ইলমে গায়েব নবী করীমের(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার) নবুয়তের অন্যতম দলীল
ইলমে গায়েব কী?
ইলমে গায়েবের মাসয়ালাটি খুবই সূক্ষ্ম, ঝুঁকিপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। বুঝলে পানির মতোই সহজ – নইলে, পাথরের চেয়েও কঠিন এবং মাকড়সার জালের চেয়েও জটিল মনে হবে। ফলে, গোমরাহ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকবে! বহু আলেমকে দেখেছি যে, এ নিয়ে আলোচনা বা বিতর্ক করতে গিয়ে জগাখিচুড়ি পাকিয়ে ফেলেন! ফলে, নিজেরাতো গোমরাহ হনই, বরং অনুসারীদেরও গোমরাহ করে ফেলেন; এমনকি অনেকে না বুঝে কুফরি মন্তব্য করে কাফেরের খাতায় পর্যন্ত নাম লিখিয়েছে (মায়াজাল্লা)। উল্লেখ্য, সুন্নী মুসলিম ও ওয়াহাবীদের মাঝে আকীদাগত প্রধানতম পার্থক্য রয়েছে, এ মাসয়ালায়। কেননা, এতে হাজির-নাযির, মীলাদ ও কিয়াম শরীফ এবং নবী-ওলীগণের দূর থেকে বা তাঁদের ইন্তেকালের পরে দুনিয়াবাসীকে সাহায্য করার মাসয়ালাগুলোও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ইলমে গায়েবের মাসয়ালা সঠিকভাবে বুঝতে হলে, আগে এ সংক্রান্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং সেগুলোর উত্তর পরিষ্কারভাবে জানতে হবে। যেমন-
১। এলেম বা জ্ঞান কতো প্রকার ও কী কী এবং সেসবের সংজ্ঞাইবা কী?
২। ইন্দ্রিয় কাকে বলে এবং কতো প্রকার ও কী কী?
৩। নাবা, নবুয়ত ও নবী শব্দের অর্থ ও মর্ম কী কী?
৪। ইলমে গায়েবের ভান্ডারগুলো কী কী?
৫। “আলিমুল গায়েব” এর অর্থ কী এবং আল্লাহুতা’লা ছাড়া আর কেউ আলিমুল গায়েব কিনা?
৬। মহান আল্লাহপাক মহানবীকে ইলমে গায়েব দান করেছেন কিনা এবং করে থাকলে, কতোটুকু ও কিভাবে?
দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, অধিকাংশ আলেমেরই এসব ব্যাপারে স্পষ্ট, সঠিক ও সন্তোষজনক ধারণা নেই। ফলে, সুন্নী ও ওয়াহাবীদের মাঝে দূরত্ব দিনে দিনে বাড়ছেই। তাই, আমি এ ব্যাপারে আলোকপাত করবো এবং আমার প্রতিপক্ষের প্রতি চ্যালেঞ্জ থাকবে – গঠনমূলক যুক্তি দিয়ে আমার বক্তব্যগুলো খন্ডন করার!
প্রথম প্রশ্নের (এলেম বা জ্ঞান কতো প্রকার ও কী কী এবং প্রত্যেক প্রকারের সংজ্ঞাইবা কী?) উত্তর হচ্ছে, ইলম বা জ্ঞান দু’ প্রকার। যথা- (১) ইলমে গায়েব বা অতীন্দ্রিয় জ্ঞান ও (২) ইলমে শাহাদাত বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান। আমার প্রাসঙ্গিক বিষয় হচ্ছে, ইলমে গায়েব; আর আনুষঙ্গিক বিষয় হলো, ইলমে শাহাদাত।
ইলমে গায়েবের অর্থ কী? অনেকেই না বুঝে এর বাংলা অর্থ করেছে, অদৃশ্য জ্ঞান। ফলে, বাংলা ভাষা-ভাষীদের মাঝে ব্যাপক বিভ্রান্তি জন্ম নিয়েছে। মনে রাখবেন, গায়েবের সকল জ্ঞান অদৃশ্য হলেও সকল অদৃশ্য জ্ঞান গায়েব নয়। যেমন- আওয়াজ, গন্ধ, বাতাস, সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা, ঘৃণা, জ্ঞান, বুদ্ধি, আদর্শ, পরিকল্পনা, উদ্দেশ্য ইত্যাদি সবই অদৃশ্য, কিন্তু ইলমে গায়েবের অন্তর্ভুক্ত নয়। কাজেই, গায়েবের একটি অর্থ অদৃশ্য হলেও ইলমে গায়েবের বাংলা অর্থ “অদৃশ্য জ্ঞান” মনে করাটা বেঠিক ও বিভ্রান্তিকর। এর সঠিক বাংলা অর্থ হচ্ছে, অতীন্দ্রিয় জ্ঞান; অর্থাৎ যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় বা ইন্দ্রিয় যেসব জ্ঞানের নাগাল পায় না – তাই হচ্ছে, ইলমে গায়েব। ইমাম ফখরুদ্দীন রাজী, নাসিরুদ্দীন বয়দ্ববী, শাইখ ইসমাঈল হাক্কী আফেন্দী, কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী প্রমুখ (’আলাইহিমুর রাহমাহ) গায়েবের এ অর্থই লিখেছেন। তাই, এটিই এর সঠিক অর্থ। কুরআন মজীদে “ইলমুল