ওলীগণের মাযার নির্মাণের পক্ষে মিসরীয় সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী আলী জুমু’আ’র ফতোওয়া
অনুবাদক: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন
আরবী ও অনলাইন সেট-আপ: রুবাইয়েৎ বিন মূসা
[The Egyptian former Grand Mufti Ali Jumua (Goma)’s Online fatwa regarding ‘Building domes and shrines over the deceased’. Translator: Kazi Saifuddin Hossain]
প্রশ্ন: মোহতারাম, আমাদের গ্রামে দু’টি মসজিদ পাশাপাশি বিদ্যমান, যার প্রতিটিতেই একজন আল্লাহ’র ওলী (বন্ধু)-এর মাযার রয়েছে। ১৯৫০-এর দশক হতে আমরা (গ্রামবাসীরা) এক শুক্রবার বাদে বাদে (পর পর) এই দুই মসজিদে জুমুআ’র নামায পর্যায়ক্রমিকভাবে আদায় করে আসছি। কিন্তু সশব্দে (কেরাত পাঠের মাধ্যমে) নামায আদায়ের সময় এবাদতের পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। কেননা, দু’টি মসজিদ একেবারেই সংলগ্ন। জনৈক ব্যক্তি নিজ খরচে এই দু’টি মসজিদ ভেঙ্গে তদস্থলে একটিমাত্র মসজিদ নির্মাণ করতে চান। তবে তাঁর আরোপিত শর্ত হলো, মসজিদগুলোর সংলগ্ন দু’টি মাযার ওখান থেকে অপসারণ করতে হবে এবং উভয় বোযর্গের দেহাবশেষ আমাদের গ্রামের কবরস্থানে স্থানান্তর করতে হবে। কতিপয় মুসল্লি ভাই এতে সায় দিয়েছেন সে সকল লোকের কথার ভিত্তিতে, যারা বলে মাযার-সংলগ্ন মসজিদে নামায পড়া নিষেধ। এ ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম কী?
জবাব: আল্লাহ’র আউলিয়া কেরামের মাযার-রওযা সংলগ্ন মসজিদে নামায আদায় করা শরীয়তে শুধু বৈধ ও অনুমতিপ্রাপ্ত-ই নয়, এটি কুরআন-সুন্নাহ, আসহাবে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম‘র আচরিত প্রথা ও গোটা মুসলিম উম্মাহ তথা মুসলমান সমাজের বাস্তব ঐকমত্যের মৌলিক প্রামাণ্য দলিল দ্বারা প্রশংসনীয় কর্ম বলে প্রতিষ্ঠিতও বটে।
আল-কুরআন হতে প্রমাণ
মহা পরাক্রমশালী আল্লাহতা’লা এরশাদ ফরমান,
إِذْ يَتَنَازَعُونَ بَيْنَهُمْ أَمْرَهُمْ فَقَالُوا ابْنُوا عَلَيْهِمْ بُنْيَانًا رَبُّهُمْ أَعْلَمُ بِهِمْ قَالَ الَّذِينَ غَلَبُوا عَلَى أَمْرِهِمْ لَنَتَّخِذَنَّ عَلَيْهِمْ مَسْجِدًا.
