাসান্তে তাঁর নিকট চলে আসতেন। তদুপরি পিতার ইন্তিকালের পর তিনি ছিলেন হরিপুরস্থ ইসলামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসার আজীবন পরিচালক ও অধ্যক্ষ।
বাস্তবিকপক্ষে, আল্লাহ তা‘আলার প্রতি দৃঢ় আস্থাই ছিল তাঁর ভিত্, ইশক্বে রাসুল ছিল তাঁর প্রেরণা, সুন্নাত ছিল তাঁর দৈনন্দিন কার্য প্রণালী, উস্ওয়া-ই হাসানা ছিল তাঁর মডেল, শরীয়ত-ত্বরীকত ছিল তাঁর মজলিসের উৎস, দয়া ছিল তাঁর পরশ এবং আউলিয়া-ওলামা, ফকীর-মিসকীন ছিলেন তাঁর সহচর। তাঁর প্রবর্তিত সকল কর্মসূচি এখনও পর্যন্ত এ সবের সাক্ষ্য-প্রমাণ বহন করে আছে। তিনি ছিলেন মহানবীর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ৩৯তম বংশধর। সেজন্য ওয়ারিশ সূত্রে দ্বীন-ই ইসলামের তাবলীগের যে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন, তা পালনে তিনি প্রাণপন সচেষ্ট ছিলেন। সারাক্ষণ কর্ম ব্যস্ততার মাঝে তিনি ডুবে থাকতেন। দ্বীন ইসলামের তাবলীগের জন্য তিনি দিবা-নিশি কখনো এ জায়গায় আবার কখনো অন্য জায়গায় ছুটে যেতেন। তারপরও ইবাদত রিয়াজত হতে পিছপা ছিলেন না; বরং যখন সফর সঙ্গীরা ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহ-মনে গভীর নিদ্রাচ্ছন্ন থাকতেন,তখন তিনি নিজ কক্ষে নামাযের জন্য দাঁড়িয়ে নিবৃত্তে একাকী ইবাদতে মশগুল থাকতেন। যখন তাঁর বিশ্রামের প্রয়োজন হত, তখন তিনি মেঝেতে ক্বিবলামুখী হয়ে শুয়ে পড়তেন আর তাঁর মাথাটি স্বীয় ডান হাতের কনুইতে ভর দিয়ে তিন আঙ্গুলের উপর রাখতেন।
বলাবাহুল্য, তিনি তাবলীগের কারণে কখনো সংসার বিমুখ ছিলেন না। তিনি ছিলেন দুই পুত্র ও এক কন্যার আর্দশ পিতা। নিজ পরিবারের প্রতি ছিলেন যত্নশীল। এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি নিজ সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি করে গড়ে তোলেন। ফলে তাঁরাও আধ্যাত্মিকতায় চরম উৎর্কষতা সাধনে সক্ষম হন।
এ কারণে ১৯৮৭ সাল হতে তাঁর জৈষ্ঠ্যপুত্র আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহির শাহ (ম.জি.আ.)কে একদিকে তাঁর পরিচালিত মিশনটিকে বেগবান করার দায়িত্ব অর্পণ করে নিশ্চিন্তে অবকাশ যাপন করেন। অন্যদিকে তিনি কেবল হরিপুরস্থ মাদ্রাসার কাজ ও বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া নিজ গৃহ থেকে বের হওয়া হতে বিরত থাকেন। শুধু আগত মেহমানদের সাক্ষাৎ দিতেন তিনি।
এ সুযোগে তিনি ইবাদত-রিয়াযতে আরো বেশী মনোনিবেশ করতে থাকেন। জানা যায় যে, তিনি কয়েকটি গ্রন্থও প্রণয়ন করেন। গ্রন্থগুলোর পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে।
অবশেষে এ অবস্থায় প্রায় ৭৭ বছর বয়সে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুন, ১৪১৩ হিজরির ১৫ যিলহজ্ব সোমবার সাড়ে নয়টার দিকে তাসবীহ পাঠ কালে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় চির বিশ্রাম গ্রহণ করেন তিনি। অতঃপর নিজ গ্রামে নামাযে জানাযার পর তাঁর পিতা আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হির মাযারের পার্শ্বে মসজিদের কার্নিসের নিচে তাঁকে চির নিদ্রায় শায়িত করা হয়।
আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অপরিমেয় প্রতিভাধর একজন সাধারণ বেশ-ভূষার অসাধারণ এ আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ সারা জীবন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বন্দনা করেছেন, ধর্মানূভুতি জাগরণের মাধ্যমে মুসলিম জাতিকে একাত্ম হবার পথ দেখিয়েছেন, মানবতা বা মনুষ্যত্ব বোধের পূর্ণ বিকাশের একমাত্র অনুকরণীয় আদর্শ মহানবীর জয়গান করেছেন। মূলত তিনি মুসলমানদের অন্তরে লুকিয়ে থাকা সে-ই ইশক্বকে উদ্দীপ্ত করেন এবং রাসুল প্রেমের দহনে ঈমানী শক্তিতে মহীয়ান-গরীয়ান করে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন।
(সংগৃহীত)