জিহাদ ও জঙ্গিবাদ – মুহাম্মদ নুর হোসাইন (সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)
জিহাদ ইসলামের অন্যতম বিধান। শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে প্রত্যক্ষ–পরোক্ষ যত অন্তরায় আছে, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ পূর্বক সেগুলোর মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে ইসলাম ধর্মে জিহাদকে নির্দিষ্ট শ্রেণির ওপর ফরজ করা হয়েছে। প্রয়োজনের তাগিদে কিয়ামত অবধি ইসলামের এ বিধান কার্যকর থাকবে। পক্ষান্তরে জঙ্গিবাদ হলো সন্ত্রাস, জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি, ফেতনা–ফ্যাসাদ, নৈরাজ্য ও অরাজকতা সৃষ্টি, অবৈধ অস্ত্রবাজী এবং মানবতার অনিষ্ট সাধনমূলক কর্মসূচীর নাম। জিহাদের সাথে জঙ্গিবাদের কানাকড়ি সম্পর্কও নেই। জিহাদ ও জঙ্গিবাদকে এক করে দেখার কোন সুযোগ নেই। সত্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম–জিহাদকে জঙ্গিবাদ আখ্যা দেয়াও ভুল। তবে সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদ বিষয়টি আপেক্ষিক। তাই কারো নিকট যেটি জঙ্গিবাদ, সেটি অন্যের নিকট ইবাদত বা সত্যের সংগ্রাম। পরস্পরের এমন ধারণা জঙ্গিবাদ দমনের পথে অন্যতম অন্তরায়। তাই কোন পক্ষ যখন নিজেদের কর্মকাণ্ডকে স্বাধিকার, দুঃশাসন বিরোধী বা দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বলে মনে–প্রাণে বিশ্বাস করে, তখন শাসক গোষ্ঠি, সংশিহ্মষ্ট কর্তৃপক্ষ বা বিরোধী প এগুলোকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ এবং তৎসংশ্লিষ্টদেরকে সন্ত্রাসী ও জঙ্গি বলে আখ্যায়িত করে। বিপরীতার্থক বিশ্বাস ও মানসিকতা উভয় পক্ষকে চরম পন্থায় উপনীত করেছে। যার পরিণতিতে মানবিকতার বিপর্যয় ঘটেছে বার বার। এমন বাস্তবতায় ১৯৭০ সাল থেকে সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটেছে দ্রুতগতিতে। গ্লোবাল টেররিজম ডাটাব্যাজ’ এর জরিপ মতে, ২০০০ সাল হতে ২০১৪ পর্যন্ত একষট্টি হাজার বিরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটেছে এবং এতে এক লন্ড চল্লিশ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। বাংলাদেশেও রীতিমত জঙ্গিবাদী ঘটনা ঘটছে। ১/১১ এর পর থেকে বাংলাদেশে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গত ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজানে এবং তৎপরর্তী ৬ জুলাই (ঈদের দিন) শুলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা বাংলাদেশের জনমনে নিদারুণ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য মতে, উক্ত দু’টি হামলা ছিল ধর্মীয় গোষ্ঠির, যদিও সংশ্লিষ্টরা কোন বিদেশী নাগরিক নয় এবং তারা মাদ্রাসা শিক্ষিতও নয়, বরং তাদের অধিকাংশ ধনাঢ্য পরিবারের ইংলিশ মিডিয়াম বিদ্যাপীঠের ছাত্র। তাদের কর্মকান্ডগুলো যদিও ইসলাম ধর্মে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, তবুও তারা এগুলোকে জিহাদ, ঈমানী দায়িত্ব এবং এ পথে মৃত্যু বরণকে শাহাদাত ও জান্নাত প্রাপ্তির নিশ্চয়তা