বাংলাদেশে কাদেরীয়া তরীক্বার প্রতিষ্ঠাতা হযরত বাবা আদম শহীদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি
প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিক্রমপুর (মুন্সীগঞ্জ) ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মুন্সীগঞ্জের আদি নাম হচ্ছে বিক্রমপুর। প্রাচীন বাংলায় এই বিক্রমপুর নামটি একটি গুরুত্ব বহন করে। তা হচ্ছে, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে এবং ধর্ম প্রচার ক্ষেত্রে। কারণ, বিক্রমপুর ছিল প্রাচীন বাংলার রাজধানী। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য নিবেদিত প্রাণ আলেমরা এখানে এসেছিলেন। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার আগেই তাঁরা একটি কাক্সিক্ষত পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন। বৌদ্ধ ও হিন্দু যুগে আরব হতে অনেক সূফী দরবেশ ইসলাম প্রচারের জন্য মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরে আগমন করেন। আর সে সময় যে কজন সুফি সাধক ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে বাবা আদম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন অন্যতম আধ্যাত্মিক ব্যক্তি। বঙ্গ-ভারতে মধ্যযুগে যে কজন সুফি দরবেশ ইসলাম প্রচারের জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন বাবা আদম শহীদ তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
পরিচিতি
বাবা আদম শহীদের কাহিনীর বেশির ভাগ অংশ জুড়েই রয়েছে কিংবদন্তি। সেই কিংবদন্তি থেকেই কিছু কিছু ঘটনা বের করে আনতে হয়। কোথায় তাঁর জন্মভূমি, কত বছর তিনি বেঁচেছিলেন, তার জন্মসাল, মৃত্যুসাল নিয়ে এখনো পরিস্কার কিছু জানা যায় না। একসময় হয়তো সব কিছুই সংশ্লিষ্ট সবার কাছে পরিচিত ছিল, এখন তা পাওয়া যাচ্ছে না।
‘প্রাচীন ভারতবর্ষে ইসলামের আবির্ভাব এবং হযরত বাবা আদম শহীদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি গ্রন্থের লেখক মুজিবর রহমান মাখন উল্লেখ করেছেন, হযরত বাবা আদম শহীদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি জন্মগ্রহণ করেন পবিত্র আরব দেশের মক্কা নগর থেকে কিছুটা দূরের শহর তায়েফ নগরীতে। তিনি কত সালে জন্মগ্রহণ করেন এ ব্যাপারে লেখক কিছু জানাতে পারেনি। তবে ১০৯৯ সালে জেরুজালেম ক্রসডে তাঁর বাবা শহীদ হন এবং পক্ষকাল পরে অর্থ্যাৎ ১০৯৯ সালেই বাবা আদম জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর খোরাসান প্রদেশে গমন করে শিক্ষার বিভিন্ন স্তর পার করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য বাগদাদের ‘জামেয়া নিজামিয়া’ বা নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করেন।
তিনি কিশোর বয়স থেকেই আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনার দিকে ঝুঁকে পড়েন, এ লক্ষ্যে বাবা আদম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য বর্তমান ইরাকের বাগদাদে বড়পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির (জন্ম: ১০৭৭ খ্রিস্টাব্দ মুতাবিক ৪৭০ হিজরীর রমযান মাসের ১ তারিখ, ইন্তিকাল ৫৬১ হিজরি মুতাবিক ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ রবিউস্ সানি সোমবার রাতের শেষ প্রহরে) সাহচর্যে আসেন এবং তাসাউফ দীক্ষায় শেষ স্তর অতিক্রম করেন ও খেলাফত প্রাপ্ত হন।
বাংলাদেশে বাবা আদম শহীদের আগমন
