রোযা ভঙ্গের কারণসমূহ যেসব কারণে কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরিঃ
রোযা ভঙ্গের কারণসমূহ যেসব কারণে কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরিঃ
===================================================
✍ মাসআলা ০১ঃ
রমযানে রোযা রেখে দিনে স্ত্রী সহবাস করলে বীর্যপাত না হলেও স্বামী-স্ত্রী উভয়ের উপর কাযা ও কাফফারা জরুরি হবে। একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে বলল, আমি রোযা রেখে স্ত্রী সহবাস করেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উপর কাফফারা আবশ্যক করেছিলেন।
➡ সহীহ বুখারী ৬৭০৯; জামে তিরমিযী ৭২৪; মুসান্নাফ আবদুর রযযাক ৭৪৫৭;
মুসনাদে আহমদ ২/২৪১ মুহাম্মাদ ইবনে কা’ব রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ ব্যক্তিকে (যে স্ত্রীসহবাসে লিপ্ত হয়েছিল) কাফফারা আদায়ের সাথে কাযা আদায়েরও আদেশ করেছিলেন।-মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৭৪৬১ বিখ্যাত তাবেয়ী আতা রাহ. বলেন, ‘স্বামী-স্ত্রী যখন মিলিত হয় তখন তাদের রোযা ভেঙ্গে যায়।’ প্রাগুক্ত ৭৪৬৭
✍ মাসআলা ০২ঃ
রোযা রেখে কোনো প্রকার শরীয়তসম্মত ওযর ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি হবে। এক ব্যক্তি রমযানে রোযা রেখে (ইচ্ছাকৃতভাবে) পানাহার করল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আদেশ করলেন, যেন একটি দাস আযাদ করে বা দুই মাস রোযা রাখে বা ষাট মিসকীনকে খানা খাওয়ায়।
➡ সুনানে দারাকুতনী ২/১৯১ ইমাম যুহরী রাহ. বলেন, ‘রমযানে রোযা রেখে যে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করবে তার হুকুম ইচ্ছাকৃতভাবে দিনে সহবাসকারীর অনুরূপ।’ অর্থাৎ তাকে কাযা ও কাফফারা উভয়টি আদায় করতে হবে।-মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, হাদীস : ৭৪৬৮
✍ মাসআলা ০৩ঃ
বিড়ি-সিগারেট, হুক্কা পান করলেও রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা ও কাফফারা উভয়টি জরুরি হবে। এই মাসআলার দলীল বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন : ঝাজরু আরবাবির রায়্যান আন শুরবিদ দুখান; তারবীহুল জানান বিতাশরীহি হুকমি শুরবিদ দুখান, আল্লামা আবদুল হাই লাখনোবী রাহ. মাসআলা : সুবহে সাদিক হয়ে গেছে জানা সত্ত্বেও আযান শোনা যায়নি বা এখনো ভালোভাবে আলো ছড়ায়নি এ ধরনের ভিত্তিহীন অজুহাতে খানাপিনা করা বা স্ত্রী সহবাসে লিপ্ত হওয়া হারাম। এতে রোযা সহীহ হবে না। আর যদি রোযার নিয়ত করার পর কেউ এমনটি করে থাকে তাহলে কাযা-কাফফারা দু’ টোই জরুরি হবে।
➡ সূরা বাকারা : ১৮৭; মাআরিফুল কুরআন ১/৪৫৪-৪৫৫
⭐⭐⭐ কাফফারা আদায়ের নিয়ম ⭐⭐⭐
✍ মাসআলা ০৪ঃ
একটি রোযার জন্য দুই মাস ধারাবাহিকভাবে রোযা রাখতে হবে। অসুস্থতার কারণে ধারাবাহিকতা ছুটে গেলে পুনরায় নতুন করে রোযা রাখতে হবে। পেছনের রোযাগুলো কাফফারার রোযা হিসাবে ধর্তব্য হবে না। তবে মহিলাদের হায়েযের কারণে ধারাবাহিকতা নষ্ট হলে অসুবিধা নেই। ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, ‘যার উপর কাফফারা হিসাবে দুই মাস ধারাবাহিকভাবে রোযা রাখা জরুরি সে যদি মাঝে অসুস্থ হওয়ার কারণে রোযা ভেঙ্গে দেয় তাহলে নতুন করে রোযা রাখা শুরু করবে।’
➡ আলমুহাল্লা ৪/৩৩১
⭐⭐⭐ যেসব কারণে শুধু কাযা করতে হয় ⭐⭐⭐
✍ মাসআলা ০৫ঃ
