শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক শাস্তির প্রভাব ও প্রতিকার
সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বহু বিদ্যালয়ে প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থী নির্যাতন চলছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মারমুখি আচরণ কিছুতেই থামছে না। প্রায়ই শিক্ষকরা শিশুদের মারছেন, ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখছেন, নোংরা ভাষায় গালি দিচ্ছেন ইত্যাদি। প্রায়ই মিডিয়াতে এসব ঘটনার খবর আসছে। যদিও এসব ঘটনা মিডিয়াতে যতটা আসছে, বাস্তবে তা ঘটছে আরও বেশি।
শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন মূলত দুর্বল প্রতিপক্ষ শিশুর ওপর সবল শিক্ষকের অত্যাচার। এই অসম শক্তির সংঘাত যুগে যুগে হয়ে এসেছে। কখনও দাম্পত্য সম্পর্কে, কখনও কখনও দেশ, জাতি, ধর্ম, গোত্র, অর্থ, ক্ষমতা তথা যেকোন অসম সম্পর্কের ক্ষেত্রে। এ সংঘাত শাসক ও শোষিত, দুর্বল ও সবল, ক্ষমতাবান বা ক্ষমতাহীনের মধ্যে বিরাজমান। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, ‘এবিউজার’ ও ‘ভিকটিম’ দুই পক্ষই অনেক সময় বুঝতে পারে না যে তারা একটি অসম ও অস্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে আছে। না বুঝলেও এসব নির্যাতনের ফলে ভিকটিমের বা শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির পরিমাণ কমে না।
একলব্যকে যখন গুরু দ্রোণাচার্য তীরধনুক বিদ্যা শেখানোর মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে তাঁর শিষ্য হওয়ার জন্য গুরুদক্ষিণা হিসেবে একলব্যর ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলি চেয়ে বসেন (বৃদ্ধাঙ্গুলি না থাকলে একলব্য আর তীরধনুক চালাতে পারবে না), তখন একলব্য গুরুর মান রাখতে এবং তাঁর শিষ্য হওয়ার আশায় স্বেচ্ছায় নিজের হাতের বুড়ো আঙ্গুল কেটে দ্রোণাচার্যকে দিয়ে দেন।
এ ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, একজন শিক্ষার্থী কাছে শিক্ষকের মর্যাদা কতো ব্যাপক। আর কিছু শিক্ষক এ মর্যাদার সুযোগ নিয়ে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। পড়া না পারলে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীকে মারা বা সবার সামনে গালি দেওয়াকে আমাদের সামাজিক ব্যবস্থায় স্বাভাবিক মনে করা হয়, যদিও তা স্বাভাবিক নয়। শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের শাস্তিই শিক্ষার্থীর জন্য ক্ষতিকর।
যেকোন শারীরিক নির্যাতনকে যতোটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়, মানসিক নির্যাতনকে ততোটা করা হয় না। কারণ মানসিক নির্যাতন দেখা যায় না, দেখানোও যায় না। তারচেয়েও বড় বিষয় হলো, আমার মানসিক কষ্ট আমি নিজে যতটা অনুভব করব, অন্যেরা, এমনকি আমার অতি আপনজনেরাও ততটা করবে না, করতে পারবে না। তাই শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে মানসিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে অনেক অনেক বেশি।
শিক্ষক কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের ফলে প্রায়ই শিক্ষার্থীরা আহত হয়, মানসিক নির্যাতনের ফলে শিশুরা হতাশা, ভয়, নিরাপত্তাহীনতা, স্নেহবঞ্চনা, দুশ্চিন্তা এসবে ভোগে। ফলে শিশুদের মনে প্রচণ্ড মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় যা থেকে নানা মানসিক সমস্যা, যেমন দুর্বল ব্যক্তিত্ব, পরনির্ভরশীলতা, নানা পরিবেশ ও মানুষের সাথে সঙ্গতি বিধানের অক্ষমতা, কাউকে বিশ্বাস করতে বা ভালোবাসতে না পারা, ভঙ্গুর মানসিকতা, আত্মবিশ্বাসের অভাব ইত্যাদি হতে পারে। মানসিক নির্যাতন থেকে অনেক সময় শারীরিক অসুস্থতা, যেমন ট্রমা, বিষণ্নতা, অ্যাংজাইটি, আর্থারাইটিসের মতো কঠিন অসুখও হতে পারে।