বঙ্গে বাবা আদম নামে তিনজন আউলিয়ার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তাঁদের মধ্যে ময়মনসিংহ জেলার বাবা আদাম কাশ্মিরী, পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার বাহেরা গ্রামে আদমপীর। আর বাবা আদম শহীদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা ব্যক্তিত্ব।
বাবা আদম শহীদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ১১৪২ খিস্টাব্দে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে ১২ জন আরবীয় নাগরিক নিয়ে বাণিজ্য জাহাজযোগে চট্টগ্রাম পৌঁছান। “প্রাচীন ভারতবর্ষে ইসলামের আবির্ভাব এবং হযরত বাবা আদম শহীদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি” গ্রন্থের লেখক মুজিবর রহমান মাখন উল্লেখ করেছেন, মুর্শিদের (বড়পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির) আদেশে প্রাচীন ভারতবর্ষে আসেন ১১৪২ খ্রিস্টাব্দে। ১১৪২ সালেই তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রামে আসেন এবং সেখান থেকে ১১৫২ সালে আসেন মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরে।
শাহ হুমায়ুন কবির “ঞযব ইধঃঃষব ড়ভ কধহধর ঈযধহমঁব” গ্রন্থে বলেন, বাবা আদম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রথমে মহাস্থানগড়ের দরগাহবাড়িতে ১১৭৩ সালে “খানকায়ে কাদেরিয়া” স্থাপন করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তিনি মুন্সীগঞ্জ এলাকার কপালদুয়ার, মানিকেশ্বর ও ধীপুরে আরও তিনটি খানকা নির্মাণ করে ইসলাম প্রচার করেন। এ তিনটি খানকায় যথাক্রমে সৈয়দ জোবায়ের রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, শহীদ মুয়াবিয়ান আল বসরি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ও শেখ মখদুম আল মুয়াসসিস রাহমাতুল্লাহি আলাইহি দায়িত্বে থাকেন।
তার সফরসঙ্গী ১২ জন আউলিয়ার অধীনে ১২টি মিশন গঠন করে এলাকায় পানির অভাব দূর করতে পুকুর খনন, শিক্ষা, চিকিৎসাসেবা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১২ জন ওলি বাবা আদমের নেতৃত্বে ইসলাম প্রচারে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন। বিক্রমপুর, মহাস্থানগড়, চট্টগ্রাম, নাঙ্গলকোট, বাঙ্গাল, দেবকোট, ইন্দ্রপস্ত, প্রয়াগ, পাটুলীপুত্র, নাগপুর, দাক্ষিণাত্য বর্তমানে পু-বর্ধন এলাকায় ইসলাম প্রচার করেন।
১২ জন ওলির মধ্যে ৫ জনের মাযার মুন্সীগঞ্জে অবস্থিত। তাঁরা হলেন: ১. শেখ মখদুম আলমুয়াস্সিস রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মাযার দরগাহ বাড়ী, মুন্সীগঞ্জ, ২. আযযারিয়া বিন সাঈদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, ধীপুর, মুন্সীগঞ্জ, ৩. খুবরাত ইবনে মুদাককিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মাযার মুন্সীগঞ্জে ৪. ইমামুদ্দীন বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মাযার মুন্সীগঞ্জে, ৫. মুয়াবিয়ান আল বসরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি মুন্সীগঞ্জে।
এছাড়াও বাবা আদম রাহমাতুল্লাহি আলাইহির কয়েকজন বিখ্যাত খলিফা বিক্রমপুরে (মুন্সীগঞ্জ) কয়েকটি মিশন পরিচালনা করতেন। এদের মধ্য কেওয়ার ও রাম গোপালপুর ১১৫২-তে ইসলাম প্রচার করেন। তাঁদের নামের মাযার শনাক্ত করা যায়নি।
রাজা বল্লাল সেনের সাথে হযরত বাবা আদম শহীদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির যুদ্ধের কারণ