– “যখন এই সব লোক তাদের (আসহাবে কাহাফ) ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করতে লাগলো, অতঃপর (কেউ কেউ) বল্লো, ‘তাদের গুহার ওপর কোনো ইমারত নির্মাণ করো। তাদের রব্ব (খোদা)-ই তাদের ব্যাপারে ভাল জানেন।’ ওই লোকদের মধ্যে যারা (এ বিষয়ে) ক্ষমতাধর ছিল, তারা বল্লো, ‘শপথ রইলো, আমরা তাদের (আসহাবে কাহাফের পুণ্যময় স্থানের) ওপর মসজিদ নির্মাণ করবো’।” [১]
ওপরের আয়াতের প্রেক্ষিত এই ইঙ্গিত বহন করে যে প্রথম উদ্ধৃতিটি ছিল অবিশ্বাসীদের, আর দ্বিতীয়টি ছিল বিশ্বাসীদের। আল্লাহতা’লা উভয় বক্তব্যকেই কোনো রকম প্রত্যাখ্যান ব্যতিরেকে তুলে ধরেছেন, যার দরুন উভয় মতের প্রতি তাঁর অনুমতি প্রতীয়মান হয়। কিন্তু অবিশ্বাসীদের সন্দেহ মেশানো বক্তব্যের বিপরীতে বিশ্বাসীদের বক্তব্য স্রেফ ইমারত নয়, বরং মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁদের আকাঙ্ক্ষায় অনুমোদন ও দৃঢ়তার বিষয়টি পরিস্ফুট হয়।
উলেমাবৃন্দের ব্যাখ্যা
ইমাম আল-রাযী لَنَتَّخِذَنَّ عَلَيْهِمْ مَسْجِدًا. – ‘শপথ রইলো, আমরা তাদের (আসহাবে কাহাফের পুণ্যময় স্থানের) ওপর মসজিদ নির্মাণ করবো’, এই আয়াতটির তাফসীরে বলেন যে এর মানে হলো,
نَعْبُدُ اللَّهَ فِيهِ وَنَسْتَبْقِي آثَارَ أَصْحَابِ الْكَهْفِ.
– ‘আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করবো এবং আসহাবে কাহাফের দেহাবশেষ (স্মৃতিচিহ্ন) তাতে সংরক্ষণ করবো।’[২]
* আল-বায়দাবীর তাফসীরের ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থে শেহাবউদ্দীন খাফফাজী লেখেন:
– পুণ্যবান বান্দাদের (মাযার-রওযার) পাশে মসজিদ নির্মাণের অনুমতি এই দলিলে সাব্যস্ত হয়।”[৩]
সুন্নাহ হতে প্রমাণ
* হযরত উরওয়া ইবনে আল-যুবায়র রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন,
وَيَنْفَلِتُ مِنْهُمْ أَبُو جَنْدَلِ بْنِ سَيْهَلٍ فَلَحِقَ بِأَبِي بَصِيرٍ، حَتَّى اجْتَمَعَتْ مِنْهُمْ عِصَابَةٌ.
– হযরত আল-মুসাওয়ের ইবনে মাখরামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও মারাওয়ান ইবনে আল-হাকীম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে এই মর্মে যে, আবূ বাসীর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন ইন্তেকাল করেন, তখন আবূ জানদাল ইবনে সোহায়ল ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তিন’শ জন সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর উপস্থিতিতে ‘সাইফ আল-বাহর’ নামের স্থানে তাঁকে দাফন করেন এবং সেখানে তাঁর মাযার-সংলগ্ন একটি মসজিদ নির্মাণ করে দেন ।[৪]
এই রওয়ায়াতের এসনাদ সহীহ (বিশুদ্ধ) এবং এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন আস্থাভাজন উলেমাবৃন্দ। এই কাজটি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আড়ালে গোপনে সংঘটিত হতে পারে না; এতদসত্ত্বেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই মাযার অপসারণ বা (ওই সাহাবীর) দেহাবশেষ অন্যত্র স্থানান্তরের নির্দেশ দেননি।
* বিশুদ্ধ রওয়ায়াতে হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা উদ্ধৃত হয়েছে; তিনি বলেন:
فِي مَسْجِدِ الْخَيْفِ قَبْرُ سَبْعِينَ نَبِيًّا.