অযু বা গোসলের সময় রোযার কথা স্মরণ থাকা অবস্থায় অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। লাকিত ইবনে সাবিরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
بالغ في الاستنشاق إلا أن تكون صائما
‘তোমরা (অযু-গোসলে) ভালোভাবে নাকে পানি দাও তবে রোযা অবস্থায় নয়।’
➡ সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ২৩৬৩ সুনানে তিরমিযী হাদীস : ৭৮৫
সুফিয়ান সাওরী রাহ.-এর অভিমত হল, ‘রোযা অবস্থায় কুলি করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে গলার ভেতর পানি চলে গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং তা কাযা করতে হবে। অযু ফরয নামাযের জন্য হোক বা নফল নামাযের জন্য।
➡ মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক হাদীস : ৭৩৮০ আরো দেখুন : ইবনে আবী শাইবা ৯৮৪৪-৯৮৪৭
✍ মাসআলা ০৬ঃ
হস্তমৈথুনে বীর্যপাত হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। আর এটা যে ভয়াবহ গুনাহের কাজ তা বলাই বাহুল্য। * মহিলাদের সমকামিতায় (যা হারাম) শুক্রক্ষরণ ঘটলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। হাদীস শরীফে কামেচ্ছা চরিতার্থ থেকে বিরত থাকাকে রোযার অংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ঐ সত্ত্বার কসম, যার হাতে আমার জান। রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তাআলার নিকট মেশকের চেয়েও বেশি প্রিয় (আল্লাহ তাআলা বলেন) রোযাদার আমার জন্য পানাহার করা থেকে এবং কামোচ্ছা চরিতার্থ করা থেকে বিরত থাকে।
➡ সহীহ বুখারী ১/২৫৪
✍ মাসআলা ০৭ঃ
রোযা অবস্থায় হায়েয বা নেফাস শুরু হলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। পরে তা কাযা করতে হবে।
عن الحسن في المرأة أصبحت حائضا فطهرت بعد طلوع الفجر، قال : لا تأكل بقية يومها
যে হায়েযা মহিলা সুবহে সাদিকের পর পবিত্র হয়েছে তার সম্পর্কে হাসান বসরী রাহ. বলেন, সে অবশিষ্ট দিন আহার করা থেকে বিরত থাকবে। (অর্থাৎ রোযার মর্যাদা রক্ষার্থে সাদৃশ্য অবলম্বন করবে)।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, হাদীস : ৯৪৩২
عن إبرايهم : في الحائض تطهر فلا تأكل شيئا ـ كراهة أن تشبه المشركين إلى الليل
ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.ও বলেছেন, সে আহার করা থেকে বিরত থাকবে যাতে (রমযানের দিবসে পানাহারের কারণে) অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্য সৃষ্টি না হয়।
➡ মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা, হাদীস : ৯৪৩৪
✍ মাসআলা ০৮ঃ
মাথার এমন যখমে ওষুধ লাগালে রোযা ভেঙ্গে যাবে,যা দিয়ে ওষুধ মস্তিষ্কে চলে যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এমন স্থানে ওষুধ লাগাতে হলে পরে সে রোযা কাযা করে নিতে হবে।
* পেটের এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে রোযা ভেঙ্গে যাবে, যা দিয়ে ওষুধ পেটের ভেতর চলে যায়। বিশেষ প্রয়োজনে এমন ক্ষতে ওষুধ লাগালে পরে সে রোযার কাযা করে নিতে হবে।
* নাকে ওষুধ বা পানি দিলে তা যদি খাদ্যনালিতে চলে যায় তাহলে রোযা ভেঙ্গে যাবে এবং কাযা করতে হবে।
* গুহ্যদেশের ভেতর ওষুধ বা পানি ইত্যাদি গেলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত,
ذكر عنده الوضوء من الطعام، قال الأعمش مرة والحجامة للصائم فقال إنما الوضوء مما يخرج وليس مما يدخل، وإنما الفطر مما دخل وليس مما خرج.
