শানে রিসালত (কোরআনের আলোকে)
হুযূর-ই আকরাম সবার জন্য রসূল
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমান –
وَمَا اَرْسَلْنَاكَ اِلَّاكَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيْرًا وَنَذِيْرًا وَلَكِنَّ اَكْثَرَ النَّاسِ لَايَعْلَمُوْنَ-
তরজমা: এবং হে মাহবূব, আমি আপনাকে প্রেরণ করিনি, কিন্তু এমন রিসালত সহকারে, যা সমস্ত মানব জাতিতে পরিব্যাপ্ত করে নেয়, সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারী; কিন্তু অনেকে জানে না। [সূরা সাবা: আয়াত- ২৮, কানযুল ঈমান] এ আয়াত শরীফও হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর না’ত বা প্রশংসা। এ’তে হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর তিনটি বিশেষ গুণের উল্লেখ রয়েছে:
এক. সমস্ত মানুষের জন্য নবী হওয়া, দুই. ও তিন. সবার জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হওয়া। এ তিন বৈশিষ্ট্যের যথেষ্ট আলোচনা ‘সূরা ফোরক্বান’-এর প্রথম আয়াতে এবং ‘সূরা আহযাব’-এ করা হয়েছে। এখানে শুধু এতটুকু আরয করছি যে, হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর রিসালাত ব্যাপক, যা থেকে কেউ পৃথক হতে পারে না; সম্মানিত নবীগণ, ওলীগণ, মানুষ এবং মানুষ নয় এমন কেউও।
হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম এরশাদ করেছেন- আমাকে পাঁচটি জিনিষ এমনই দান করা হয়েছে, যেগুলো আমার পূর্বে কোন মানুষ পায়নি। ওইগুলো হচ্ছে- এক. এক মাসের পথের দূরত্ব ব্যাপী আমাকে ‘আতঙ্ক বা ভীতি’ দেওয়া হয়েছে, দুই. সমগ্র পৃথিবী আমার জন্য মসজিদ (নামায পড়ার উপযোগী) ও পবিত্র করা হয়েছে। ফলে যেখানেই নামাযের সময় হয়ে যায়- সেখানেই নামায পড়ে নেওয়া যায়। আর যদি পানি পাওয়া না যায়, তবে তায়াম্মুম করে নেওয়া যায়। তিন. গনীমতের মাল হালাল করা হয়েছে। এরপূর্বে কোন উম্মতের জন্য গনীমতের মাল হালাল ছিলো না। চার.আমাকে শাফা’আত-ই (কুবরা) দেওয়া হয়েছে। পাঁচ. নবী বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য প্রেরিত হতেন, কিন্তু আমি সমস্ত মানুষের দিকে প্রেরিত হয়েছি।
এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হলো যে, হুযূর-ই আকরামের রিসালাত সবার জন্য ব্যাপক। সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়া আলা আ-লিহী ওয়া আস্হাবিহী ওয়া বারাকা ওয়া সাল্লাম।
নবী পুরুষ ও উন্নত খান্দান থেকে হয়েছেন
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন-
اِنَّا اَرْسَلْنَكَ بِالْحَقِّ بَشِيْرًا وَّنَذِيْرًا وَّاِنْ مِّنْ اُمَّةٍ اِلَّا خَلَا فِيْهَا نَذِيْرًا-
তরজমা: হে মাহবূব! নিশ্চয় আমি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছি সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে এবং যেকোন সম্প্রদায়ই ছিলো, সবটির মধ্যে একজন সতর্ককারী গত হয়েছে। [সূরা ফাত্বির: আয়াত-২৪, কান্যুল ঈমান] এ আয়াত শরীফেও হুযূর-ই আকরামের তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা এরশাদ হয়েছে: এক. ব্যাপক রিসালাত, দুই. সুসংবাদদাতা হওয়া এবং তিন. সতর্ককারী হওয়া। আয়াতের শেষভাগে বিগত উম্মতগুলো সম্পর্কে তাদের পথপ্রদর্শকদের, আগমনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর বলা হয়েছে যে, যে সংখ্যক উম্মতই হয়েছে, তাদের সবার মধ্যে সতর্ককারীও এসেছেন; কিন্তু তাঁর সাথে হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর রিসালতের সম্পর্ক কি- সে কথাও গভীরভাবে চিন্তা-অনুধাবনের বিষয়। মর্মার্থ এযে, হে মাহবূব! আপনি তো সমস্ত উম্মতের জন্য প্রেরিত হয়েছেন, আপনার রিসালত সবার জন্য ব্যাপক, কিন্তু আপনার পূর্বে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর জন্য পৃথক পৃথক সতর্ককারী এসেছেন। সুতরাং এখন এ থেকে হুযুর-ই আকরামের না’ত (প্রশংসা) অতি উত্তমরূপে স্পষ্ট হয়ে গেলো।