তখন বাংলায় সেন শাসন আমল চলছিল। এলাকাটি ছিল বল্লাল সেনের অধীনে। জনশ্রুতি আছে যে, বল্লাল সেন ছিলেন অত্যন্ত অত্যাচারি এক শাসক। তিনি ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বশবর্তী হয়ে তার এলাকার মসজিদ গুলোকে মন্দিরে পরিণত করেন এবং এলাকায় মসজিদে আযান দেয়া ও গরু জবাই করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু বাবা আদম এসে রাজধানী রামপালের উপকন্ঠে দরগাবাড়িতে এসে ঘাঁটি গাড়েন। বাবা আদমের খানকাহ নির্মিত হয়, দিন দিন মুসলমানের সংখ্যা বেড়ে যেতে লাগল, সেই এলাকায় আবার গরু-মহিষ জবাই দিতে শুরু করলেন এবং মসজিদে আযান দিয়ে নামায পড়া শুরু করলেন, ইসলামী আচার অনুষ্ঠান প্রকাশ্যেই পালন করা শুরু করেন।
এতে বল্লাল ক্রুদ্ধ হয়ে নবাগত মুসলিম সৈন্যবাহিনীর নেতা বাবা আদমের কাছে কয়েকটি দাবী রেখে দূত পাঠান। দূত এসে বাবা আদমকে বলেন, “হয় বিক্রমপুর ছেড়ে চলে যাও নয় পৌত্তলিকতা বিরোধী আচার অনুষ্ঠান প্রতিপালন থেকে বিরত হও।” কিন্তু অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন দরবেশ বাবা আদম এতে দমবার পত্র নন। তিনি তাঁর অসংখ্য ভক্তের সমর্থনে নিশ্চিত হয়ে পরাক্রমশালী বল্লাল সেনের কাছে এক কঠোর উত্তর পাঠালেন। তিনি বললেন, “একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই এবং হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রসূল। পৌত্তলিক বল্লাল রাজা যাই বলুন না কেন আর যাই করুন না কেন আমি এবং আমার সমর্থকগণ আমাদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান প্রতিপালন থেকে এক চুল পরিমাণও বিরত হব না”।
এহেন কঠোর উত্তরে রাগান্বিত হয়ে বল্লাল সেন সৈন্য সংগ্রহ করে বাবা আদমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করলেন।
কারও কারও মতে, হযরত বাবা আদম শহীদ ১১৭৪ সালে বড়পীর আবদুল কাদের জিলানি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর ওফাত বার্ষিকীতে টঙ্গীবাড়ির আবদুল্লাহপুরে গরু জবাই করে “ফাতেহায়ে ইয়াযদাহুম” এবং “গেয়ারভী শরীফ” পালন করেন। গরু জবাই করা হলে বল্লাল সেন রাগে খানকার দায়িত্বে নিয়োজিত মুয়াবিয়ান আল বসরিকে অন্ধকূপে নিক্ষেপ করে শহীদ করেন। এতে বাংলার বিভিন্ন স্থানে থাকা সুফিরা বল্লাল সেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
আবার কারও কারও মতে, ইসলাম প্রচারের সময় রাজা বল্লাল সেনের রাজকর্মচারীদের সঙ্গে সুফি শেখ মখদুম আল মুয়াসসিসের বিরোধ সৃষ্টি হয়। রাজা বল্লাল সেন তাঁকে টঙ্গীবাড়ী ধীপুর থেকে কারারুদ্ধ করেন। এ খবর শুনে বাবা আদম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি মহাস্থানগড় থেকে বিক্রিমপুর আসেন। কারাগারে শেখ মুখদুমকে দেখে তাঁর অনুপম চরিত্র ও ইবাদত-বন্দেগীতে আকৃষ্ঠ হয়ে বল্লাল সেনের ভাগ্নে অজয় সেনের একমাত্র কন্যা মাধুরী সেন ইসলাম গ্রহণ করেন শুনে রাজা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
যাই হোক, এক বা একাধিক কারণে রাজা বল্লাল সেন এবং হযরত বাবা আদম শহীদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মধ্যকার যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ইঠে।
রাজা বল্লাল সেনের সাথে হযরত বাবা আদম শহীদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির যুদ্ধ ও হযরত বাবা আদম শহীদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির শাহাদাত বরণ
১১৭৪ সালে বিক্রমপুরের কালাইচং ময়দানে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সে ধর্মযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন বাবা আদম শহীদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি । এভাবে কয়েকবার সম্মুখ ও নৌ-যুদ্ধুও হয়েছিল বাবা আদম রাহমাতুল্লাহি আলাইহির সঙ্গে বল্লাল সেনের।