শরীর থেকে (কোনো কিছু) বের হলে অযু করতে হয়, প্রবেশ করলে নয়। পক্ষান্তরে রোযা এর উল্টো। রোযার ক্ষেত্রে (কোনো কিছু শরীরে) প্রবেশ করলে রোযা ভেঙ্গে যায়, বের হলে নয় (তবে বীর্যপাতের প্রসঙ্গটি ভিন্ন)।
➡ সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৪/২৬১
✍ মাসআলা ০৯ঃ
সুবহে সাদিকের পর সাহরীর সময় আছে ভেবে পানাহার বা স্ত্রীসঙ্গম করলে রোযা ভেঙ্গে যাবে। তেমনি ইফতারির সময় হয়ে গেছে ভেবে সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতার করে নিলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। মাসআলা : রোযার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করল অতঃপর রোযা নষ্ট হয়ে গেছে ভেবে ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করল তাহলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে এবং কাযা করা জরুরি হবে। * বমি হওয়ার কারণে রোযা নষ্ট হয়ে গেছে মনে করে রোযা ভেঙ্গে ফেললে কাযা করতে হবে। আউন রাহ. থেকে বর্ণিত, মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রাত্র বাকি আছে ভেবে সাহরী খেলেন। তারপর জানতে পারলেন, তিনি সুবহে সাদিকের পর সাহরী করেছেন তখন তিনি বললেন, ‘আমি আজ রোযাদার নই।’ (অর্থাৎ আমাকে এ রোযার কাযা করতে হবে)।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৪৯ আলী ইবনে হানযালা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রোযার মাসে ওমর রা.-এর নিকট ছিলেন। তার নিকট পানীয় পেশ করা হল। উপস্থিতদের কেউ কেউ সূর্য ডুবে গেছে ভেবে তা পান করে ফেলল। এরপর মুয়াযযিন আওয়াজ দিল, হে আমীরুল মুমিনীন! সূর্য এখনো ডুবেনি। তখন ওমর রা. বললেন, ‘যারা ইফতারি করে ফেলেছে তারা একটি রোযা কাযা করবে। আর যারা ইফতারি করেনি তারা সূর্যাস্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।
➡ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/১৫০
⭐⭐⭐ যেসব কারণে রোযা ভাঙ্গে না ⭐⭐⭐
এমন কিছু কাজ আছে, যার দ্বারা রোযার কোনো ক্ষতি হয় না। অথচ অনেকে এগুলোকে রোযাভঙ্গের কারণ মনে করে। ফলে এমন কোনো কাজ হয়ে গেলে রোযা ভেঙ্গে গেছে মনে করে ইচ্ছাকৃত পানাহার করে। পক্ষান্তরে কেউ কেউ এসব কাজ পরিহার করতে গিয়ে অনাবশ্যক কষ্ট ভোগ করে। সুতরাং এসব বিষয়েও সকল রোযাদার অবগত হওয়া জরুরি।
✍ মাসআলা ১০ঃ
কোনো রোযাদার রোযার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার করলে তার রোযা নষ্ট হবে না। তবে রোযা স্মরণ হওয়ামাত্রই পানাহার ছেড়ে দিতে হবে। হাদীস শরীফে এসেছে-
من نسي وهو صائم فأكل أو شرب فليتم صومه، فإنما أطعمه الله وسقاه
যে ব্যক্তি ভুলে আহার করল বা পান করল সে যেন তার রোযা পূর্ণ করে। কারণ আল্লাহই তাকে পানাহার করিয়েছেন।
➡ সহীহ মুসলিম ১/২০২
✍ মাসআলা ১১ঃ
চোখে ওষুধ-সুরমা ইত্যাদি লাগালে রোযার কোনো ক্ষতি হয় না। হযরত আনাস রা. রোযা অবস্থায় সুরমা ব্যবহার করতেন।