গাইব” কথাটি একটি (সূরা নাজম:৩৫) এবং “আনবাউল গাইব” কথাটি তিনটি (সূরা আলে ইমরান:৪৪, সূরা হুদ:৪৯ ও সূরা ইউসূফ:১০২) জায়গায় রয়েছে। “আনবাউ” শব্দটি “নাবা” শব্দের বহুবচন – যার অর্থ হলো, খবর, বার্তা, সংবাদ ইত্যাদি। সুতরাং “আনবাউল গায়েব” মানে, অতীন্দ্রিয় খবরাখবর। লক্ষণীয় যে, কুরআন করীমে “আনবাউ” (খবরাদি) তথা এ বহুবচন বাচক শব্দটি “গায়েব” শব্দের সঙ্গে (মুদ্বাফ হিসেবে) ব্যবহৃত হলেও গায়েবের বিপরীত “শাহাদাত” শব্দের সঙ্গেও কখনো ব্যবহৃত হয় নি! সুতরাং আল-কুরআন বলছে, “আনবাউ” শব্দটি গায়েব বা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের সঙ্গেই সম্পৃক্ত; শাহাদাত বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। আর তাই, “নাবা” শব্দ থেকে উৎপন্ন নবী শব্দের অর্থ হচ্ছে, গায়েব বা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের খবরদাতা।
দ্বিতীয় প্রশ্নের (ইন্দ্রিয় কাকে বলে এবং কতো প্রকার ও কী কী?) উত্তর হচ্ছে, যেসব অঙ্গ বা শক্তি দিয়ে কোনো পদার্থের বা বাইরের বিষয়ের জ্ঞান বা ধারণা জন্মে এবং কাজ করা যায় – ওসব অঙ্গ বা শক্তির প্রতিটিকে ইন্দ্রিয় বলে। মানুষের ইন্দ্রিয় মোট চোদ্দটি। যথা- চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বক (চামড়া) – এ পাঁচটিকে জ্ঞানেন্দ্রিয়; বাক (কথা), হাত, পা, পায়ু (মলদ্বার) ও উপস্থ (লিঙ্গ বা যোনি) – এ পাঁচটিকে কর্মেন্দ্রিয় এবং মন, বুদ্ধি, অহংকার ও চিত্ত – এ চারটিকে অন্তরিন্দ্রিয় বলা হয় (সূত্র: ব্যবহারিক বাংলা অভিধান – বাংলা একাডেমী)। সুতরাং এগুলোর মাধ্যমে অর্জিত এলেম কখনোই ইলমে গায়েব নয়, বরং ওগুলো সবই ইলমে শাহাদাত বা ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান। আর ঐ চোদ্দটি ইন্দ্রিয় ছাড়া যেসব জ্ঞান আমরা লাভ করি – সেগুলোই হচ্ছে, ইলমে গায়েব। যেমন- আল্লাহুতা’লার অস্তিত্ব ও পরিচিতি, আত্মার স্বরূপ, আরশ, কুরসি, লওহ, কলম, জান্নাত ও জাহান্নামের বিবরণ, হুর, ফেরেশতা ও জ্বীনের অস্তিত্ব ও পরিচিতি, হাশর-নশর, মিজান, মাকামে মাহমুদা, সিদরাতুল মুন্তাহা, আলমে আরওয়াহ্ বা আত্মার জগতের বিবরণ, আলমে বারঝাখ বা কবরের জগতের বর্ণনা, আখেরাতের জীবনের বিবরণ, বায়তুল মা’মুর, তাকদীর, পুনরুত্থান, পুলসিরাত, ভবিষ্যতের বর্ণনা ইত্যাদি সংক্রান্ত সকল জ্ঞানই ইলমে গায়েব বা অতীন্দ্রিয় জ্ঞান। কেননা, মানুষের ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে কোনোভাবেই এগুলোর নাগাল পাওয়া যায় না। আধুনিক বিজ্ঞানও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি দিয়ে এসব জ্ঞানের কোন সন্ধান পায় নি; বরং আম্বিয়ায়ে কেরাম (’আলাইহিমুস্ সালাম) এসব অতীন্দ্রিয় বিষয় আমাদের জানিয়েছেন। তাই, ওহীও ইলমে গায়েবের অংশ (সূরা আলে ইমরান:৪৪ ও সূরা হুদ:৪৯)। কেননা, ওহীর জ্ঞানও ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে হাসিল করা যায় না। নইলে, যে কেউ তার ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে নবী হতে পারতো।
তৃতীয় প্রশ্নের (নাবা, নবুয়ত ও নবী শব্দের অর্থ ও মর্ম কী কী?) উত্তর হচ্ছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত আরবী-বাংলা অভিধানের দ্বিতীয় খন্ডের ৯০৪ নং পৃষ্ঠায় “নাবা” শব্দের বাংলা অর্থ লেখা হয়েছে, খবর, সংবাদ, তথ্য, রিপোর্ট। ৯০৭ নং পৃষ্ঠায় “নবুয়ত” শব্দের বাংলা অর্থ লেখা হয়েছে, “আল্লাহর পক্ষ থেকে ঐশী অনুপ্রেরণার মাধ্যমে অদৃশ্য বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংবাদ দেওয়া, আল্লাহতা’লা এবং তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী সম্পর্কে তথ্য প্রদান করা, নবীর পদ। প্রকাশ থাকে যে, ইহা নাবা থেকে নির্গত।” পরের (৯০৮ নং) পৃষ্ঠায় “নবী” শব্দের বাংলা অর্থ লেখা হয়েছে, “নবী, রাসূল, আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ, আল্লাহতা’লা এবং তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী সম্পর্কে তথ্য প্রদানকারী, আল্লাহর পক্ষ থেকে ঐশী অনুপ্রেরণার মাধ্যমে অদৃশ্য বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সংবাদ দানকারী, উঁচু ভূমিকেও নবী বলা হয়।”
সুতরাং “নবুয়ত” নিঃসন্দেহে ইলমে গায়েব বা অতীন্দ্রিয় জ্ঞানের অংশ এবং নবী শব্দের অর্থ, গায়েব বা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের সংবাদদাতা। নবুয়ত যদি ইলমে গায়েবের অংশ না হয়ে ইলমে শাহাদাতের অংশ হতো – তাহলে, পিথাগোরাস, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, আল-কিন্দী, আল-ফারাবী, ইবনে সীনা, ওমর খৈয়াম, রজার বেকন, রেনে ডেকার্টে, লাইবোনিজ, ভলটেয়ার, ইমানুয়েল কান্ট, হেগেল, হার্বার্ট স্পেন্সার, নীটসে, বার্গসো, বার্টান্ড রাসেল প্রমুখ দার্শনিকেরা কিংবা আর্কিমিডিস, জালিনুস, জাবির ইবনে হাইয়ান, আল-হাজেন, আল-বেরুনী, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও, নিউটন, এডিসন, জগদীশ চন্দ্র বসু, আইনস্টাইন, ওপেনহেইমার প্রমুখ বিজ্ঞানীরা অথবা সাংবাদিকরা নির্দ্বিধায় নবী হতে পারতেন। তদুপরি, নবীকে ইংরেজিতে Prophet বলা হয়। Prophet শব্দটি Prophecy বা Prophesy শব্দ থেকে এসেছে। Prophecy শব্দটি Noun বা বিশেষ্য – যা অর্থ হচ্ছে, ভবিষ্যদ্বাণী এবং Prophesy শব্দটি Verb বা ক্রিয়া – যার অর্থ হচ্ছে, ভবিষ্যদ্বাণী করা। তাই, Prophet শব্দের অর্থ হচ্ছে, ভবিষ্যদ্বক্তা। সুতরাং আম্বিয়ায়ে কেরাম (’আলাইহিমুস্ সালাম) হচ্ছেন, গায়েবের বা অতীন্দ্রিয় বিষয়ের সংবাদদাতা। কেননা, যে কোন সংবাদদাতাকে নবী বলা যায় না। উল্লিখিত দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও সাংবাদিকরা আমাদের অনেক নতুন নতুন সংবাদ, তথ্য বা জ্ঞানের কথা জানিয়েছেন বা জানান। কিন্তু তারপরেও তাঁরা কি নবী?
চতুর্থ প্রশ্নের (ইলমে গায়েবের ভান্ডারগুলো কী কী?) উত্তর হচ্ছে, ইলমে গায়েবের দু’ রকম ভান্ডার রয়েছে; যথা- (১) উৎস ও (২) সূত্র। উৎস হচ্ছেন, আল্লাহ সুবহানাহুতা’লা নিজেই। কেননা, তিনি হচ্ছেন, অতীন্দ্রিয় পরম সত্তা। তাই, তিনি ইলমে গায়েবের সার্বিক বা পরম ভান্ডার। তাফসীরে ইবনে আব্বাসে সূরা আল-বাকারার শুরুতে গায়েবের অন্যতম তাফসীরে লেখা হয়েছে, “গায়েব অর্থ আল্লাহুতা’লা স্বয়ং।” আর সূত্র হচ্ছে, মহান আল্লাহপাকের প্রদত্ত বিশেষ বিশেষ ভান্ডার; যেমন- (ক) সাহেবে কুরআন সায়্যিদুনা হুজুরে পুরনূর (সল্লাল্লাহুতা’লা ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম), (খ) লওহে মাহফুয, (গ) কুরআন মজীদ, (গ) হাদীছ শরীফ, (ঘ) অন্যান্য নবী (’আলাইহিমুস্ সালাম), (ঙ) অন্যান্য আসমানি কিতাব, (চ) আওলিয়ায়ে কেরাম (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহুম), (ছ) ফেরেশতাগণ (’আলাইহিমুস সালাম) ইত্যাদি।