যেসব শিশু মা-বাবা বা শিক্ষক কর্তৃক নানা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করে বড় হয়, সেসব শিশুরা মা-বাবা, শিক্ষক বা বড়দের কাছ থেকে ওসব আচরণ অনুকরণ করে। পরবর্তী জীবনে তারাও স্ত্রী, সন্তান, কাজের লোক বা অধীনস্থদের সাথে একই আচরণ করে। এভাবে বংশ-পরম্পরায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের প্রভাব চলতে থাকে চক্রাকারে।
শিক্ষার্থীদেরকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করলে শিশুদের যে সীমাহীন ক্ষতি হয় তা আমরা অনেকেই জানি না। শিশুদের ওপর শারীরিক ও মানসিক শাস্তির প্রভাবগুলো হলো:
১. শাস্তির প্রভাবে শিশুদের আত্মবিশ্বাস হ্রাস পায়;
২. পাঠে শিক্ষার্থীদের উদ্যম, মনোযোগ ও আনন্দ হ্রাস পায়;
৩. পাঠ্যবিষয়ের প্রতি ভীতি সৃষ্টি হয়;
৪. শাস্তির কারণে শিশুদের মধ্যে তীব্র অপমানবোধ বা লজ্জাবোধ হয়;
৫. নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে শিশুর মনে তীব্র হতাশা সৃষ্টি হয়;
৬. সহপাঠীদের কাছে নির্যাতিত শিশুরা অপমানিত বোধ করে;
৭. কখনও কখনও বিদ্যালয় ছেড়ে দেয়;
৮. বাজে কোনো নামকরণের ফলে (যেমন আদুভাই, গাধা,..) এসব নির্যাতিত শিশুরা দীর্ঘস্থায়ী মানসিক কষ্টে ভোগে;
৯. তাদের আত্মসম্মানবোধ, আত্মশ্রদ্ধা বা self esteem হ্রাস পায়;
১০. বিদ্যালয়ভীতি বা মানসিক কষ্ট থেকে মানসিক রোগও হতে পারে;
১১. নির্যাতনকারী এসব শিক্ষকদের প্রতি নির্যাতিত শিশুদের চরম অশ্রদ্ধা তৈরি হয়;
১২. তাদের মনে অহেতুক ভয় বা ফোবিয়া হতে পারে। এ ভয় সাপেক্ষীকরণের ফলে সব শিক্ষক বা সব বিষয়ের প্রতি স্থানান্তরিত হয়। ফলে সব শিক্ষকের প্রতি ভয় ও বিরক্তি সৃষ্টি হয়;
১৩. অর্জিত আবেগ, যেমন ভয়, দুশ্চিন্তা, পীড়ন, হতাশা, দুঃখ ইত্যাদির কারণে নির্যাতিত শিশুদের মনে পাঠে অনীহা সৃষ্টি হয়;
১৪. তারা সব শিক্ষককে অবিশ্বাস, সন্দেহ করে। ভয় পায়। পরে সংসার জীবনেও নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা কাউকে বিশ্বাস করতে না পারার কারণে অসুখী হয়;
১৫. এসব নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা অসামাজিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়। ফলে তারা কারও সাথে সহজভাবে মিশতে ও মানিয়ে চলতে পারে না;
১৬. সবসময় মানসিক অস্বস্তিতে ভোগে। অপমানের দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারে না;
১৭. নির্যাতিত শিশুরা পরবর্তী জীবনে সামান্য সমস্যায় পড়লেই তাদের মানসিক প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে ইত্যাদি।
প্রতিকার
১। খুব দ্রুত সব বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধ করতে হবে;
২। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে শৃংখলা ও নজরদারি বাড়াতে হবে;
৩। শিক্ষকদের জবাবদিহিতা ও শাস্তিবিধান কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে;
৪। শারীরিক ও মানসিক শাস্তির ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে শিক্ষকদেরকে সচেতন করতে হবে;
৫। সর্বোপরি, শাস্তি ছাড়া আধুনিক মনোবিজ্ঞান-সম্মত পাঠদান পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষকদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
ড. আকতার বানু: সহযোগী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।