➡ সুনানে আবু দাউদ ১/৩২৩
✍ মাসআলা ১২ঃ
রাত্রে স্ত্রীসহবাস করলে বা স্বপ্নদোষ হলে সুবহে সাদিকের আগে গোসল করতে না পারলেও রোযার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে কোনো ওযর ছাড়া, বিশেষত রোযার হালতে দীর্ঘ সময় অপবিত্র থাকা অনুচিত। হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, কখনো কখনো গোসল ফরয অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সকাল হত। অতঃপর তিনি গোসল করে রোযা পূর্ণ করতেন।
✍ মাসআলা ১৩ঃ
বীর্যপাত ঘটা বা সহবাসে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকলে স্ত্রীকে চুমু খাওয়া জায়েয। এতে রোযার কোনো ক্ষতি হবে না। তবে তরুণদের যেহেতু এ আশঙ্কা থাকে তাই তাদের বেঁচে থাকা উচিত। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে ছিলাম। ইতিমধ্যে একজন যুবক এল এবং প্রশ্ন করল, আল্লাহর রাসূল! আমি কি রোযা অবস্থায় চুম্বন করতে পারি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। এরপর এক বৃদ্ধ এল এবং একই প্রশ্ন করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ। আমরা তখন অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি জানি, তোমরা কেন একে অপরের দিকে তাকাচ্ছ। শোন, বৃদ্ধ ব্যক্তি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।-মুসনাদে আহমদ ২/১৮০, ২৫০ হযরত আবু মিজলায রাহ. বলেন, ইবনে আব্বাস রা.-এর নিকট এক বৃদ্ধ রোযা অবস্থায় চুমু খাওয়ার মাসআলা জিজ্ঞাসা করল। তিনি তাকে অনুমতি দিলেন। অতঃপর এক যুবক এসে একই মাসআলা জিজ্ঞাসা করলে তিনি তাকে নিষেধ করলেন।
➡ মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/১৮৫
✍ মাসআলা ১৪ঃ
অনিচ্ছাকৃত বমি হলে (এমনকি মুখ ভরে হলেও) রোযা ভাঙ্গবে না। তেমনি বমি মুখে এসে নিজে নিজেই ভেতরে চলে গেলেও রোযা ভাঙ্গবে না। من ذرعه القيء فليس عليه قضاء. رواه الترمذي وقال : حديث حسن অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো ব্যক্তির বমি হলে তার রোযা কাযা করতে হবে না।
➡ জামে তিরমিযী ১/১৫৩, হাদীস : ৭২০
✍ মাসআলা ১৫ঃ
শরীর বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে রোযা ভাঙ্গবে না। হযরত কাতাদাহ রা. বলেন, ‘রোযাদারের তেল ব্যবহার করা উচিত, যাতে রোযার কারণে সৃষ্ট ফ্যাকাশে বর্ণ দূর হয়ে যায়।
➡ মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/৩১৩
✍ মাসআলা ১৬ঃ
শুধু যৌন চিন্তার কারণে বীর্যপাত হলে রোযা ভাঙ্গবে না। তবে এ কথা বলাই বাহুল্য যে, সব ধরনের কুচিন্তা তো এমনিতেই গুনাহ আর রোযার হালতে তো তা আরো বড় অপরাধ।