ইলমে গায়েব ও ইলমে শাহাদাত তথা অতীন্দ্রিয় জ্ঞান ও ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের প্রধান ভান্ডার বা সবচেয়ে বড় সূত্র হচ্ছেন, সায়্যিদুনা হুজুরে পুরনূর (সল্লাল্লাহুতা’লা ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। তাঁর সম্পর্কে মহান আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন: (ওগো আমার পেয়ারা নবী!) আপনার প্রতি আল্লাহর ফযল (দয়া) ও রহমত (মেহেরবানী) রয়েছে বলেই, যারা আপনাকে গোমরাহ্ করতে চাচ্ছিলো – তারা বরং নিজেদেরই গোমরাহ করবে এবং ওরা আপনার কোন ক্ষতিই করতে পারবে না। আর আল্লাহ্ আপনার প্রতি কিতাব ও হেকমত নাযিল করেছেন এবং আপনি যা জানতেন না – তা আপনাকে শিখিয়েছেন। কেননা, আপনার প্রতি আল্লাহর অপরিসীম করুণা রয়েছে (সূরা নিসা:১১৩)। এখানে আল্লাহুতা’লা দ্ব্যর্থহীন ও শর্তহীনভাবে ইরশাদ করেছেন যে, “আপনি যা জানতেন না – (আল্লাহুতা’লা) তা আপনাকে শিখিয়েছেন।” এতে ইলমে গায়েব ও ইলমে শাহাদাত – উভয়ই শামিল। এ বিষয়ে ৬নং প্রশ্নের উত্তরে বিস্তারিত আলোচনা করবো। তাছাড়া, আল্লাহুতা’লা আরো ফরমান: আর তিনি (নবী) গায়েবের ব্যাপারে কৃপণ নন (সূরা তাকভীর:২৪)। নবীজীর কাছে গায়েবের এলেম না থাকলে, এমন কথা মহান আল্লাহপাক কখনোই বলতেন না। সর্বোপরি, নবীজীকে ইলমে গায়েবের সৃষ্ট উৎসও বলা যেতে পারে। এ বিষয়েও সামনে বিস্তারিত আলোকপাত করবো, ইন শা আল্লাহুতা’লা।
ইলমে গায়েবের অন্যতম ভান্ডার বা সূত্র হচ্ছে, লওহে মাহফুয। কেননা, প্রথমত, কুরআন শরীফ লওহে মাহফুযেও সংরক্ষিত রয়েছে (সূরা বুরূজ:২১-২২)।
দ্বিতীয়ত, মাফাতিহুল গায়েব বা গায়েবের চাবিগুচ্ছের খবর লওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ রয়েছে (সূরা আন’য়াম:৫৯)।
তৃতীয়ত, ছোট-বড় সব কিছুই লওহে মাহফুযে রয়েছে (সূরা ক্বামার:৫৩ ও সূরা সাবা:৩)।
চতুর্থত, প্রতিটি জিনিস লওহে মাহফুযে লিখিত ও সংরক্ষিত রয়েছে (সূরা ইয়াসীন:১২)।
পঞ্চমত, মহান আল্লাহপাক যখন ফেরেশতাদের বলেছিলেন যে, তিনি পৃথিবীতে খলীফা বা প্রতিনিধি সৃষ্টি করবেন – তখন তাঁরা মানুষ জাতির নেতিবাচক দিকটি তুলে ধরে তাঁকে নিষেধ করেছিলেন (সূরা আল-বাকারাহ:৩০)। মানুষ জাতির এ ভবিষ্যৎ কর্মকান্ড সম্পর্কে তাঁরা এ আংশিক ধারণা বা জ্ঞান লাভ করেছিলেন, লওহে মাহফুয থেকেই।
ষষ্ঠত, হাদীছ শরীফে রয়েছে যে, নবীজী (’আলাইহিস্ সলাতু ওয়াস সালাম) পৃথিবীতে তাশরীফ আনার আগে দুষ্ট জ্বীন বা শয়তানরা লওহে মাহফুযে উঁকিঝুঁকি মেরে ভবিষ্যতের জ্ঞান জেনে নিয়ে গণক ও জ্যোতিষদের জানিয়ে দিতো। এভাবেই হযরত মূসার (’আলাইহিস সালাম) সম্পর্কে ফেরাউনের গণকরা আগাম খবর পায়। অবশ্য নবীজীর তাশরীফ আনার পরে, এ ওদের এ সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
ইলমে গায়েব ও ইলমে শাহাদাতের অন্যতম ভান্ডার বা প্রধানতম সূত্র হচ্ছে, কুরআন মজীদ। প্রথমত, লওহে মাহফুযে যা কিছু লিপিবদ্ধ রয়েছে – আল-কুরআনেও তা লিপিবদ্ধ রয়েছে। মহান আল্লাহপাক শর্তহীন ও দ্ব্যর্থহীনভাবে ফরমান: আমি কিতাবে কোন কিছুই বাদ দেই নি (সূরা আন’য়াম:৩৮)। তাফসীরে ইবনে আব্বাসে এ আয়াতে কারীমার তাফসীরে লিখা আছে, “লওহে মাহফুযে আমি যা কিছু লিখে রেখেছি – তার কোন কিছুই বাদ দেই নি; সবই কুরআনে বর্ণনা করেছি।
দ্বিতীয়ত, পবিত্র কুরআনে প্রতিটি জিনিসেরই (ইলমে গায়েব ও ইলমে শাহাদাত) স্পষ্ট ও বিস্তারিত বিবরণ ও ব্যাখ্যা রয়েছে (সূরা ইউসূফ:১১১ ও সূরা নাহল:৮৯)।
ইলমে গায়েব ও ইলমে শাহাদাতের অন্যতম ভান্ডার বা সূত্র হচ্ছে, হাদীছ শরীফ। প্রথমত, যেহেতু, নবীজী (’আলাইহিস্ সলাতু ওয়াস সালাম) ইলমে গায়েব ও ইলমে শাহাদাতের প্রধান ভান্ডার বা সবচেয়ে বড় সূত্র – সেহেতু, তাঁর পবিত্র জবান, কাজ, অনুমোদন, আচরণ ও হাদীছে কুদসি নিঃসন্দেহে গায়েব ও শাহাদাতের জ্ঞান-ভান্ডার।