– আল-খায়ফ মসজিদে সত্তর জন আম্বিয়া আলাইহিস সালাম-এর মাযার-রওযা বিদ্যমান। [৫]
* বোযর্গানে দ্বীনের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ও তাঁর মাতা সাহেবানী হযরত হাজার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা উভয়-ই (মক্কার) হারাম শরীফের অন্তর্গত আল-হিজর নামের স্থানে সমাহিত হন। এই তথ্য আস্থাভাজন ইতিহাসবিদগণ উল্লেখ করেছেন এবং তা প্রসিদ্ধ ইসলামী ইতিহাসবেত্তাবৃন্দ কর্তৃক সমর্থিত হয়েছে; এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইবনে এসহাক নিজ ‘সীরাহ’ গ্রন্থে, ইবনে জারির তাবারী তাঁর ‘তারিখ’ পুস্তকে, আস্ সোহায়লী স্বরচিত ‘আল-রওদ আল-উনুফ’ কেতাবে, ইবনুল জাওযী নিজ ‘মুনতাযেম’ বইয়ে, ইবনুল আসির তাঁর ‘আল-কামেল’ পুস্তকে, আয্ যাহাবী স্বরচিত ‘তারিখ আল-ইসলাম’ গ্রন্থে এবং ইবনে কাসীর নিজ ‘আল-বেদায়া ওয়ান্ নেহায়া’ কেতাবে। হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল-খায়ফ মসজিদে আম্বিয়া আলাইহিস সালাম-এর মাযার-রওযা এবং আল-হিজর স্থানে ইসমাঈল আলাইহিস সালাম ও তাঁর মায়ের দাফন হবার দুটি খবরেরই সত্যতা নিশ্চিত করেছেন, অথচ সে সব মাযার-রওযা সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেননি।
সাহাবা-এ-কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম-এর আচরিত প্রথা
ইমাম মালেক রহমতুল্লাহি আলাইহি তাঁর ‘মুওয়াত্তা’ গ্রন্থে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রওযার স্থান নির্ধারণ নিয়ে সাহাবা-এ-কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম-এর মধ্যকার মতপার্থক্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন কতিপয় সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম হুযূর পূর নূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মসজিদে নববীর মিম্বরের কাছে দাফন করতে চেয়েছিলেন; অন্যদিকে অপর কিছু সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁকে ‘বাকী’ কবরস্থানে সমাহিত করতে চেয়েছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এগিয়ে এসে বলেন,
سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «مَا دُفِنَ نَبِيٌّ قَطُّ إِلَّا فِي مَكَانِهِ الَّذِي تُوُفِّيَ فِيهِ» ، فَحُفِرَ لَهُ فِيهِ.
– “আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, ‘কোনো নবী আলাইহিস সালাম যখনই বেসালপ্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি যে জায়গায় বেসালপ্রাপ্ত হয়েছেন তৎক্ষণাৎ সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়েছে’।” [৬] অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ঘরে বেসালপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, সেখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়।
মসজিদে নববীর মিম্বরের কাছের জায়গা যা নিশ্চিতভাবে মসজিদের অংশ ছিল, তাতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে দাফন করার পক্ষে পেশকৃত মতামতকে সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম-দের কেউই নিষেধ করেননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বেসালপ্রাপ্ত হবার স্থানে তাঁকে দাফন করার পক্ষে প্রদত্ত তাঁরই আদেশ পালনের উদ্দেশ্যে হযরত আবূ বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এই মতকে বাস্তবায়ন করেননি। ফলশ্রুতিতে মা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর ঘর, যেটি মুসলমানদের নামায পড়ার স্থান – মসজিদে নববী সংলগ্ন ছিল, তাতে হুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সমাহিত করা হয়। আমাদের এই যুগের মসজিদগুলোতে তাই একই আদলে সংলগ্ন ঘরে ওলী-আল্লাহবৃন্দের মাযার-রওযা বিদ্যমান।