এ আয়াত থেকে কেউ কেউ ধোঁকা খেয়েছে এমর্মে যে, তারা বলে বেড়ায়- ‘কোন ধর্মের নেতাকে মন্দ জানবে না। কৃষ্ণ, রামচন্দ্র, গৌতম বুদ্ধ প্রমুখ- সবাইকে সম্মান করো। কারণ, এরাও সবাই পয়গাম্বর ছিলো।’ (না‘ঊযুবিল্লাহ্) তারা আরো বলে, তাদের শিক্ষা নাকি লোকেরা বিগড়ে ফেলেছে। বোত-প্রতিমার পূজা করতে আরম্ভ করেছে; যেমনিভাবে খ্রিস্টান ও ইহুদিরা যথাক্রমে হযরত ঈসা ও হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম-এর শিক্ষাকে বিগড়ে ফেলেছে। আর ক্রুশ পূজা ইত্যাদিকে তাদের ধর্মে সন্নিবিষ্ট করে বসেছে।’ আর কিছু লোক তো একথা বলেও ধোঁকা খেয়েছে যে, ‘সম্মানিত নবীগণ মানুষ ছাড়াও অন্যান্য সৃষ্টি থেকেও এসেছেন। অর্থাৎ জিন্দের মধ্যে জিন্ নবী, না‘ঊযুবিল্লাহ্, ভাঙ্গী চামারদের মধ্যে ভাঙ্গী নবী। (না‘ঊযুবিল্লাহ্) অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যে ওই সম্প্রদায়ের নবী।’ কিন্তু এ উভয় ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। কারণ, অনেকের মতে, কৃষ্ণ, রামচন্দ্র ও গৌতম প্রমুখের দুনিয়ায় আসাও অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয়, নিছক ওই সব কল্পকাহিনীই তাদের দলীল, যেগুলো মুশরিকরা নিজ থেকে রচনা করে নিয়েছে। কারণ, কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায় যে, রামচন্দ্রের পিঠের উপর লেজ এবং গণেশের মুখের উপর হাতির শূড় ইত্যাদি। এগুলো আল্লাহর সৃষ্টির নিয়মের সম্পূর্ণ বিরোধী, বিবেক-বুদ্ধি এবং যুক্তিরও পরিপন্থী, পবিত্র ক্বোরআনের তো বিরোধী আছেই। কারণ, মহান রব তো এরশাদ করেছেন-
لَقَدْ خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ فِى اَحْسَنِ تَقْوِيْمٍ-
(তরজমা: আমি মানুষকে সুন্দর আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি।)
[সূরা ত্বীন: আয়াত- ৪] আর এরা তো মানুষই নয়, এগুলোর আকৃতি বানর ও অন্যান্য পশুর মতো, সুন্দর আকৃতি থেকেও বঞ্চিত, না‘ঊযুবিল্লাহ্! এগুলো পয়গাম্বরও হবে- এটা হতেই পারে না। হতে পারে- এগুলো কোন প্রজাতির পশু-প্রাণী, যেগুলোর মুশরিকরা পূজা করতে আরম্ভ করেছে, যেমনটি আজকাল বানর ও গাভীর পূজাও করা হচ্ছে। একথা বলা যে, ‘এরা মানুষ ছিলো, পবিত্র চরিত্রের অধিকারী ছিলো, কিন্তু মুশরিকরা এগুলোর আকৃতি বিকৃত করে এমন আকারে গড়ে নিয়েছে।’ তাতো মুশরিকদের এমন অমূলক ওকালতি ও তাদেরকে সমর্থন করা বৈ কিছুই নয়। এটা বিবেক বা যুক্তিরও পরিপন্থী। যখন খোদ্ এগুলোর মান্যকারীরা সেগুলোকে মানুষ বলছে না, বরং বানর, হনুমান এবং অন্যান্য পশুকে সেগুলোর সাথে সম্পৃক্ত করছে, তখন আপনাদের নিকট কি এমর্মে ওহী (!) এসে গেছে যে, ‘এরা মানুষ ছিলো! আর এমন এমন ছিলো?’ অন্যথায়, যে সব বোতের পূজা আরবের মুশরিকরা করতো, সেগুলোকেও মন্দ বলা যাবে না, অথচ ক্বোরআন ও ক্বোরআনের মালিক লাত, ওয্যা ও মানাতকে মন্দ বলেছেন। সুতরাং ওখানে লাত ও ওয্যা ছিলো, এখানে মহাদেব ও ভবানী ইত্যাদি রয়েছে।