দ্বিতীয়ত, “নবী” অর্থ যেমনি গায়েবের খবরদাতা – ওহী বা প্রত্যাদেশও তেমনি গায়েবের বিষয় (সূরা আলে ইমরান:৪৪ ও সূরা হুদ:৪৯) – যা গায়েবের উৎস মহান আল্লাহপাকের তরফ থেকে আসা। আর কুরআন মজীদ ও হাদীছ শরীফ – উভয়ই ওহী। কুরআন শরীফ ওহীয়ে মাতলু বা তেলাওয়াৎযোগ্য ওহী এবং হাদীছ শরীফ ওহীয়ে গায়রে মাতলু বা অতেলাওয়াৎযোগ্য ওহী।
তৃতীয়ত, হাদীছ শরীফে কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার দিন-তারিখ, কিয়ামতের আলামত, হযরত ঈসা ও ইমাম মাহদীর (’আলাইহিমাস সালাম) আগমন, দাজ্জাল ও দাব্বাতুল আরদের আবির্ভাব, পশ্চিমে সূর্যোদয়, হযরত ইস্রাফীলের (’আলাইহিস সালাম) শিঙ্গায় ফুৎকার, ফেরেশতা, হুর, জ্বীন, শয়তান, বেহেশত, দোযখ, পুলসিরাত, শাফায়াত, আলমে বারঝাখ, হাশর-নশর ইত্যাদি সংক্রান্ত বহু ভবিষ্যৎবাণী ও বর্ণনা রয়েছে – যেগুলো সন্দেহাতীতভাবে ইলমে গায়েবের অন্তর্গত।
ইলমে গায়েবের অন্যতম ভান্ডার বা সূত্র হচ্ছেন, অন্যান্য নবী (’আলাইহিমুস সালাম)। প্রথমত, আল্লাহুতা’লা তাঁর মনোনীতি রাসূলগণকে (’আলাইহিমুস সালাম) গায়েব জানিয়েছেন (সূরা আলে ইমরান:১৭৯ ও সূরা জ্বীন:২৬-২৮)।
দ্বিতীয়ত, “নবী” শব্দের অর্থই হচ্ছে, গায়েবের খবরদাতা। (এটা আগেই প্রমাণসহ উল্লেখ করেছি)
তৃতীয়ত, যেহেতু প্রত্যেক নবী আমাদের প্রাণের চেয়েও প্রিয় নবীজীর প্রতি ঈমান আনতে এবং তাঁকে সাহায্য করতে মহান আল্লাহপাকের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ (সূরা আলে ইমরান:৮১ ও ৮২) – সেহেতু, তাঁরা প্রত্যেকেই যাঁর যাঁর উম্মতকে মীলাদুন্নবীর তথা তাঁর আগমনের সুসংবাদ দিয়েছেন বা এ ব্যাপারে ভবিষ্যৎবাণী (গায়েব) করেছেন।
চতুর্থত, আল্লাহুতা’লা হযরত আদমকে (’আলাইহিস সালাম) প্রতিটি জিনিসের (গায়েব ও শাহাদাতের) নাম শিখিয়েছেন (সূরা আল-বাকারাহ:৩১)।
পঞ্চমত, হাদীছ শরীফে রয়েছে, প্রত্যেক নবী (’আলাইহিমুস সালাম) যাঁর যাঁর উম্মতকে দজ্জালের ব্যাপারেও সতর্ক করেছেন বা ভবিষ্যৎবাণী (গায়েব) করেছেন।
ষষ্ঠত, পবিত্র মেরাজের রজনীতে সায়্যিদুনা শাফীউল মুযনিবীন (সল্লাল্লাহুতা’লা ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন মহান আল্লাহপাকের তরফ থেকে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজের তোহফা নিয়ে ফিরছিলেন – তখন, হযরত মূসা (’আলাইহিস সালাম) “উম্মতে মুহাম্মাদী এতো নামাজ আদায় করতে পারবে না” – মর্মে ভবিষ্যৎবাণী (গায়েব) করেন এবং তাঁকে বারবার নামাজ কমিয়ে আনতে অনুরোধ করেন।
সপ্তমত, আল্লাহুতা’লা হযরত খিজিরকে (’আলাইহিস সালাম) ইলমে লাদুন্নী দান করেছেন (সূরা আল-কাহাফ: ৬৫)। তাফসীরে তাবারীতে হযরত ইবনে আব্বাসের (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) সূত্রে এবং তাফসীরে বয়দ্বাভী, নাসাফী, খাঝিন ও তাফসীরে রূহুল বয়ানে এ আয়াতে কারীমার তাফসীরে লিখা হয়েছে যে, ইলমে লাদুন্নী মানে ইলমে গায়েব – যা আল্লাহুতা’লা হযরত খিজিরকে (’আলাইহিস সালাম) দান করেছেন।
ইলমে গায়েবের অন্যতম ভান্ডার বা সূত্র হচ্ছে, অন্যান্য আসমানি কিতাব। প্রথমত, পবিত্র কুরআন আগেকার আসমানি কিতাবগুলোর সমর্থক (সূরা ইউনূস:৩৭ ও সূরা ইউসূফ:১১১)।
দ্বিতীয়ত, আসমানি কিতাব মানেই হচ্ছে, ওহীর সম্ভার। আর ওহী মানেই হলো, গায়েবের বিষয় (সূরা আলে ইমরান:৪৪ ও সূরা হুদ:৪৯)।
তৃতীয়ত, সেগুলোতে মহান আল্লাহপাকের পরিচিতি, নবীজীর (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) আগমনের ভবিষ্যৎবাণী, কবর ও পরকালের পুরস্কার ও শাস্তি, বেহেশত ও দোযখের বিবরণ, ফেরেশতাগণের কর্মকান্ড, কিয়ামত ও হাশর-নশরের বর্ণনা ইত্যাদি অবশ্যই ছিলো।