* কামভাবের সাথে কোনো মহিলার দিকে তাকানোর ফলে কোনো ক্রিয়া-কর্ম ছাড়াই বীর্যপাত হলে রোযা ভাঙ্গবে না। তবে রোযা অবস্থায় স্ত্রীর দিকেও এমন দৃষ্টি দেওয়া অনুচিত। আর অপাত্রে কু-দৃষ্টি তো কবীরা গুনাহ। যা রোযা অবস্থায় আরো ভয়াবহ। এতে রোযাদার রোযার ফযীলত ও বরকত থেকে মাহরূম হয়ে যায়। হযরত জাবির ইবনে যায়েদকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীর দিকে কামভাবের সাথে তাকিয়েছে। ফলে তার বীর্যপাত ঘটেছে তার রোযা কি ভেঙ্গে গেছে? তিনি বললেন, ‘না। সে রোযা পূর্ণ করবে।’
➡ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬-২৫৯ আরো দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৫৮
✍ মাসআলা ১৭ঃ
মশা-মাছি, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি অনিচ্ছাকৃত পেটের ভেতর ঢুকে গেলেও রোযা ভাঙ্গবে না।
* ধোঁয়া বা ধুলোবালি অনিচ্ছাকৃতভাবে গলা বা পেটের ভেতর ঢুকে গেলে রোযা ভাঙ্গবে না। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘কারো গলায় মাছি ঢুকে গেলে রোযা ভাঙ্গবে না।’
➡ মুাসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/৩৪৯
✍ মাসআলা ১৮ঃ
স্বপ্নদোষ হলে রোযা ভাঙ্গে না। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ ভরে বমি হল। তিনি তখন বললেন- ثلاث لا يفطرن الصائم : القيء والحجامة والحلم. তিনটি বস্তু রোযাভঙ্গের কারণ নয় : বমি, শিঙ্গা লাগানো ও স্বপ্নদোষ।
➡ সুনানে কুবরা বাইহাকী ৪/২৬৪
✍ মাসআলা ১৯ঃ
চোখের দু’ এক ফোটা পানি মুখে চলে গেলে রোযার ক্ষতি হয় না। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, ‘রোযা অবস্থায় সিরকা অথবা অন্য কোনো বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করলে যদি তা গলার ভেতর না যায় তাহলে রোযা ভাঙ্গে না।’
➡ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৬/২০২
✍ মাসআলা ২০ঃ
সুস্থ অবস্থায় রোযার নিয়ত করার পর যদি অজ্ঞান, অচেতন বা পাগল হয়ে যায় তাহলে রোযা নষ্ট হবে না। হযরত নাফে রাহ. বলেন, হযরত ইবনে ওমর রা. নফল রোযা অবস্থায় বেহুশ হয়ে যেতেন কিন্তু এ কারণে রোযা ভেঙ্গে ফেলতেন না।
➡ সুনানে কুবরা বাইহাকী ৪/২৩৫
যাদের জন্য রোযা না রাখার অনুমতি রয়েছে
يا ايها الذين آمنوا كتب عليكم الصيام كما كتب على الذين من قبلكم لعلكم تتقون. اياما معدودت، فمن كان منكم مريضا او على سفر فعدة من ايام اخر وعلى الذين يطيقونه فدية طعام مسكين، فمن تطوع خيرا فهو خير له، وان تصوموا خير لكم ان كنتم تعلمون. شهر رمضان الذى انزل في القرآن هدى للناس وبينت من الهدى والفرقان، فمن شهد منكم الشهر فليصمه، ومن كان مريضا او على سفر فعدة من ايام اخر يريد الله بكم اليسر ولا يريد بكم العسر، ولتكملوا العدة ولتكبروا الله على ما هدكم ولعلكم تشكرون. (তরজমা) হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। গণা-গুনতি কয়েক দিন রোযা রাখতে হবে। তারপরও যদি তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময়ে সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে। যারা