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মোবারক রওযা মসজিদসংলগ্ন ঘরে হওয়া একমাত্র তাঁর জন্যেই খাস বা নির্দিষ্ট বলে যে দাবি করা হয়, তার কোনো বৈধতা নেই। কেননা, তা কোনো প্রামাণিক দলিলের ভিত্তিতে উত্থাপিত নয়। অধিকন্তু, মা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যে ঘরে বসবাস করতেন এবং তাঁর ফরয ও নফল এবাদত-বন্দেগী পালন করতেন, তাতে সাহাবা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-বৃন্দ কর্তৃক সর্ব-হযরত আবূ বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে সমাহিত করার দরুন এই দাবি অন্তঃসারশূন্য বলে প্রমাণিত হয়। হযরতে সাহাবা-এ-কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম-এর এই কাজ এটি জায়েয বা অনুমতিপ্রাপ্ত হবার পক্ষে তাঁদের এজমা’ তথা ঐকমত্যের অন্যতম দালিলিক প্রমাণ।
মুসলিম উম্মাহ’র বাস্তব ঐকমত্য ও উলেমাবৃন্দের সমর্থন
* পুণ্যবান পূর্ববর্তী প্রজন্ম (মোতাকাদ্দেমীন) ও পরবর্তী প্রজন্মগুলো (মোতা’খেরীন) মসজিদে নববী এবং আম্বিয়া আলাইহিস সালাম ও আউলিয়া রহমতুল্লাহি আলাইহি-মণ্ডলীর মাযার-রওযাবিশিষ্ট অন্যান্য মসজিদগুলোতে নামায আদায় করেছেন বিনা আপত্তিতে।
* ওয়ালিদ ইবনে আব্দিল মালেক ৮৮ হিজরী সালে মদীনার তদানীন্তন শাসনকর্তা উমর ইবনে আব্দিল আযীযকে নির্দেশ দেন যেন তিনি মসজিদে নববীর চত্বরে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রওযা মোবারককে অন্তর্ভুক্ত করেন। মদীনা মোনাওয়ারার সাত জন নেতৃস্থানীয় আলেমের মধ্যে প্রায় সবাই এতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন; ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু সাঈদ ইবনে মুসাইয়েব। তিনি আপত্তি করেছিলেন যাতে মুসলমান সমাজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ঘরকে নজির হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তাঁর কৃচ্ছ্রব্রতপূর্ণ জীবনকে আদর্শ মানেন, আর দুনিয়ার ভোগ-বিলাস পরিহার করে চলেন। তাঁর এই আপত্তি মাযারবিশিষ্ট মসজিদে নামায পড়া হারাম মর্মে কোনো মতের ভিত্তিতে তিনি উত্থাপন করেননি।
হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর বর্ণিত হাদীস
হযরত মা আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী, যিনি বলেন:
لَعَنَ اللَّهُ اليَهُودَ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ.
– “আল্লাহ পাক ইহুদী ও খৃষ্টানদের প্রতি লা’নত (অভিসম্পাত) দিয়েছেন, কেননা তারা তাদের আম্বিয়া আলাইহিস সালাম-বৃন্দের মাযার-রওযাকে মসজিদসমূহ (উপাসনার স্থান) হিসেবে গ্রহণ করেছিল।” [৭]
এই হাদীসে উদ্ধৃত ‘মসজিদসমূহ’ শব্দটি উপাসনার স্থানকে বুঝিয়েছে; মানে তারা ওই সব মাযার-রওযার দিকে আরাধনার উদ্দেশ্যে সেজদা করতো, যেমনটি করে থাকে মূর্তি পূজারী অবিশ্বাসীরা তাদের প্রতিমার উদ্দেশ্যে। এটি অপর এক সহীহ রওয়ায়াতে সুস্পষ্ট হয়েছে; ইবনে আস’আদ স্বরচিত ‘তাবাকাত-এ-কুবরা’ গ্রন্থে হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর সূত্রে বর্ণনা করেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস, যিনি এরশাদ ফরমান:
اللَّهُمَّ لا تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَنًا يُعْبَدُ اشْتَدَّ غضب اللهعَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ .
– “হে আল্লাহ, আপনি আমার রওযাকে পূজা-অর্চনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবেন না। যারা তাদের আম্বিয়া আলাইহিস সালাম-বৃন্দের মাযার-রওযাকে ‘মসজিদ’ হিসেবে গ্রহণ করেছিল, তাদের প্রতি আল্লাহ পাক লা’নত বর্ষণ করেছেন।” ‘[৮]
যারা তাদের আম্বিয়া আলাইহিস সালাম-বৃন্দের মাযার-রওযাকে ‘মসজিদ’ হিসেবে গ্রহণ করেছিল, তাদের প্রতি আল্লাহ পাক লা’নত বর্ষণ করেছেন’, এই বাক্যটি উক্ত মাযার-রওযাকে উপাসনার স্থান হিসেবে ইঙ্গিত করে। কাজেই হাদীসটির মানে হলো, ‘হে আল্লাহ, মানুষের দ্বারা আমার রওযা শরীফকে (উপাস্য হিসেবে) অর্চনার বস্তুতে পরিণত করবেন না, যেমনটি ঘটেছিল পূর্ববর্তী আম্বিয়া আলাইহিস সালাম-দের মাযার-রওযা নিয়ে তাঁদের অনুসারীদের বেলায়।’[৯]
ইমাম আল-বায়দাবী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেন: “আল্লাহতা’লা ইহুদী ও খৃষ্টানদেরকে অভিসম্পাত দিয়েছেন, কারণ তারা তাদের আম্বিয়া আলাইহিস সালাম-বৃন্দের মাযার-রওযাকে উপাস্য বস্তু হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং কিবলা বানিয়ে সেদিকে ফিরে নামায পড়তো। আল্লাহ পাক মুসলমানদেরকে তা অনুকরণ করতে নিষেধ করেছেন। তবে কোনো বোযর্গ তথা ওলী-আল্লাহ’র মাযারের পাশে মসজিদ নির্মাণ করার বেলায় কোনো আপত্তি নেই; কিংবা তাঁকে পূজা-অর্চনার লক্ষ্যবস্তু না করে তাঁর মাযারের ভেতরে বরকত আদায়ের উদ্দেশ্যে যিকির-আযকার, ধ্যান সাধনা, দোয়া ইত্যাদি করার ক্ষেত্রেও কোনো আপত্তি নেই। তোমরা কি দেখো না, পবিত্র কা’বা শরীফের অভ্যন্তরে অবস্থিত হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর রওযা পাক এবং ’হাতিমে’ সংরক্ষিত মাযার-রওযা হলো এবাদতের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান? নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে শুধু সে সব কবরের বেলায়, যেগুলো থেকে দেহাবশেষ অপসারণ করা হয়েছে এবং তাতে মাটি-আবর্জনা অবশিষ্ট আছে।”
ইসলামী আইনে এটি প্রতিষ্ঠিত যে কোনো কবর হয় তার অধিবাসীর ইন্তেকালের আগেই নিজ মালিকানাধীন হতে হবে, নতুবা তাঁর ইন্তেকালের পরে কারো দ্বারা দানকৃত হতে হবে। কবরের জন্যে জমি দাতা (ওয়াকফের) যে সকল শর্তারোপ করবেন, তা (দেশের) আইনপ্রণেতার বিধানের সমকক্ষ বলে বিবেচিত হবে; আর তাই ওই কবরের জমি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার অনুমতি নেই।
ইন্তেকাল প্রাপ্তদের পবিত্রতা
ইসলাম ধর্ম ইন্তেকালপ্রাপ্ত মুসলমানদের পবিত্রতা ক্ষুন্ন করাকে নিষেধ করে এবং কবর থেকে তাঁদের দেহাবশেষ অপসারণের অনুমতি দেয় না। কেননা, ইন্তেকালপ্রাপ্তদের পবিত্রতা জীবিতদেরই পবিত্রতার নামান্তর। যদি কবরবাসী হন আল্লাহতা’লার কোনো এক প্রিয় বন্ধু, তাহলে এতে আরও জোর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হবে। এমতাবস্থায় তাঁর মাযার বা দেহাবশেষ অপসারণ হবে আরও বড় জঘন্য অপরাধ। এটি এ কারণে যে তাঁরা আল্লাহ পাকের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবমূর্তির ধারক ও বাহক, আর তাই যে কেউ তাঁদের মাযার-রওযার মান ক্ষুন্ন করলে আল্লাহতা’লার শাস্তির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। এতদসংক্রান্ত বিষয়েই হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন নিম্নের হাদীসে কুদসি, যা’তে আল্লাহ পাক এরশাদ ফরমান:
مَنْ عَادَى لِي وَلِيًّا فَقَدْ آذَنْتُهُ بِالحَرْبِ.