ইলমে গায়েব ও ইলমে শাহাদাতের অন্যতম ভান্ডার বা সূত্র হচ্ছেন, আওলিয়ায়ে কেরাম (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহুম)। প্রথমত, কুরআন শরীফে পরিষ্কার ও দ্ব্যর্থহীনভাবেই রয়েছে যে, আল্লাহতা’লা তাঁর ওলীদেরকেও গায়েব জানিয়ে দেন বা দান করেন। যেমন- তিনি হযরত মরিয়মকে (’আলাইহাস্ সালাম) জানিয়েছেন (সূরা আলে ইমরান:৪২, ৪৩, ৪৫-৪৭ ও সূরা মরিয়াম:২৪-২৬)। অথচ তিনি নবী ছিলেন না, বরং ওলীয়া ছিলেন।
দ্বিতীয়ত, আওলিয়ায়ে কেরামের কারামত সত্য। আর এ কারামতকে চোদ্দ ইন্দ্রিয় দিয়ে প্রমাণ করা যায় না, বরং বিশ্বাস করতে হয়। তাই, এ কারামতও ইলমে গায়েবের অন্তর্গত।
তৃতীয়ত, বহু ওলী কাশফ বা স্বজ্ঞার অধিকারী ছিলেন এবং তাঁরা ইলহাম লাভ করতেন। আর কাশফ ও ইলহামও অতীন্দ্রিয় জ্ঞান বা গায়েবের বিষয়। কেননা, এগুলোকে ইন্দ্রিয় দিয়ে প্রমাণ বা অনুধাবন করা যায় না। (সূত্র: আওলিয়ায়ে কেরামের বিশ্বস্ত জীবনী)
চতুর্থত, বহু ওলী কাশফুল কুবুরও ছিলেন – যাঁরা কবরবাসীদের হাল-হাকীকত জানতে পারতেন। গাউছে পাক ও খাজা গরীবে নেওয়াজ প্রমুখের (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহুম) বিশ্বস্ত জীবনীগুলো এর সাক্ষ্য বহন করছে; যেমন- বাহজাতুল আসরার, সিয়ারুল আকতাব, আনিসুল আরওয়াহ, সিররুল আরিফীন, খাজিনাতুল আসফিয়া ইত্যাদি।
পঞ্চম প্রশ্নের (আলিমুল গায়েব অর্থ কী এবং আল্লাহুতা’লা ছাড়া আর কেউ আলিমুল গায়েব কিনা?) উত্তর হচ্ছে, আলিমুল গায়েব শব্দের অর্থ হলো, গায়েবজান্তা এবং আল্লাহুতা’লা ছাড়া অন্য কেউ আলিমুল গায়েব হতে পারেন – যেভাবে তিনি ধনী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মাখুলক ধনী হতে পারে। যেমন- তিনি ফরমান: আর আল্লাহ্ ধনী এবং তোমরা (বান্দারা) ফকীর (সূরা মুহাম্মাদ:৩৮)। অথচ তারপরেও নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিককে শরীয়তে ধনী বলা হয়। যারা বলে, আল্লাহুতা’লা ছাড়া আর কেউ আলিমুল গায়েব হতে পারেন না – তারা “আলিমুল গায়েব” শব্দের অর্থ ও মর্ম বোঝেন নি, বরং তারা আলিমুল গায়েবকে মালিকুল গায়েব ভেবে ভুল বুঝেছেন; যদিও তিনি সন্দেহাতীতভাবে মালিকুল গায়েব ও মালিকুশ শাহাদাত। তাই বলে, আলিমুল গায়েবের মর্ম কখনোই মালিকুল গায়েব নয়। আরেকটু পরিষ্কার ও সহজ করে বলছি: ধনী হওয়ার জন্যে যেমনি আসমান-জমীনের সকল ধন-ঐশ্বর্যের মালিক হওয়ার দরকার নেই, বরং নেসাব পরিমাণ তথা আংশিক সম্পদের মালিক হলেই চলে – তেমনি, আলিমুল গায়েব হওয়ার জন্যেও সকল গায়েব জানার দরকার নেই, বরং আংশিক জানলেই যথেষ্ট – যতোটুকু আল্লাহুতা’লা জানিয়েছেন।
লক্ষ্য করুন, আল-কুরআনে আল্লাহুতা’লার শানে “আলিমুল গায়েব” কথাটি মোট ১৩বার (সূরা আনয়াম:৭৩, সূরা তাওবা:৯৪ ও ১০৫, সূরা রা’দ:৯, সূরা মু’মিনূন:৯২, সূরা সাজদা:৬, সূরা সাবা:৩, সূরা ফাতির:৩৮, সূরা যুমার:৪৬, সূরা হাশর:২২, সূরা জুমু’য়া:৮, সূরা তাগাবুন:১৮ ও সূরা জ্বীন:২৬) এবং “আল্লামুল গুয়ূব” কথাটি মোট ৪বার (সূরা আল-মায়েদা:১০৯ ও ১১৬, সূরা তাওবা:৭৮ ও সূরা সাবা:৪৮) ব্যবহৃত হয়েছে। এবার আসুন, প্রাসঙ্গিক শব্দগুলো নিয়ে একটু বিশ্লেষণ করি। “আলিম” শব্দটির আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, জ্ঞানী বা জান্তা। এটি একটি ইসমু ফায়েল বা ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য – যা ধর্মীয় জ্ঞানে অভিজ্ঞ ব্যক্তির ক্ষেত্রে অহরহ ব্যবহৃত হয়। আর “আল্লামু” শব্দটি আলিম শব্দের ইসমু মুবালাগাহ (Hyperbolic word) – যার আভিধানিক অর্থ হলো, মহাজ্ঞানী। তেমনি, “গায়েব” শব্দটি মুফরাদ বা একবচনবাচক একটি শব্দ। এর বহুবচন হচ্ছে, “গুয়ূব”। সুতরাং আলিমুল গায়েব-এর আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে, গায়েবজান্তা; আর