খবরের বিস্তারিত...


ওলামা সমাজের রাজনীতিবিমুখতার পেছনের কথা – কে এম নুরুল ইসলাম হুলাইনী

ওলামা সমাজের রাজনীতিবিমুখতার পেছনের কথা (পর্ব এক)
– কে এম নুরুল ইসলাম হুলাইনী
উপমহাদেশে দু’শ বছর খ্রিষ্টান ব্রিটিশ শাসনাধীনে মুসলমান সম্প্রদায়ের বঞ্চণার ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক দিকটা ছিল শিক্ষাক্ষেত্রে করুণভাবে পিছিয়ে পড়া ।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে কিছু ধার্মিক বদান্য ব্যক্তি পরিচালিত কোরান শিক্ষা ও জরুরী মাছয়ালা মাছায়েল শিক্ষার মক্তব ।

এছাড়া পীর ,ওস্তাদবাড়ীতে কিছু ফার্সী কিতাবাদির পাঠ গ্রহণের সুযোগ ছিল বৈকি ।

বৃটিশদের শকুনদৃষ্টি এড়াল না যে ,ঐশীবাণী কোরানের শ্বাশত শিক্ষা মুসলমানদেরকে নৈতিকভাবে দারুণ শক্তিশালী ও উজ্জীবিত করে রেখেছে ।

প্রমোদ গোণে শাসকগোষ্টি ।

একদিন খোদ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মি: গ্লাডস্টোন কমন্স সভায় দাঁড়িয়ে এক কপি কোরান শরীফ হাতে নিয়ে উঁচু করে ধরে বললেন “দেখুন,এটা হচ্ছে মুসলমানদের ঐশী ধর্মগ্রন্হ আল কোরান।
আমাদের বাইবেল কে আমরা এডিট করেছি,কিন্তু;এই কোরানকে এতটুকুন বিকৃত করা সম্ভব হয়নি।

অথচ,মুসলমানগণ যদি এই অবিকৃত কোরানের সঠিক শিক্ষা লাভ করে,তবে আমরা কোন মুসলমান দেশেই আমাদের শাসন চালাতে সক্ষম হবো না।

যদি মুসলমানদের পদানত করতে চাই, তবে এই কোরানের ব্যাপক শিক্ষা হতে মুসলমানদের দূরে রাখতে হবে।”

শুরু হল তাদের কূটপরিকল্পনা….

বৃটিশ কমন্স সভায় প্রস্তাব পাশ হলো ,যেহেতু কোরানকে বিকৃত করা অসম্ভব ,সেহেতু কোরানের শিক্ষাকে বিভক্ত করো ।

ইহলৌকিক ও পারলৌকিক এ দুই ভাগে বিভক্ত করে মুসলমানদেরকে পারলৌকিক বিষয়টার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে ।

আর
এ উদ্দেশ্যে শিক্ষা প্রতিষ্টান তথা মাদ্রাসা প্রতিষ্টান স্হাপন করতে হবে ।

আর এখানেই তাদের চক্রান্তের নীলনকসা বাস্তবায়ন নিশ্চিত আইন পাশ করলো যে ,
আ.ইসি.এস. হতে হবে প্রিন্সিপালের যোগ্যতা ।

অথচ মুসলমানরা তখনো পর্যন্ত  ইংরেজী শিক্ষাবিমুখ ।

স্বভাবতই আই.সি.এস. পাশ কোন মুসলিম পাওয়া যাবে না ।

পক্ষান্তরে হিন্দু আই.সি.এস. মেনে নেবে না মুসলিম কমিউনিটি ।

অতএব খ্রিষ্টান আই সি এস প্রিন্সিপালই ভরসা ।

ভারতবর্ষে ২৬ টি আলীয়া মাদ্রাসা স্হাপিত হলো ।

আর ২৬ জন প্রতিষ্টাতা প্রিন্সিপাল হলো খ্রিষ্টান ।

মাদ্রাসাগুলোতে ইংরেজ প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হলে পরে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্হা নিয়ন্ত্রণের সর্বময় ক্ষমতা খ্রিষ্টানদের কুক্ষিগত হলো ।