– যে ব্যক্তি আমার ওলী (বন্ধু)-এর প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন হবে, তার প্রতি আমি যুদ্ধ ঘোষণা করবো।” [১০]
ফতোওয়া
ওপরের প্রশ্নে উল্লেখিত দুটি বিদ্যমান মসজিদের পরিবর্তে একটি মসজিদ নির্মাণের অজুহাতে উক্ত দু’জন আউলিয়ার মাযার অপসারণ ও তাঁদের পবিত্রতা ক্ষুন্ন করার কোনো অনুমতি-ই নেই। দুটি মসজিদকে সংযুক্ত করা এবং মাযারগুলোকে যেভাবে আছে সেভাবে সংরক্ষণ করা শ্রেয়তর হবে; কেননা কোনো নেক তথা পুণ্যময় কর্ম বিধি-বহির্ভূত পন্থায় সম্পন্ন করার অনুমতি আছে। অনুরূপভাবে, মসজিদের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে যারা আছেন, মসজিদ নির্মাণের জন্যে মাযারগুলো অপসারণের শর্ত তাদের মেনে নেয়ার কোনো অনুমতিও তাদের নেই।
উপরন্তু, ওই দুটি মসজিদ আলাদা রাখাই শ্রেয়তর হবে, যতোক্ষণ না আল্লাহ পাক তাঁর আউলিয়া কেরামের মর্যাদা ও মাকাম সম্পর্কে জ্ঞানী ন্যায়বান মহাত্মণদের প্রেরণ করেন, যাঁরা আউলিয়াবৃন্দের পবিত্রতা রক্ষা করে দুটি মসজিদের স্থলে একটি মসজিদ নির্মাণ এবং তাতে উভয় মাযার সংরক্ষণ করতে পারবেন, আর ফলশ্রুতিতে ধার্মিকতা ও ধর্মপরায়ণতার ভিত্তিতে মসজিদটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবেন। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহতা’লা-ই সবচেয়ে ভাল জানেন।
তথ্যসূত্র
[১] আল কুরআন : আল কাহাফ, ১৮:২১।
[২] রাযী : মাফাতিহুল গায়িব ওয়া তাফসীরু কবীর, ২১/৪৪৬।
[৩] শিহাবউদ্দিন খাফফাজী : এনা‘য়াতুল কাজী ও কিফায়াতির রাজি।
[৪] আব্দুর রাযযাক : আল মুসান্নাফ, ৫:৩৩০ হাদীস নং ৯৭২০।
(ক)আবূ এসহাক : আল-সীরাহ।
(খ) মূসা ইবনে উকবা : মাগাযিয়্যাহ।
[৫] ত্ববরানী : আল মু‘জামুল কাবীর, ১২:৪১৪ হাদীস নং ১৩৫২৫।
(ক) আল-বাযযার : আল মুসনাদ।
(খ) ইবনে হাজর নিজ : মোখতাসার যাওয়াঈদ।
[৬] মালেক : আল মুয়াত্তা, ১:২১৪ হাদীস নং ৫৪৯।
[৭] বুখারী : আস সহীহ, ২:৮৮ হাদীস নং ১৩৩০।
(ক) মুসলিম : আস সহীহ, ১:৩৭৬ হাদীস নং ৫২৯।
[৮] ইবনে আসআদ : তবকাতুল কুবরা, ২:১৮৫।
[৯] অনুবাদকের নোট : এই হাদীসে প্রমাণিত হয় যে উম্মতে মোহাম্মদী কখনোই ’মাযার পূজা’ করবেন না। কেননা, উম্মতের জন্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দোয়া কবুল হয়ে থাকে। আল্লাহ তা ফিরিয়ে দেন না।
[১০] বুখারী : আস সহীহ, বাবুত তাওয়াদ্বিউ, ৮:১০৫, হাদীস নং ৬৫০২।
(ক)ইবনে হিব্বান : আস সহীহ, ২:৫৪ হাদীস নং ৩৪৭।
(খ) ত্ববরানী : আল মু‘জামুল কাবীর, ১২:১৪৫ হাদীস নং ১২৭৫০।
(গ) শরহুস সুন্নাহ : বাগাবী, বাবুত তাকারুব্বি.. ৫:১৯ হাদীস নং ১২৪৭।
(ঘ) ইবনে আসাকীর : আল মু‘জাম, ২:১১০৮ হাদীস নং ১৪৩৮।
(ঙ) বায়হাকী : সুনানুল কুবরা : ৩:৩৪৬ হাদীস নং ৬৬২২।
সমাপ্ত