কথিত আছে, ১০ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ১১৭৮ সালে মুন্সীগঞ্জে কানাইচং ময়দানে ১০ দিনব্যাপী প্রচন্ড যুদ্ধে বহু সংখ্যক সৈন্য ও মুজাহিদ নিহত হন। এ যুদ্ধে বল্লাল সেনের সৈন্য ছিল ২০ হাজার, অপরদিকে মুজাহিদ ও সেচ্ছাসেবক বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৭ হাজার। সেই যুদ্ধ ১৫ দিন স্থায়ী হয়েছিল। যুদ্ধের প্রথম ১৪ দিন জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়নি। শেষ দিন রাজা বল্লাল সেন নিজে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই যুদ্ধে বল্লাল সেন পরাজিত হবার আশঙ্কা করেন। তিনি বিপুল মুসলমান বাহিনী দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যান এবং যুদ্ধে পরাজয়ের আশংকায় বল্লাল সেন ২০ সেপ্টেম্বর ১১৭৮ সালে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব করলে বাবা আদম সরল বিশ্বাসে মেনে নেন। সেদিন রাতে ঘটে বিশ্বাসঘাতকতা। বিক্রমপুরের দরগাহ বাড়িতে এশার নামাযের পর বাবা আদম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি মোরাকাবা থাকা অবস্থায় বল্লাল সেন তার তরবারি দিয়ে তাঁকে হত্যা করে। ১১৭৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বাবা আদম শহীদ হন।
বাবা আদম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি শহীদ হওয়ার পর রিকাবী বাজার দীঘিরপাড় সড়কের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। ১৪৪৯ খ্রিস্টাব্দে বিক্রমপুরের শাসক মহান মালিক কাফুর শাহ বাবা আদমের খানকার ওপর একটি চমৎকার মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটির ৬ গম্বুজ পুরাকালের আত্মত্যাগী বাবা আদমের কথা মনে করিয়ে দেয়। পাশেই রয়েছে তাঁর পবিত্র মাজার শরীফ।
বল্লাল সেনের পরিণতি
রাজা বল্লাল সেন পূর্ব থেকেই বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুসলিম সৈন্য বাহিনীর বিজয় ও পরাক্রমের কাহিনী সম্বন্ধে অবহিত থাকাতে পরাজিত হলে যাতে শত্রুর হাতে বন্দী হয়ে মানসম্ভ্রম খোয়াতে না হয় সে জন্য তিনি আগেভাগেই ব্যবস্থা করে রেখে যান। তিনি প্রাসাদ থেকে বের হওয়ার সময় একটি চিতা (অগ্নিকুন্ড) তৈরি করে যান এবং সবার কাছ থেকে এ প্রতিশ্রুতিও গ্রহণ করে নেন যে, তিনি যদি যুদ্ধে পরাজিত বা নিহত হন, তবে তার পরিবারের সবাই যেন চিতায় ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। তিনি সাথে করে একটি কবুতর নিয়ে যান এবং এই কবুতরের সাহায্যে খবর পাঠানোর কথাও বলে যান, পায়রাটি একা রাজপুরীতে ফিরে এলে রানী এবং রাজপরিবারের অপরাপর সদস্যগণ যেন মনে করেন যে রাজা যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হয়েছেন। আর তারাও যেন জাতিধর্ম রক্ষার জন্য অমনি জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে আত্মবিসর্জন দেন।
বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে বাবা আদম রাহমাতুল্লাহি আলাইহিকে শহীদ করার পর রক্তমাখা দেহ ধোয়ার জন্য যেই পার্শ্ববর্তী জলাশয় ‘কাঁছারীর দীঘিতে’ রাজা বল্লাল সেন অবতরণ করেন অমনি আল্লাহ হুকুমে পায়রাটি বস্ত্রাভ্যন্তর থেকে উড়ে গিয়ে রাজপুরীতে পৌঁছে যায়। আর তক্ষুণি রাণী ও রাজপরিবারের অপরাপর সদস্যবৃন্দও রাজার পরাজয় ও মৃত্যু আশঙ্কা করে সেই জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে আত্মবিসর্জন দিলেন। এদিকে বল্লাল সেনও পায়রা ছুটে যাওয়া মাত্রই পাগলের মতো রাজধানী রামপাল অভিমুখে ছুটে এলেন। কিন্তু ইতিমধ্যে সব শেষ হয়ে গেছে। এদিকে দ্রুত প্রাসাদে এসে বল্লাল সেন এই করুণ পরিণতি দেখে এই শোক সহ্য করতে না পেরে রাজাও ঐ একই চিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহুতি দিলেন। ফলে বিক্রমপুর মুসলমানদের করতলগত হয়ে গেল।