আল্লামুল গুয়ূব-এর আভিধানিক অর্থ হলো, সকল গায়েব সম্পর্কে মহাজ্ঞানী; অর্থাৎ “আলিমুল গায়েব” কথাটি সাধারণ অর্থ বোঝাচ্ছে; আর “আল্লামুল গুয়ূব” কথাটি ব্যাপক অর্থ বা অত্যুক্তি বোঝাচ্ছে! কিন্তু কালামে পাকে আল্লাহুতা’লার শানে দু’ রকমই ব্যবহারের উদ্দেশ্য কী – যেখানে একটি দিয়ে সাধারণ এলেমদার আর আরেকটি দিয়ে বেশি এলেমদার বোঝাচ্ছে? আরো স্পষ্ট করে বললে, আল্লাহুতা’লার জন্যে যদি শুধু আলিমুল গায়েব হওয়াই যথেষ্ট হতো – তাহলে, এর চেয়েও ব্যাপক অর্থবোধক “আল্লামুল গুয়ূব” কথাটি তিনি তাঁর নিজের শানে ব্যবহার করলেন কেন? তাঁর জ্ঞান বাড়ে-কমে নাকি (মায়াজাল্লা)? এর উদ্দেশ্য বা হেতু একটিই। আর তা হচ্ছে, বান্দার ক্ষেত্রে আলিমুল গায়েব শব্দটি ব্যবহার করা জায়েজ বলেই মহান আল্লাহপাক মাঝে মাঝে আলিমুল গায়েবের চেয়েও ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ (আল্লামুল গুয়ূব) নিজের জন্যে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু গোমরাহ ওয়াহাবী সম্প্রদায় আলিমুল গায়েব ও আল্লামুল গুয়ূবের পার্থক্য ও মর্ম বুঝতে অক্ষম! সোজা কথা হচ্ছে, “আল্লামুল গুয়ূব” আল্লাহ সুবহানাহুতা’লার একক বৈশিষ্ট্য বা সিফাত; কিন্তু আলিমুল গায়েব তাঁর সৃষ্টির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আর তাই, আম্বিয়া ও আওলিয়ায়ে কেরামও যাঁর যাঁর মর্তবা অনুসারে, আলেমুল গায়েব বা গায়েবজান্তা।
ষষ্ঠ প্রশ্নের (মহান আল্লাহপাক মহানবীকে ইলমে গায়েব দান করেছেন কিনা এবং করে থাকলে, কতোটুকু ও কিভাবে?) উত্তর হচ্ছে, সুন্নী জামায়াতের অধিকাংশ আলেমের মতে, মহান আল্লাহপাক অবশ্যই মহানবীকে (সল্লাল্লাহুতা’লা ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর গায়েবের আংশিক এলেম তথা সৃষ্টিকুল সংক্রান্ত সকল এলেম দান করেছেন। অবশ্য, কোনো কোনো আরেফবিল্লাহ্ বলেছেন: নবীজী আল্লাহুতা’লার সব এলেমই জেনেছেন। আল্লামা শেখ আবূল হাসান বিকরী, আল্লামা শেখ উসমাভী (রিদওয়ানুল্লাহিতা’লা ’আলাইহিমা) এবং তাঁদের অনুসারীগণ এ মতের অনুসারী। আর সকল সুন্নী আলেম ও ওলী একমত যে, আল্লাহুতা’লা নবীজীকে এক মুহূর্তে নয়, বরং ধীরে ধীরে গায়েবের এলেম দান করেছেন। যেমন- দুনিয়াতে তাঁর শানে কালামুল্লাহ শরীফ ধীরে ধীরে বা দীর্ঘ ২৩ বছরে নাযিল হয়েছে। তাছাড়া, আল্লাহুতা’লা ফরমান: আর আমি আপনার প্রতি নিজ থেকেই ওহী হিসেবে একটি রূহ নাযিল করেছি; এর আগে আপনি জানতেন না যে, কিতাব কী এবং ঈমান কী; তবে হাঁ, আমি সেটাকে এমন আলো বানিয়েছি – যা দিয়ে আমি আমার বান্দাদের মাঝে যাকে চাই – তাকে হেদায়েত করি। আর আপনিতো সহজ-সরল পথে হেদায়েত করেনই (সূরা শুরা:৫২)। তিনি আরো ফরমান: আপনার অতীতের চেয়ে ভবিষ্যৎ বেশি সমৃদ্ধ (সূরা দোহা:৪)। সুতরাং যতোই সময় গড়িয়েছে – ততোই তিনি বেশি বেশি করে গায়েবের এলেম জেনেছেন। গায়েবের আংশিক, নাকি পুরো এলেম লাভ করেছেন – এখন তা নিয়ে একটু আলোকপাত করবো।
অনাদিকাল থেকেই আল্লাহ সুবহানাহুতা’লার এলেম অসীম ও সত্তাগত; অর্থাৎ তাঁর এলেম কোথা থেকে বা কারো কাছ থেকে অর্জিত নয়। কেননা, তিনি সমাদ (অমুখাপেক্ষী বা স্বয়ংসম্পূর্ণ) পরম সত্তা। তিনি কখনো কারো কোনো ধার ধারেন না এবং তাঁর কর্মকান্ডের জন্যে কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। তবে তিনি তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু। আর গোটা মাখলুকাতে তাঁর সবচেয়ে প্রিয়পাত্র হচ্ছেন, সায়্যিদুনা মুহাম্মাদ মুস্তাফা আহমাদ মুজতাবা (সল্লাল্লাহুতা’লা ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম); তারপর, অন্যান্য নবী-রাসূল (’আলাইহিমুস সলাতু ওয়াস সালাম); এরপর তাঁর ওলীগণ (’আলাইহিমুর রাহমাহ), অতঃপর ফেরেশতাগণ (’আলাইহিমুস সালাম) এবং তারপর অন্যেরা। তাই, বেশিরভাগ সুন্নী আলেম মনে করেন যে, তিনি তাঁর প্রিয়পাত্রদের যাঁর যাঁর মর্যাদা অনুসারেই এলেম দান করেছেন। যেমন- তিনি ঘোষণা করেছেন: তিনি যতোটুকু চান – ততোটুকু ছাড়া তাঁর জ্ঞান থেকে তারা কোন কিছুই পায় না (সূরা আল-বাকারাহ:২৫৪)। তিনি আরো ফরমান: আর প্রত্যেক জ্ঞানবানের উপরে একজন মহাজ্ঞানী (আলীম) রয়েছে (সূরা ইউসূফ:৭৬)। এর তাফসীর রয়েছে, “(জ্ঞানের) এ ধারাবাহিকতা সবশেষে আল্লাহুতালা পর্যন্ত পৌঁছেছে। তাঁর জ্ঞান সবার জ্ঞানের চেয়ে বেশি।” (তাফসীরে ইবনে আব্বাস)
অন্যদিকে, ঐ আরেফগণের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, প্রথমত, আল্লাহুতা’লা নবীজীকে (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) শুধু ভালোইবাসেন না, বরং তিনি তাঁর হাবীব বা প্রেমাস্পদও বটেন। তাই, কালামে পাকে তিনি দ্ব্যর্থহীন ও শর্তহীনভাবে নিজ থেকে তাঁর হাবীবের সঙ্গে এভাবে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছেন: আপনার পালনকর্তা আপনাকে এমনি দেবেন যে, আমি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন (সূরা দোহা:৫)। সুতরাং এ পর্যায়ে নবীজী আল্লাহুতা’লার সকল এলেম জেনে নেয়ার দাবি করতেই পারেন। আর তাই, আয়াতুল কুরসির ঐ (তিনি যতোটুকু চান – ততোটুকু ছাড়া তাঁর জ্ঞান থেকে তারা কোন কিছুই পায় না) হুকুম নবীজীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা, আল্লাহুতা’লা তাঁর নিজের মর্জি মোতাবেক, সৃষ্টিকুলকে দান করেন। কিন্তু তাঁর হাবীবকে দান করেন – হাবীবেরই ইচ্ছা বা সন্তুষ্টি মোতাবেক।
দ্বিতীয়ত, আল্লাহুতা’লা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন: আপনি যা জানতেন না – তা আপনাকে শিখিয়েছেন (সূরা নিসা:১১৩)। এখানে শর্তহীনভাবে সার্বিক এলেমের (ইলমে গায়েব ও ইলমে শাহাদাত) কথাই বলা হয়েছে – আংশিক এলেমের কথা বলা হয় নি।
তৃতীয়ত, সবচেয়ে বড় বা পরম গায়েব হচ্ছেন, আল্লাহতা’লা নিজেই – যাঁকে পবিত্র মীরাজের রাতে নবীজী (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) দেখেছেন! কাজেই, এরপরেও কি তাঁর আর কোন গায়েব জানা বাকি থাকতে পারে? কেউ যদি বলেন: পারে। তাহলে, তাকে প্রশ্ন করছি যে, আল্লাহুতা’লার চেয়েও বড় গায়েব আর কিছু আছে নাকি? থাকলে, বলুনতো?
যাহোক, এ হচ্ছে, ইলমে গায়েব সম্পর্কে সুন্নী জামায়াতের আকীদা। যেহেতু, ধীরে ধীরে নবীজীকে (’আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালাম) গায়েবের এলেম জানানো হয়েছে – সেহেতু, তাঁর পূতপবিত্র দুনিয়াবী জিন্দেগীতে এমনো কিছু ঘটনা ঘটে থাকতে পারে – যেগুলোর এলেম হয়তো তখনো তাঁর কাছে পৌঁছে নি, বরং পরে পৌঁছে ছিলো কিংবা পৌঁছে থাকলেও – স্থান-কাল-পাত্রের বিবেচনায়, সেসব প্রকাশের অনুমতি ছিলো না অথবা তিনি কোনো কারণে তা প্রকাশ করেন নি। যেমন- মা আয়েশা সিদ্দীকার (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহা) বিরুদ্ধে অপবাদ, রাজীর ঘটনা, বীরে মাওনার ঘটনা, হযরত উছমানের (রাদ্বিআল্লাহুতা’লা ’আনহু) শহীদ হওয়ার গুজবের প্রেক্ষিতে বায়াতে রিদওয়ান অনুষ্ঠিত হওয়া, ঝাইনাব বিনতে হারিস নামক ইহুদি নারীর দেওয়া ছাগীর বিষ মেশানো রান খাওয়া, উকুলের ঘটনা ইত্যাদি। এ বিষয়টা বুঝতে পারলে, ইলমে গায়েব সম্পর্কে অনেক সন্দেহেরই নিরসন হওয়া সম্ভব। ওয়া আল্লাহু ওয়া রাসূলুহু আ’লামু। ধন্যবাদ।