এর শক্তি রাখে তারা একজন মিসকীনকে খাবার খাইয়ে (রোযার) ফিদয়া আদায় করতে পারবে। এছাড়া কেউ যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো পুণ্যের কাজ করে, তবে তার পক্ষে তা শ্রেয়। আর তোমাদের যদি সমঝ থাকে, তবে রোযা রাখাই তোমাদের জন্য বেশি ভালো। রমযান মাস-যে মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, যা আদ্যোপান্ত হিদায়াত এবং এমন সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি সম্বলিত, যা সঠিক পথ দেখায় এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে চূড়ান্ত ফায়সালা করে দেয়। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তিই এ মাস পাবে সে যেন এ সময় অবশ্যই রোযা রাখে। আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ হয় বা সফরে থাকে, তবে অন্য সময় সে সমান সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই করতে চান। তোমাদের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করতে চান না, যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূরণ করে নাও এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যে পথ দেখিয়েছেন, সেজন্য আল্লাহর তাকবীর পাঠ কর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।
➡ সূরা বাকারা : ১৮৩-১৮৫
⭐⭐⭐ রোযা মাকরূহ হওয়ার কারণসমূহ ⭐⭐⭐
✍ মাসআলা ২১ঃ
কুলি করার সময় গড়গড়া করা এবং নাকে পানি দেওয়ার সময় উপরের দিকে পানি পৌঁছানো মাকরূহ। হযরত লাকিত ইবনে সবিরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- بالغ في الاستنشاق إلا أن تكون صائما ‘নাকে পানি দেওয়ার সময় ভালোভাবে নাকে পানি দাও, তবে রোযাদার হলে নয়।
➡ জামে তিরমিযী হাদীস: ৭৬৬; সুনানে আবু দাউদ ১/৩২২; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা হাদীস : ৯৮৪৪
✍ মাসআলা ২২ঃ
এমন কাজ করা মাকরূহ, যার দ্বারা রোযাদার নিতান্তই দুর্বল হয়ে পড়ে। যেমন শিঙ্গা লাগানো।
✍ মাসআলা ২৩ঃ
রোযা অবস্থায় শরীর থেকে রক্ত বের হলে বা ইনজেকশন ইত্যাদি দ্বারা রক্ত বের করলে রোযা ভাঙ্গবে না। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে এ পরিমাণ রক্ত বের করা মাকরূহ, যার দ্বারা রোযাদার খুব দুর্বল হয়ে যায়। সাবেত আলবুনানী রাহ. বলেন, হযরত আনাস রা. কে জিজ্ঞাসা করা হল রোযার হালতে শিঙ্গা লাগানোকে কি আপনারা মাকরূহ মনে করতেন? তিনি বলেন, ‘না। তবে এ কারণে দুর্বল হয়ে পড়লে তা মাকরূহ হবে।
➡ সহীহ বুখারী হাদীস ১৯৪০
✍ মাসআলা ২৪ঃ
