খবরের বিস্তারিত...


সিলেটের জালালী কবুতর বাংলার আধ্যাত্মিক ইতিহাসের অনন্য সাক্ষী

সিলেটে কবুতরকে আঞ্চলিক ভাষায় ‘কইতর’ বলা হয়। সিলেটের প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক জালালী কবুতর ৭০০ বছর ধরে স্বমহিমায় ওড়াউড়ি করছে এ ঘর থেকে ও ঘর, এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি। হয়তো শতাব্দীর পর শতাব্দী উড়বেও। শান্তির প্রতীক এই জালালী কবুতর যেন কালের অলঙ্কার। এই কবুতর ও শাহজালালের আধ্যাত্মিকতা যেন একই সূত্রে গাঁথা। সে কারণে কৈতর হারিয়ে যেতে পারে না বলেই বিশ্বাস করেন সিলেটের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষ।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৩০১ সালে ইসলাম প্রচারে ইয়েমেন থেকে হজরত শাহজালাল (রহ.) ভারতের দিল্লিতে আসেন। সেখানকার অলি নিজামউদ্দিন আউলিয়া (রহ.) শাহজালালের আধ্যাত্মিক শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে তাকে নীল ও কালো রঙের এক জোড়া কবুতর উপহার দেন। হজরত শাহজালাল (রহ.) ৩৬০ জন আউলিয়া নিয়ে ১৩০৩ সালে তৎকালীন আসামের অন্তর্ভুক্ত সিলেট (শ্রীহট্ট) জয় করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই কবুতরজোড়া। শাহজালালের সঙ্গী এই কবুতরের বংশধরেরা ‘জালালী কবুতর’ নামেই পরিচিত।
জালালী কবুতরের মাথা-পিঠ-বুক ঘন-ধূসর, ঘাড়-গলা ধাতব সবুজ, তার ওপরে গোলাপি রঙের আভা। ডানার প্রান্তে যেমন দুটো চওড়া কালো ব্যান্ড আছে, তেমনি লেজের আগায় আছে কালচে একটি আড়াআড়ি ব্যান্ড। পা লালচে, ঠোঁট কালচে। ঠোঁটের গোড়ায় সাদা রং।
জানা গেছে, জালালী কবুতর স্বতন্ত্র প্রজাতির না হলেও এর আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। দেশে একই রঙের যে বুনো কবুতর দেখা যায়, জালালী কবুতর তার চেয়ে সামান্য ছোট। রঙের পার্থক্যের মধ্যে জালালী কবুতরের রঙ সুরমার মতো, ঠিক আকাশী নীল নয়। তবে অন্যদের চেয়ে আরেকটি বিষয় তাদের আলাদা করেছে, তা হচ্ছে বসবাসের ঠিকানা। উড়ে যত দূরেই যাক না কেন, ফেরার ঠিকানা একটিই। মাজারেই ফিরে আসে এ জালালী কবুতর। জালালী কবুতরের ওপর গবেষণা করে এমনটাই খুঁজে পেয়েছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স অ্যান্ড এনিম্যাল ব্রিডিং বিভাগের প্রভাষক ডা. নয়ন ভৌমিক। বাংলাদেশে জালালী কবুতর নিয়ে তিনিই একমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছেন। তিনি দেখতে পেয়েছেন জালালী কবুতরের স্ত্রী ও পুরুষ যুগলের মধ্যকার বন্ধন অন্য যে কোনো প্রজাতির কবুতরের চেয়ে অনেক দৃঢ়। শুধু তাই নয় জালালী কবুতর নিজস্ব সঙ্গী ছাড়া অন্য কোনো কবুতরের সঙ্গে মিলিত হয় না।
কালের বিবর্তনে শান্তিপ্রিয় এবং ঐতিহ্যের প্রতীক জালালী কবুতর আজ হারাতে বসেছে। এখন হযরত শাহজালাল এবং হযরত শাহপরানের মাজারসহ হাতেগোনা কয়েকটা জায়গাকে ঘিরে যে হাজার কয়েক কবুতর টিকে আছে তারাই ধারণ করে আছে ঐতিহ্যের শেষ অস্তিত্ব। নিরাপদ আবাস না থাকা, উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে এবং দেশীয় কবুতরের যন্ত্রণায় জালালী কবুতর সংকটে পড়েছে। মানুষের লোভও ক্রমশঃ জালালী কবুতর কে বিলুপ্তির পথে ঠেলে দিচ্ছে। অনেকে ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে না খেলেও কিছু মানুষ এগুলো ধরে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলছে কিংবা বিক্রি করে, অথবা বিভিন্ন স্থানে পাচার করে দেয়। তাই আজ বিলীন হওয়ার পথে সিলেটের প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক জালালী কবুতর।
অথচ কিছুকাল আগেও সিলেটের সর্বত্র বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী ক্বীনব্রীজের লোহার পাতের ফাঁকে ফাঁকে সারি সারি কবুতর অবাধে বিচরণ করতো। বিকেল হলেই দূর দূরান্ত থেকে উড়ে এসে তারা ক্বীনব্রীজকে মুখর করে রাখতো। এই দৃশ্য শুধু সিলেটবাসীকে নয়, দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটকদেরও মুগ্ধ করতো। সময়ের বিবর্তনে ক্বীনব্রীজ জুড়ে জালালী কবুতরের সেই আদি রুপ, সেই লাবণ্য আজ আর নেই।
শুধুমাত্র হযরত শাহ জালাল (রহঃ) এবং শাহ পরাণ (রহঃ)-এর পুণ্য স্মৃতি রক্ষার্থেই নয়, বরং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং সিলেট অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বজায় রাখতে জালালী কবুতর সংরক্ষণ করা এবং এ সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবী। না হলে কালের গহ্বরে হারিয়ে যেতে পারে ইতিহাসের এই গৌরবোজ্জ্বল স্বাক্ষী জালালী কবুতর।

Comments

comments