হযরত বাবা আদম শহীদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি মসজিদ
বাবা আদম রাহমাতুল্লাহি আলাইহি শহীদ হওয়ার ৩০০ বছর পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন আবু জাফর শাহের পুত্র বিক্রমপুরের শাসক মহান মালিক কাফুর শাহ্ ছয়গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তাঁর মাযারের পশ্চিম উত্তর পার্শ্বে ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে এ মসজিদটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ফাতেহ শাহের শাসনামলে নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। সেই থেকে ৫৩০ বছর ধরে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে এই মসজিদটি।
মসজিদে প্রবেশের মূল দরজার ঠিক উপরে আরবি ভাষায় একটি শিলালিপি রয়েছে। যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়- “আল্লাহ তাআলা বলেছেন, নিশ্চয়ই সব মসজিদ একমাত্র আল্লাহরই। অতএব, তোমরা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে অংশীদার করো না। মহানবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুনিয়াতে যিনি একটি সমজিদ নির্মাণ করেন, আল্লাহ তা’আলা বেহেশতে তার জন্য একটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন। সুলতান আবু মুজাফফর ফতেহ শাহের আমলে মহান রাজা মালিক কাফুর ৮৮৮ হিজরীর রজব মাসের মাঝামাঝি তারিখে এ জামে মসজিদ নির্মাণ করেন।”
সম্ভবত বাবা আদমের আমলের কোনো মসজিদের ভিত্তির উপরই তা প্রতিষ্ঠিত। নয়তো মাযার ও মসজিদ একই স্থানে হতো। বাবা আদম শহীদ যেহেতু শাহাদাতবরণের বেশ কিছুদিন আগেই সেখানে পৌঁছেছিলেন এবং তাঁর লক্ষ্য ছিল ইসলামের প্রচার ও প্রসার তাই তিনি সেখানে মসজিদ নির্মাণ করবেন এটাই স্বাভাবিক। হয়তো তাঁর নির্মিত মসজিদটি তেমন শক্ত অবকাঠামোর ছিল না। এমনও হতে পারে, স্থানীয় হিন্দুরা বা অন্য কেউ পরে মসজিদটি ভেঙে ফেলেছিল। তাই পূর্বে মসজিদের ভিত্তির উপরই তা প্রতিষ্ঠিত হয়।
তৎকালীন ভারতবর্ষে যে কটি প্রাচীন মসজিদ ছিল, সেগুলোর একটি বাবা আদম মসজিদ। এলাকাবাসীর ভাষ্য, বাবা আদমের নামে নির্মিত এ মসজিদটি দেখতে বছরজুড়ে দরগাবাড়িতে আসেন দেশ-বিদেশের পর্যটক ও দর্শনার্থীরা। সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনাও এ মসজিদ দেখতে এসেছিলেন। তবে পর্যটকদের আকর্ষণ ধরে রাখা কিংবা কয়েক শ বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকা এ স্থাপনাটি সংরক্ষণে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। ভারতবর্ষ প্রতœতত্ত্ব জরিপ বিভাগ ১৯০৯ সালে একবার এ মসজিদটি সংস্কার করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এরপর দীর্ঘ সময় সেভাবেই ফেলে রাখা হয়।
মসজিদটি শুধু মুন্সীগঞ্জেরই নয় সমগ্র ভারত বর্ষের মধ্যে একটি দর্শনীয় স্থান। ১৯৯১-১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ এ মসজিদের ছবি সম্বলিত ডাকটিকেট প্রকাশ করে। বাবা আদম মসজিদটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