মনে করছে। প্রাথমিকভাবে বলা যায়, দেশীয় কিছু ধর্মীয় ব্যক্তির ইসলাম সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা, শিক্ষা নীতির দুর্বলতা, আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাথে যোগাযোগ ও তাদের লেজুড়বৃত্তি, সরকারি–বেসরকারি কিছু অতি প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্র্গের কর্মকাণ্ড ও উস্কানী মূলক বক্তব্য এদেরকে উক্ত পথে পা বাড়াতে উৎসাহিত করেছে। তাদের এ অপথ চলা যে কারণেই হোক না কেন, আগামী প্রজন্ম ও দেশমাতৃকার স্বার্থে তাদের মনে গ্রথিত ভুল ধারণা ভাঙ্গতে হবে। শুধু আইন প্রয়োগ নয়, তাদের ও তাদের মদত দাতাদেরকে আর্থ–সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, ও বুদ্ধি ভিত্তিক কর্মসূচি মাধ্যমে শান্তির পথে ফিরিয়ে আনতে হবে। মাদকাসক্তদের ন্যায় তাদের জন্যও সুন্দর কর্মসূচীর প্রণয়ন করতে হবে। মূলত: ইসলামের আসল মর্মবাণী ও জিহাদের যথাযথ অর্থ না বুঝা– মুসলিম জঙ্গিদের বিপথগামী হওয়ার অন্যতম কারণ।
জিহাদ মানে চেষ্টা করা, কষ্ট করা, সামর্থ্য প্রয়োগ করা ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে জিহাদ হলো, মানুষকে সত্য দ্বীনের প্রতি আহবান করা। বিস্তারিত সংজ্ঞা হলো, অবাধ্য ও যুদ্ধকারী কাফের, রাষ্ট্রদ্রোহী, ধর্মত্যাগী এবং এ জাতীয়দের বিরুদ্ধে আল্লাহ তায়ালার বিধান তুলে ধরার মানসে মুসলমানের শক্তি–সামর্থ্য ব্যয় করা। অপরদিকে ফার্সি শব্দ ‘জঙ্গ’ থেকে জঙ্গিবাদ ও জঙ্গি। জঙ্গ অর্থ যুদ্ধ। যুদ্ধ যদিও কারো কাম্য নয়, তবুও অধিকার আদায়, পরাধীনতা ও স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি, মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করা পৃথিবীর সকল জাতির কাছে সমাদৃত ও যোদ্ধারা জাতীয় বীর হিসেবে বিবেচিত। পক্ষান্তরে, জঙ্গিবাদ ও জঙ্গিবাদীরা সকলের কাছে ঘৃণিত। জঙ্গিবাদ মানে এখন সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গি অর্থ সন্ত্রাসী। সমার্থক শব্দ হিসেবে ইংরেজিতে যথাক্রমের্ ণররমরধ্রব ওর্ ণররমরর্ধ্র এর ব্যবহার হয়। সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা নিয়ে সমাজ বিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। মূূূলত এটি একটি রাজনৈতিক এবং আবেগ তাড়িত অপরাধ। যেহেতু বিভিন্ন আইনি পদ্ধতি এবং সরকারী সংস্থা সন্ত্রাসবাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় দেয়, সেহেতু সমাজ বিজ্ঞানীরা অদ্যাবধি জঙ্গিবাদের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই অষ্ট্রলিয়ান সাংসদ আঙ্গুস মারটিন তাঁদের সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “আন্তর্জাতিক সংস্থা এখনো সন্ত্রাসবাদের একটি পরিপূর্ণ, যুৎসই ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাতে উপনীত হতে পারেনি।” একটি যথাযথ সংজ্ঞাতে উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে জাতিসংঘ দু’বার (১৯৭০ ও ১৯৮০) উদ্যোগ গ্রহণ করে। জাতীয় সংগ্রাম ও স্বাধীকারের প্রশ্নে সেই উদ্যোগও