তর্কের সাতকাহন —- ওয়াহিদুল আলম সোহেল
তর্ক পছন্দ করে এমন মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। পছন্দ করে না এমন মানুষও অাছে। তর্ক বিষয়টি ব্যক্তির মন মেজাজের ওপর যতটা না নির্ভর করে তারচে’ বেশি নির্ভর করে ব্যক্তির মানসিক পরিপক্কতার ওপর। তর্কের বিষয়ে ব্যক্তি কতটুকু জ্ঞান রাখেন তার ওপর তর্কের চরিত্র নির্ণীত হবে।
কথায় বলে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। সেই বহুদূর কতদূর? দূরত্বের সীমাটুকু নেই। অনেকেই লঘু বিষয়ে তর্ক নিয়ে রাত পার করে দেন। সমাধান মেলে না। মিলবার কথাও না। তর্কে বিতর্কে জড়িয়ে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে একটি তার্কিক দল বিরোধী দলটিকে তাদের তর্কের ধারণাটি মানাতে পেরেছে এমন নজির বোধকরি নেই। পাঁচ জনের চারজনই তুমুল তর্কে জড়ায়। একজন হয়তো চুপ থাকে। চুপ থাকা ব্যক্তিটি হয় তর্ককৃত বিষয়ে কোন জ্ঞান রাখেন না, না হয় তিনি জ্ঞান রাখেন কিন্তু তর্ক পছন্দ করেন না। অনেকের ভাবটি অাবার এমন যে দেখে মনে হয় তিনি সব জেনে চুপ করে অাছেন।
চুপ থাকা একটি মহৎ বৈশিষ্ট্য। জেনে চুপ থাকা অার না জেনে চুপ থাকার মধ্যে পার্থক্য অাকাশ অার পাতাল। চীনা একটি প্রবাদ পড়েছিলাম, যে না জেনে প্রশ্ন করে সে বোকা থাকে কিছুক্ষণের জন্যে। অার জানার ভান করে যে প্রশ্ন করে না সে বোকা থাকে সারাজীবনের জন্যে। অর্থ এই, যে প্রশ্ন করে না সে কিছুই জানবে না। অজ্ঞতার অন্ধকারের মত বড় অন্ধকার অার নেই। বিপরীতে নিজেকে সবজান্তা জ্ঞান করাও পাপের সমতুল্য। কেবল স্রষ্টাই সবকিছুর জ্ঞান রাখেন। তাঁর পরে তিনি যাকে কোনকিছু জানান সেই জানে। জানার অসীম স্পৃহা নিয়ে যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সেই তিনিই অাবার জ্ঞানের বড় একটি অংশ মানুষের কাছ থেকে গোপন করে রেখেছেন।
তর্কের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হবে জেনে তর্ক করা। সঠিকটি যে জানে না তার সাথে তর্ক করার মত বোকামি অার হয় না। বিরোধী তার্কিক ব্যক্তিটির মতামতকে শ্রদ্ধা করা তর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। নিচু ও কোমল কণ্ঠে তর্ককৃত বিষয়ে স্বীয় মতামতটি যিনি তুলে ধরেন তিনিই সফলতম তার্কিক হবেন। অপরের মতামতকে অগ্রাহ্য বা প্রারম্ভেই নাকচ করা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, চোখে মুখে কঠিন ভাব রেখে স্বীয় মতামতকে জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠা করার মত হীন কাজ তর্কের পক্ষে অার হয় না। কণ্ঠের উঁচু স্তরের শ্লেষসমেত ব্যবহারে যেমন কখনো সত্যকে পাশ কাটানো যায় না তেমনি মিথ্যাকেও প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
তর্ককৃত বিষয়ে বিরোধী তার্কিকটি কতটুকু জ্ঞান রাখেন বিচক্ষণ তার্কিক মাত্রই সেটি কিছু সময় তর্ক করেই বুঝে ফেলেন। সে মুহূর্তে তিনি ওজন মেপে তর্ক করবেন। তর্ককৃত বিষয়ে তার মতামতটি কোমল স্বরে, বিরোধী তার্কিকটির মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, যথাসম্ভব শীতল মেজাজে সহজভাবে তুলে ধরবেন। এরপর তিনি ধীরে ধীরে তর্কের ইতি টানতে চেষ্টা করবেন। কেননা তিনি বুঝে গেছেন বিরোধী তার্কিকটি চলমান তর্ককৃত বিষয়ে অজ্ঞ।
প্লেটো তাঁর গুরু মহামতি সক্রেটিসের সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা তর্ক করতেন। তাঁদের সেই অাদিমতম তর্ক জ্ঞানের জগতকে সমৃদ্ধ করেছে। সক্রেটিস যদিও একটি বইও লিখেন নি, শিষ্য প্লেটো সক্রেটিস থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে পৃথিবীবাসীর খেদমতে রেখে যেতে পেরেছিলেন। প্রকৃত জ্ঞানী অারেকজন জ্ঞানী সৃষ্টি করেন। একজন প্লেটো না জন্মালে এরিস্টটলের মত মহামতিকে অামরা পেতাম কিনা সন্দেহ থেকে যায়। একইভাবে একজন প্লেটোর জন্য সক্রেটিসকে অামাদের প্রয়োজন ছিল।
দার্শনিক ইবনে রুশদ অার অাল গাজ্জালীর মধ্যে চরম তর্ক হতো। গাজ্জালীর মত জগদ্বিখ্যাত দার্শনিকের দর্শনচিন্তার ত্রুটি ধরে ইবনে রুশদ কয়েকটি গ্রন্থ লিখে ফেলেছিলেন। গাজ্জালীর সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘তাহাফুত অাল ফালাসিফা’র ত্রুটি ধরে রুশদ লিখেছিলেন ‘তাহাফুত অাল তাহাফুত’নামে পূর্ণ গ্রন্থ। এগারো শতাব্দীর মধ্যভাগে এ দুই মহারথীর দর্শনতর্ক তুঙ্গে ওঠেছিল। মজার ব্যাপার হল, রুশদ অার গাজ্জালী কেউ কাউকে সরাসরি দর্শন করেন নি। গাজ্জালীর মৃত্যুর পনেরো বছর পর রুশদ জন্মেছিলেন! তর্কটি তবে চলেছিল কালিতে, কলমে, ছাপার অক্ষরে।
তর্ক তবে একটি বিজ্ঞান। তর্ক দর্শনের সৃষ্টি করে। জন্ম দেয় জ্ঞানের। তবে তর্কটি হওয়া চাই অর্থপূর্ণ। বিজ্ঞের সাথে তর্ক চলতে পারে। ওতে ফায়দা অাছে। মূর্খের সাথে তর্ক বর্জনীয়।
তর্ক একটি শাস্ত্র। ওটা রপ্ত করতে প্রচুর পড়াশোনা লাগে। নচেৎ তা অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। তাই তর্কে সতর্কতা অাশু জরুরী।