রোযার হালতে গীবত করলে, গালি-গালাজ করলে, টিভি-সিনেমা ইত্যাদি দেখলে, গান-বাদ্য শ্রবণ করলে এবং যে কোনো বড় ধরনের গুনাহে লিপ্ত হলে রোযা মাকরূহ হয়ে যায়। আর এ কাজগুলো যে সর্বাবস্থায় হারাম তা তো বলাই বাহুল্য। একটি হাদীসে কুদসীতে আছে, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- اذا كان يوم صوم احدكم فلا يرفث ولا يصخب ‘তোমাদের কেউ যখন রোযা রাখে তখন সে যেন অশালীন কথাবার্তা না বলে ও হৈ চৈ না করে।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০৪; সুনানে আবু দাউদের রেওয়ায়েতে এ শব্দ রয়েছে, ‘রোযাদার যেন কোনো অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত না হয়।’ হাদীস : ৩৩৬৩ (১/৩২২) হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা-প্রতারণা ও গুনাহর কাজ ত্যাগ করে না আললাহ তাআলার নিকট তার পানাহার থেকে বিরত থাকার কোনো মূল্য নেই।’
➡ বুখারী, হাদীস ১৯০৩; সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ৩৩৬২ (১/৩২২)
⭐⭐⭐ যেসব কাজ রোযাদারের জন্য মাকরূহ নয় ⭐⭐⭐
✍ মাসআলা ২৫ঃ
রোযার হালতে প্রয়োজনে জিহ্বা দ্বারা কোনো কিছুর স্বাদ নেওয়া বা প্রয়োজনে বাচ্চাদের জন্য খাদ্য চিবানো মাকরূহ নয়। তবে সতর্ক থাকতে হবে, যেন স্বাদ গলার ভেতরে চলে না যায়। রোযাদার মহিলা তার বাচ্চার জন্য খাদ্য চিবানোকে ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. দোষের বিষয় মনে করতেন না।
➡ মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/২০৭
মাসআলা ২৬ঃ
রোযাদারের জন্য সুরমা লাগানো বা সুগন্ধি ব্যবহার করা মাকরূহ নয়। আতা রাহ. বলেন, ‘রোযাদারের জন্য সুরমা ব্যবহার করাতে দোষ নেই।’
➡ প্রাগুক্ত ৪/২০৮
✍ মাসআলা ২৭ঃ
রোযা অবস্থায় টুথ পাউডার ইত্যাদি ছাড়া শুধু মিসওয়াক ব্যবহার করা মাকরূহ নয়। এতে রোযার কোনো ক্ষতি হয় না; বরং অন্য সময়ের মতো রোযার হালতেও মিসওয়াক করা সুন্নত। হযরত আমির ইবনে রবীয়া রা. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি রোযার হালতে অসংখ্যবার মিসওয়াক করতে দেখেছি।
➡ সহীহ বুখারী ১/২৫৯; আবদুর রাযযাক ৪/২০০
✍ মাসআলা ২৮ঃ
রোযা অবস্থায় বিকেলে এমনকি ইফতারের পূর্বেও মিসওয়াক করা মাকরূহ নয়। বরং অন্য সময়ের মতোই সুন্নত। হাসান রাহ.কে রোযা অবস্থায় দিনের শেষে মিসওয়াক করার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘রোযা অবস্থায় দিনের শেষে মিসওয়াক করতে কোনো অসুবিধা নেই। মিসওয়াক পবিত্রতার মাধ্যম। অতএব দিনের শুরুতে এবং শেষেও মিসওয়াক করো।’-মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক ৪/২০২ ইবরাহীম রাহ. বলেন, ‘রোযা অবস্থায় দিনের শুরু ও শেষে মিসওয়াক করতে কোনো অসুবিধা নেই।’
➡ প্রাগুক্ত ৪/২০৩
✍ মাসআলা ২৯ঃ
গাছের কাঁচা ডাল দ্বারা বা পানিতে ভেজানো ডাল দ্বারা মিসওয়াক করা মাকরূহ নয়; বরং জায়েয। উরওয়া রাহ. রোযা অবস্থায় তাজা মিসওয়াক ব্যবহার করে মিসওয়াকের সুন্নত আদায় করতেন।-প্রাগুক্ত ৪/২০২ মুজাহিদ রাহ. রোযা অবস্থায় তাজা মিসওয়াক ব্যবহার করাকে দোষের মনে করতেন না। সুফিয়ান সাওরী রাহ. থেকেও অনুরূপ মত বর্ণিত আছে।
➡ প্রাগুক্ত ৪/২০২
সুত্রঃ আহলে হক মিডিয়া