ভেস্তে যায়। অবশেষে ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ওপর নিন্দা জানিয়ে নিম্নোক্ত রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের বর্ণনা দেয়া হয়। “কোন দেশের সন্ত্রাসী কর্তৃক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জনগণকে ক্ষুব্ধ করতে নির্দিষ্ট গোষ্ঠির প্রতি অপরাধ মূলক কর্মকাণ্ড সর্বদা অন্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। যা হোক, রাজনৈতিক, দার্শনিক, আদর্শিক, সাম্প্রদায়িক, বিশ্বাসগত, ধর্মীয় বা অন্য কোন সাংস্কৃতিক কর্মসূচি তাদেরকে ন্যায় পথে ফিরাতে সাহায্য করতে পারে।”
ধর্মের নামে হোক বা অন্য কোন কারণে হোক, জঙ্গিবাদের সাথে জিহাদের কোন সম্পর্ক নেই। কারণ, জিহাদের লক্ষ্য–উদ্দেশ্য, পদ্ধতি ও কর্মসূচির সাথে জঙ্গিবাদের দূরত্ব যোজন যোজন। বিশেষত: বাংলাদেশে যারা জিহাদের নামে সশস্ত্র কর্মকাণ্ডকরছে, একাধিক কারণে সেগুলোকে জিহাদ বলা যায় না। প্রথমতঃ জিহাদের সংজ্ঞা থেকে বুঝা যায়, মুসলমানদের সশস্ত্র জিহাদ হবে যুদ্ধবাজ কাফিরদের সাথে, কোন মুসলমানের সাথে নয়। কিন্তু বর্তমানে জঙ্গি তৎপরতা চলছে মুসলিম– অমুসলিম সকলের বিরুদ্ধে। এমনকি আলেম–ওলামাও তাদের জঙ্গিবাদের শিকার। দ্বিতীয়তঃ সশস্ত্র জিহাদ একটি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। উপরন্তু এ জন্য রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষ থেকে আহবান আসতে হবে। যেমন মদিনা রাষ্ট্র গঠন করার পর জিহাদের বিধান এসেছে এবং আল্লাহর রাসূল (দ.) জিহাদের ঘোষণা দেন। উপরন্তু নিজের দেশ, যেখানে ধর্ম পালন করতে কোন বাধা নেই, সেখানে সশস্ত্র জিহাদ ইসলাম অনুমোদন করে না। তৃতীয়তঃ সশস্ত্র ইসলামী জিহাদ হবে সামনা–সামনি। গুপ্ত হত্যা, আত্মঘাতি হামলা, হঠাৎ বোমা হামলা ইত্যকার চোরা–গুপ্তা ও কাপুরুষোচিত হামলাকে জিহাদের সংজ্ঞায় আনা যায় না। কেননা, রাসুলুল্লাহ (দ.) এবং তাঁর সাহাবীগণ (র.) যৌক্তিক কারণে সম্মুখযুদ্ধ করেছেন সত্য, কিন্তু জঙ্গিবাদীদের ন্যায় কোন কর্মকাণ্ডতাঁরা করেননি। চতুর্থতঃ সশস্ত্র জিহাদ হবে সে সব কাফিরের বিরুদ্ধে, যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এসেছে। যারা আসেনি, তাদের বিরুদ্ধে নয়। যেমন, জিহাদের বিধান সম্বলিত নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয় থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয়। এক. ‘‘যুদ্ধে অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে, যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে। কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে।” (সূরা হজ ঃ ৩৯) দুই. ‘‘আর লড়াই কর আল্লাহর ওয়াস্তে তাদের সাথে, যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে।’’ (সূরা বাকারা ঃ ১৯০) উপরোক্ত আয়াতদ্বয়ের মর্মার্থালোকে বরেণ্য ইসলামী গবেষকগণ এ কথার ওপর একমত পোষণ করেছেন যে, মুসলমানগণ কেবলমাত্র সে সব কাফিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যারা তাদের বিপক্ষে সম্মুখ সমরে উপস্থিত হবে। নারী, শিশু, বৃদ্ধ, ধর্মীয় কাজে সংসার ত্যাগী, সন্ন্যাসী–পাদ্রী, অন্ধ, খঞ্জ, পঙ্গু, অক্ষম অথবা যারা কাফিরদের অধীনে মজদুরী করে, কিন্তু তাদের সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি, সে সব লোকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ করার অনুমতি নেই। যেখানে বেসামরিক কাফিরদেরকে হত্যা করার ওপর নিষেধাজ্ঞা এসেছে, সেখানে নির্বিচারে মুসলমান হত্যার কর্মসূচী ইসলামী জিহাদ হয় কীভাবে? এমনকি যখন সশস্ত্র জিহাদ আবশ্যক হয়ে পড়ে, তখনো মুসলমানদের জন্য প্রথমে হামলা করার অনুমতি নেই। যেমন– হাদীসে এসেছে, “কাফিররা অগ্রসর হতে হতে যতক্ষণ না তোমাদের তরবারী তাদের নাগাল পাবে, ততক্ষণ তোমরা তরবারী উত্তোলন করোনা।” (মিশকাত/৩৪৩) পঞ্চমতঃ আত্মঘাতি হামলা জিহাদের অংশ নয়। ইসলামী শরীয়া মতে জিহাদের মাঠে কাফিরদের সাথে যু্দ্ধ করে মুসলমানরা হয়ত: শহীদ হবে অথবা গাজী হবে, কিন্তু যু্দ্ধ মাঠে আত্নহত্যা করতে পারবে না। যে ব্যক্তি এমন করবে ছহীহ হাদীসে তাকে জাহান্নামী ঘোষণা দেয়া হয়েছে। অতএব স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যেখানে আত্নহত্যা হারাম, সেখানে জিহাদের নামে নিজের বুকে বোমা ধারণ করে আত্মহত্যা ও নিরপরাধ মানুষের জান–মালের ক্ষতি করা, হঠাৎ কোন লোকালয়, রেস্তোরাঁ, উপাসনালয়, গণজমায়েত ইত্যাদিতে বোমা হামলা, গুলি চালানো, গাড়ি দিয়ে দলন করে নিরপরাধ মানুষ হত্যা করা কিভাবে জিহাদ হতে পারে? আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা স্বহস্তে নিজের জীবনকে ধ্বংসে আপতিত করো না।” (সুরা বাকারা ঃ ১৯৫) ষষ্ঠত ঃ ইসলাম ধর্মে জিহাদ ফরজ হয়েছে ফিতনা–ফ্যাসাদ তথা অশান্তি দূরীভূত করে সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। উল্টো সেই ফিতনাকে জিহাদ বলে ঘোষনা দেয়া মানে জিহাদ নামের পবিত্র ইবাদতকে কলঙ্কিত করা। উপরন্তু প্রশাসনের অগোচরে দেশ ও জাতির স্বার্থবিরোধী নাশকতামূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। ইসলামী আইনে এর শাস্তি হলো মৃত্যুদন্ড হ্যাঁ, উক্ত আইনে যে কোন নাগরিক ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে কথা বলার মতা সংরক্ষণ করে। অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলা অন্যতম জিহাদও বটে। সপ্তমতঃ জঙ্গিবাদীদের ধারণা অনুযায়ী তারা তাগুতি (খোদাদ্রোহী) শক্তি, বেহায়াপনা ও শিরক বিদয়াতের বিরুদ্ধে লড়ছে। যদি এমন ধারণা সত্যিও হয়, তবুও সংখ্যার দিক বিবেচনায় এটি জিহাদ হবে না। কেননা, তারা এ দেশের নাগরিকদের এক শতাংশও না, অথচ সূরা আনফালের ৬৬ নম্বর আয়াতের আলোকে তাদের ন্যূনতম সংখ্যা হতে হবে শত্রু সংখ্যার অর্ধেক।