একথাও ভুল যে, ‘প্রত্যেক জনগোষ্ঠীতে তাদের থেকে নবী এসেছে।’ সম্মানিত নবীগণ সবসময় উন্নত বংশের, অভিজাত খান্দানের ও মাতা-পিতা উভয় দিক দিয়ে সম্ভ্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের চরিত্র যেমন উন্নত ছিলো, তেমনি তাঁদের চেহারা-সূরত শরীফ ছিলো নূরানী। অনুরূপ, তাঁদের বংশও অতি উন্নত। বোখারী শরীফের শুরুতে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি আবূ সুফিয়ান ও মক্কাবাসীদের ডেকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অবস্থাদি সম্পর্কে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তাঁর ওই সব প্রশ্নের মধ্যে এটাও ছিলো যে, তিনি বংশ ও খান্দানের দিক দিয়ে কেমন? মক্কার লোকেরা বলেছিলো, ‘‘তিনি সমগ্র আরবে সর্বোচ্চ বংশ মর্যাদা সম্পন্ন।’’ হিরাক্লিয়াস বলেছিলেন, ‘‘হাঁ, নবীগণ উন্নত বংশেরই হয়ে থাকেন।’’ সুতরাং এটা কিভাবে হতে পারে যে, ভাঙ্গীদের মধ্যে ভাঙ্গী এবং চামারদের মধ্যে চামার পয়গাম্বর হবেন? আল্লাহরই পানাহ্।
এ আয়াতে এটা কখন ও কোথায় বলা হয়েছে যে, প্রত্যেক জনগোষ্ঠীতে ওই জনগোষ্ঠী থেকে নবী প্রেরিত হয়েছেন? এরশাদ হয়েছে প্রত্যেক সম্প্রদায়ে হিদায়তকারী (পথপ্রদর্শক) পৌঁছেছেন, কিন্তু তাঁরা ছিলেন উন্নত খান্দান বা বংশের। যেমন আজ সমগ্র দুনিয়ায় সমস্ত জনগোষ্ঠীর নবী হলেন হুযূর-ই আকরাম আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম, যিনি আরবী, ক্বোরায়শী, হাশেমী ও মুত্তালিবী। সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম।
এ দু’টি কথা যেন অবশ্যই স্মরণ থাকে- এক. মানুষ জাতি ব্যতীত অন্য জাতির মধ্যেও তাদের জাতি থেকে নবী এসেছেন বলা নিরেট ভুল ধারণা, ভুল কথা। কেননা, ক্বোরআন-ই করীম এরশাদ করেছে-
وَمَا اَرْسَنَا قَبْلَكَ اِلَّا رِجَالًا نُوْحِىْ اِلَيْهِمْ-
তরজমা: এবং আমি আপনার পূর্বে প্রেরণ করিনি, কিন্তু পুরুষগণকে, যাদেরকে আমি ওহী করতাম।
[সূরা আম্বিয়া: আয়াত-৭, কান্যুল ঈমান] এ থেকে বুঝা গেলো যে, নবী মানুষ থেকেই হয়েছেন এবং পুরুষই হয়েছেন। এর পূর্ণাঙ্গ গবেষণালব্ধ আলোচনা ‘জা-আল হক্বক্বু ওয়া যাহাক্বাল বাত্বিল’-এ দেখুন।
এ আয়াতের সহীহ মর্মার্থ এ যে, প্রত্যেক সম্প্রদায়ে সতর্ককারী এসেছেন- চাই তাঁরা পয়গাম্বর হোন, কিংবা ওলামা ও বুযুর্গানে দ্বীন হোন।
‘তাসফীর-ই রূহুল বয়ান’ প্রণেতা মহোদায় বলেছেন, এখানে উম্মত মানে ওই উম্মতগণ বুঝানো হয়েছে, যাদের উপর দুনিয়ায় আযাব (শাস্তি) এসেছে। সুতরাং মর্মার্থ এটা দাড়ালো যে, যে যে জনগোষ্ঠীর উপর আযাব এসেছে, তাদের মধ্যে ইতোপূর্বে নবীগণ; আলিমগণ ও নেক্কার বুযুর্গগণকে প্রেরণ করেছেন, তারা তাদেরকে আযাব সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। যখন তারা মানেনি, তখন আযাব (শাস্তি) এসেছে। এ তাফসীরের সমর্থন করছে এ-ই আয়াত-
وَمَا كُنَّا مُعَذَّبِيْنَ حَتَّى نَبْعَثَ رَسُوْلًا-
তরজমা: এবং আমি শাস্তিদাতা নই যতক্ষণ না রসূল প্রেরণ করি। [সূরা বনী ইস্রাঈল: আয়াত- ১৫, কান্যুল ঈমান] অন্যথায় কোন কোন উম্মত তো এমনও গত হয়েছে, যাদের মধ্যে কোন পয়গাম্বর পৌঁছেননি। মহান রব এরশাদ ফরমাচ্ছেন-
وَمَااَرْسَلْنَا اِلَيْهِمْ قَبْلَكَ مِنْ نَذِيْرٍ-
তরজমা: এবং আমি আপনার পূর্বে তাদের নিকট কোন সতর্ককারী প্রেরণ করিনি।
[সূরা সাবা: আয়াত -৪৪, কান্যুল ঈমান] প্রত্যেকে জানে হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম ও হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর মধ্যে ৬০০ বছরের ব্যবধান ছিলো। (বোখারী : ১ম খণ্ড) এ দীর্ঘ সময় দুনিয়ায় কোন পয়গাম্বর আসেননি। সুতরাং এ দু’টি পদ্ধতি (তাফসীর) উত্তম মনে হচ্ছে, যেগুলো বর্ণনা করা হয়েছে।
(সংগৃহীত)