উপসংহার
তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে তেমন কিছুই জানা না গেলেও রাজা বল্লাল সেনের কাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত ঘটনা যদি সত্য বলে ধরে নেওয়া যায়, তবে বলা যায় তিনি শাহাদাত বরণ করেছিলেন ১১৭৮ সালে। অর্থাৎ তিনি বখতিয়ার খলজির বাংলা অভিযানের (১২০৪ সাল) আগেই এদেশের অন্যতম একটি রাজধানীতে ইসলামের ঝান্ডা সমুন্নত করার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর সেই সংগ্রাম তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো সফল হয়নি। কিন্তু তাঁর দেখানো পথ ধরেই পরবর্তীকালে ইসলাম প্রচারের কাজ এগিয়ে চলেছে।
এ লোককাহিনীতে সত্যতা যাই থাকুক না কেন, এ কাহিনীই হচ্ছে বাবা আদম শহীদের ইতিহাস পুনর্গঠনের একমাত্র উৎস। তেরো শতকে বখতিয়ার খলজীর নেতৃত্বে তুর্কিদের বঙ্গ বিজয়ের অনেক আগেই আরব বণিকদের মাধ্যমে বাংলার সঙ্গে মুসলমানদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে আরবদের যোগাযোগের ফলে রামপালের মতো প্রত্যন্ত স্থানে মুসলমান বসতি স্থাপিত হওয়া সন্দেহজনক। সম্ভবত মসজিদ নির্মাণের পূর্বেই এতদঞ্চলে এই সুফি সাধকের আগমন ঘটেছিল। সুফি সাধকের মাযারকে কেন্দ্র করে যখন মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে তখনই সম্ভবত মসজিদটি নির্মাণ করা হয়।
তবে একটি কথা অবশ্যই মানতে হবে বাবা আদম শহীদ বিক্রমপুর-মুন্সিগঞ্জ এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন, স্থানটি মুসলিম শাসকদের নিয়ন্ত্রণে আসার অনেক আগে। উল্লেখ্য, ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজি (১২০৪ সালে) বাংলা বিজয় করলেও বিক্রমপুর-মুন্সিগঞ্জ এলাকা আরো দীর্ঘদিন মুসলিম নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের আমলে (১৩০১-১৩২২) ওই এলাকা স্থায়ীভাবে মুসলিম শাসনে আসে। এরপর থেকে সেখানে মুসলিম শাসন জারী রয়েছে। তাই বলা যায়, বাবা আদম শহীদ সেন রাজবংশের বল্লাল সেন বা অন্য কোনো বল্লাল সেন-যার আমলেই হোক না কেন, অমুসলিম শাসন আমলেই সেখানে এসেছিলেন ইসলাম প্রচারের জন্য। প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী সেখানে আগে থেকেই স্বল্পসংখ্যক হলেও মুসলিম বসতি ছিল। সেখানে মুসলিম বসতি না থাকলে বল্লাল সেন মুসলমানদের উপর অত্যাচার করতে পারলো কী করে।
তথ্যপঞ্জি:
১. আনন্দ ভট্টের বল্লালচরিত নামক গ্রন্থে বল্লাল সেনের সঙ্গে বাবা আদমের যুদ্ধের কাহিনী পাওয়া যায়।
৩. তানভীর হাসান (অক্টোবর ১০, ২০১৪)। “বাবা আদম মসজিদ”। দৈনিক প্রথম আলো। সংগৃহীত ১২ অক্টোবর, ২০১৪।
৪. বাবা আদম শহীদ: আসিফ হাসান। নয়া দিগন্ত, ২৮ জুন ২০১৫,রবিবার,
৫. বাবা আদম শহীদ: ইবনে সাঈজ উদ্দীন। দৈনিক সংগ্রাম, শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০১৪ ।
৬. পুরাকীর্তি= বাবা আদম মসজিদ: তানভীর হাসান, মুন্সিগঞ্জ। প্রথম আলো, ১০ অক্টোবর ২০১৪,
৭. মুন্সীগঞ্জের বাবা আদম মসজিদ: গোলাম আশরাফ খান উজ্জল, দৈনিক ইত্তেফাক,৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ইং
৮. দর্শনীয় প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন বাবা আদম মসজিদ: মাসুদ রানা, মুন্সীগঞ্জ। আলোকিত বাংলাদেশ,শনিবার, জানুয়ারী ১৬, ২০১৬
৯. মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বাবা আদম শহীদ মসজিদ: আবদুল কাইয়ুম আল আমিন। কালের কন্ঠ, আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি,
(সংগৃহীত)