বুঝা গেল, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জঙ্গিদের তৎপরতা জিহাদ নয়, বরং কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ইসলামী শরীয়া অনুযায়ী তাদের মূল অপরাধ তিনটি। যথা– (ক) নিরপরাধ মানুষ খুন (খ) নৈরাজ্য সৃষ্টি (গ) আত্মঘাতি হামলা। অপরাধগুলোর পার্থিব ও পরকালীন শাস্তির বিধান রয়েছে। প্রথম অপরাধের শাস্তি হলো কিছাছ বা মৃত্যুদন্ড। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে, “তোমাদের প্রতি নিহতদের ব্যাপারে কেছাছ বিধিবদ্ধ করা হয়েছে।” (সূরা বাকারা ঃ ১৭৮) উল্লেখ্য যে, ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসরত নিরপরাধ অমুসলিমকে হত্যা করার বিধানও একই। সূরা মায়িদার ৩৩ নম্বর আয়াতের আলোকে দ্বিতীয় অপরাধের শাস্তি হলো চারটির যে কোন একটি– মৃত্যুদন্ড, শূলীতে চড়ানো, বিপরীত দিক থেকে হাত–পা কেটে দেয়া অথবা দেশান্তর তথা নাগরিকত্ব বাতিল করা। তৃতীয় অপরাধের শাস্তি হলো দু’ধরণের। যদি আত্নঘাতি হামলায় সে মারা যায়, তাহলে তার শাস্তি পরকালীন। তবে সম্পত্তি বাতিল সহ পার্থিব অন্যান্য শাস্তি প্রয়োগ হবে। আর যদি সে মারা না যায়, কিন্তু তার হামলায় নিরপরাধ কেউ মারা যায়, তাহলে সে প্রথম প্রকার অপরাধের শাস্তি পাবে। আবার কেউ মারা না গেলেও আত্নঘাতি হামলা যেহেতু নৈরাজ্য সৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত, সেহেতু সে দ্বিতীয় প্রকার অপরাধের শাস্তিও পেতে পারে।
বাংলাদেশে ইসলামী আইন চালু করা, খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা বা শরীয়া পরিপন্থী কার্যক্রম বন্ধ করার দাবিতে যারা জঙ্গিবাদী কর্মকান্ড চালাচ্ছে এবং এ পথে জীবন উৎসর্গ করাকে শাহাদাত হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে, তারা যদি আপন দাবিতে সত্যবাদী হয়ে থাকে অর্থাৎ যদি ইসলাম প্রতিষ্ঠার নিয়তে এ অপরিণামদর্শী কাজ করে থাকে, তাহলে বলতে হবে ইসলাম সম্পর্কে তাদের জ্ঞান নিতান্তই অপ্রতুল, অথবা তারা এ বিষয়ে ভুল দীক্ষা প্রাপ্ত। এ জাতীয় কর্মকান্ডের মাধ্যমে তারা একদিকে নিজেদের ইহ–পরজগতকে স্বহস্তেই ধ্বংস করছে,অপরদিকে দেশ, জাতি ও ধর্মকে মহা সংকটে নিমজ্জিত করছে। আর যদি তারা ইসলামের ছদ্মাবরণে কোন দেশীয় বা আন্তর্জাতিক চক্রান্তের ক্রীড়ানক হিসেবে ব্যবহার হয়, অথবা বিশ্ব ব্যবস্থার ধর্মীয় বৈষম্য নীতির ফলে অতি আবেগে এ পথে পাড়ি জমায়, তাহলে বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, তারা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে ইরাক, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, সিরিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রে পরিণত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। জঙ্গিদের উদ্দেশ্য যা–ই হোক না কেন, দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে এ তৎপরতার সফল মোকাবেলা করতে হবে। অন্যথায় অনাগত দিনগুলোতে পুরো জাতিকে আরো বড় খেসারত দিতে হবে। জঙ্গিদেরও বোঝা উচিৎ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট আর ইরাক, আফগান, সিরিয়া বা ফিলিস্তিনের প্রেক্ষাপট এক নয়, না ধর্মীয় দিক দিয়ে আর না ঐতিহাসিক।
– See more at: http://www.dainikazadi.org/details2.php?news_id=551&table=september2016&date=2016-09-06&page_id=19&view=0&instant_status=#sthash.U1oC4xG8.dpuf