সিলেবাস প্রণীত হলো তাদের পছন্দানুযায়ী ।

কুখ্যাত ‘ডিভাইড এণ্ড রুলস’ পদ্ধতি এপ্লাই করে শ্বাশত কোরান শিক্ষার পাঠ্যক্রমে পারলৌকিক বিষয়াদি চতুরতার সহিত গুরুত্ব দিয়ে সিলেবাস প্রণয়ণ করায় ইহলৌকিক তথা জ্ঞান বিজ্ঞান ,প্রকৌশল ,গবেষণা ,আবিষ্কার ,অভিযান ,রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়াদি গৌণ হয়ে যায় ।

ব্রিটিশ সরকার কতৃক মুসলমানদের জন্য বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্টান আলীয়া মাদ্রাসাগুলির পাঠ্যক্রমে শিক্ষা সংকোচন নীতি পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে দারুনভাবে সফলকাম হয় খ্রিষ্টানরা ।

ফলতঃ মাদ্রাসা শিক্ষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান, আবিস্কার-গবেষণা, বিশেষতঃ রাষ্ট্র পরিচালনা তথা নেতৃত্ব প্রদানে সুকৌশলে নিরুৎসাহিত করা ,আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে গাফেল করে রাখা হয় ।

‘সবেধন নীলমণি’ শিক্ষা প্রতিষ্টান এই আলীয়া মাদ্রাসা শিক্ষিত ওলামা সমাজের একটা বিরাট অংশ দুনিয়াবিমুখ তথা রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ে ।

ফলশ্রুতিতে দু’শ বছর ইংরেজরা প্রায় নিরাপদে শিক্ষিত হিন্দু শ্রেণীর সাথে হালুয়া রুটির জমিদারীর ভাগ দিয়ে শাসনক্ষমতায় অধিষ্টিত থাকে ।

একেতো ইংরেজী শিক্ষা পরিত্যাজ্য ঘোষণার পরিণতিতে মুসলমানগণ এমনিতেই পিছিয়ে ছিলই ।

তদুপরি কোরান-হাদিছের শ্বাশত শিক্ষার সৃষ্টিশীল ,প্রগতিশীল , চেতনার উপজীব্য অংশকে মাদ্রাসা সিলেবাসে সুকৌশলে গৌণ করে ছাড়ল ।
ফলতঃ মুখ থুবরে পড়লো কয়েকটি সম্ভাবনাময় প্রজন্ম ।
শুধুমাত্র পারলৌকিক শিক্ষাচর্চা অনাগ্রহী করে তুলল ইহজাগতিক রাজনীতি ,জ্বিহাদ ,আন্দোলন ,সংগ্রাম ,রাষ্ট্র পরিচালনা ইত্যকার বিষয়াদিতে ।

গুরুত্ব পেলো ফাজায়েল ,মাছায়েল ,ফেকাহ ,ফতোয়া ,নছিহত ,পালা-পার্বণ ,উৎসব ,খাওয়া-দাওয়া সংক্রান্ত ,অনুষ্টান সর্বস্ব ধর্মচর্চা ।

আর এজন্যই বিদগ্ধ কবি ,যুগভাস্কর.কাজী নজরুল ইসলাম আক্ষেপ করে লিখেছেন ,

”বিশ্ব যখন এগিয়ে চলে
আমরা তখন বসি ।
বিবিতালাকের ফতোয়া খুঁজি,
ফেক্বাহ হাদিছ চষি ।”

লক্ষণীয় ,একটি শ্রমবিমুখ ,আয়েসী ওলামাশ্রেণী সৃষ্টিতে বৃটিশদের সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা তাদের আশানুরুপ কার্যকর হলো ।

এরই মাঝে ব্যতিক্রমী কতিপয় প্রতিভাবান আলেম সমসাময়িক মুসলিম নেতৃত্বের সহযোগী ছিলেন স্রেফ আপন প্রতিভায়।
(চলবে)

Comments

comments