খবরের বিস্তারিত...


সকালের যে ৬ টি অভ্যাস বদলে দেবে জীবন- ডঃ আব্দুল বাতেন মিয়াজী

পৃথিবীর বিখ্যাত, প্রতিষ্ঠিত এবং মর্যাদাবান ব্যক্তিবর্গ প্রতিদিন সকালে যে কাজগুলো করে থাকেন, তা নিয়ে আজ কথা বলবো। সেসব কাজ তাদের পুরো জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। শুনে অবাক হবেন, এই ৬ টি অভ্যাসের প্রতিটিই আসলে ইসলামের ভেতরে রয়েছে। একজন সক্রিয় ধার্মিক ব্যক্তি নিজের অজান্তেই এ কাজগুলোর সবগুলো পালন করে থাকেন। তবে অনেকেই এ ব্যাপারে সচেতন না থাকার কারণে সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সঠিকভাবে এবং সুচারুরূপে করতে গড়িমসি করেন ফলে আশানুরূপ ফল পান না। আসুন জেনে নেই সেই কাজগুলো কি কি।

বিভিন্ন গবেষক সহজে মনে রাখার জন্যে সেই ৬টি কাজের প্রথম অক্ষর নিয়ে ইংরেজি একটি এব্রেভিয়েশন করেছেন। S*A*V*E*R*S মানে Silence, Affirmations, Visualizations, Exercise, Reading and Scribe বা Writing.

১। S মানে silence অর্থাৎ প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই অন্য কিছু করার পূর্বে নীরবে ধ্যানে মগ্ন থাকা। ইসলামে যা নামায এবং আল্লাহ্‌ পাকের ইবাদত হিসেবে পরিচিত। সুফিদের কাছে তা মোরাকাবা আর কোন কোন ধর্মের মানুষের কাছে তা যোগ ব্যায়াম হিসেবে পরিচিত। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই এ ধরণের একাগ্রচিত্তে পুরো দিনের কার্যক্রমে মনোনিবেশ করাও এর উদ্দেশ্য। হাদিসে এসেছে, যে সকালের নামায বাদ দিয়েছে, শয়তানের কাছে সে সকালেই পরাভূত হয়েছে। ফলে তার সারাটি দিন যে ভাল কাটবে না তা থেকেই অনুধাবন করা যায়। কাজেই জীবনে সফল হতে হলে কোন ভাবেই শয়তানের কাছে পরাজয় বরণ করা চলবে না। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে হবে এবং মহান রবের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে তাঁর কাছে নিজেকে সপে দিতে হবে।

২। A মানে Affirmations অর্থাৎ আশাবাদি হওয়া। আপনার-আমার ভেতরে যেসব সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে সেসব সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আমার দ্বারা কিছু হবে না বা আমি এটা পারবো না, এ ধরণের মনোভাব পরিহার করা প্রয়োজন। সবার ভেতরেই কিছু না কিছু প্রতিভা লুকায়িত থাকে। কার কোন বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে এবং সে সম্ভাবনা নিজকেই খুঁজে বের করতে হবে। নৈরাশ্যকে পরিহার করে সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করা জরুরী। এ ব্যাপারে আল্লাহ্‌ পাক বলেন, “আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।” [সূরা রা’দঃ ১১]

৩। V হলো Visualizations মানে পরিকল্পনার চিত্রায়ন করা। আমাদের মনে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবার পরিকল্পনা করা। মনের আঙিনায় রঙ ও তুলি দিয়ে ছবি আঁকার মতো করে স্বপ্নের ছবি আঁকতে হবে। যে কোন কাজের পূর্বে সঠিক প্ল্যান ও পরিকল্পনা করা জরুরী। সঠিক পরিকল্পনা কাজের অর্ধেক বস্তবায়নের মতো। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন থেকে আমরা এরকম হাজার হাজার শিক্ষা নিতে পারি। আনুষ্ঠানিক নবুওয়ত লাভের পূর্বে তিনি নিজকে সুপরিকল্পিতভাবে তৈরি করে ছিলেন হেরা গুহায় ধ্যানের মাধ্যমে। আমরা যেহেতু আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাই আমাদের পরিকল্পনার পাশাপাশি আল্লাহ্‌ পাকের উপর আস্থা রাখা একজন খাঁটি মুমিনের কর্তব্য। আল্লাহ্‌ পাক এ কারণে সূরা কাহফের ২৩ ও ২৪ নম্বর আয়াতে নবী করীম ﷺ কে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আপনি কোন কাজের বিষয়ে ‘ইনশা আল্লাহ্‌’ ব্যতীত বলবেন না যে, সেটি আমি আগামী কাল করব।” অর্থাৎ আল্লাহ্‌ পাক ইচ্ছা করলে এ কাজটি আমি আগামীকাল করব বলা উত্তম এবং নিরাপদ। রাসূল ﷺ বলেন, “তোমাদের জন্য যা কল্যাণকর প্রাণপণে তা করো এবং আল্লাহর সাহায্য কামনা করো।”

৪। E তে Exercise অর্থাৎ ব্যায়াম করা বা নিজের দেহকে সুস্থ রাখার জন্য শরীরচর্চা করা। আমাদের অনেকেই এই ব্যাপারে খুব অসল। যদিও আমরা সবাই জানি এটা শরীর ও মননের জন্য খুবই দরকারি। কিন্তু খুব কম লোকই তা করে থাকি। খুব বেশি সময় কিংবা পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না, দিনে ১০ থেকে ৩০ মিনিট সময় শরীর চর্চার অভ্যাস করলেই চলে। হাঁটা কিংবা হালকা দৌড়ও যথেষ্ট ব্যায়াম হতে পারে। রাসূল ﷺ আমাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন আমরা যেন কাজে লেগে থাকি, কর্মমূখর হই এবং খুব সকালে আমাদের দিন শুরু করি আর এ সবই সুস্থ দেহের জন্য জরুরী। তিনি বলেন, “হে আল্লাহ্‌! আমার উম্মাহর জন্য সকালকে তুমি মহিমান্বিত করো”। [ইমাম আহমাদ, সুনানে ইবনে মাজাহঃ ২৩২১]। উল্লেখ্য, নামায সবচেয়ে বড় ব্যায়াম।

৫। R এ Reading অর্থাৎ পড়া এবং পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। প্রতিদিন সকালে কিছু পড়া খুব ভালো অভ্যাস। আর মুসলমান হিসেবে কুরআন পাঠ কিংবা হাদিস অধ্যয়ন সবচেয়ে উত্তম রীতি। গান্ধীজীর মতো একজন অমুসলিমও প্রতিদিন সকালে কুরআন পাঠ করতেন। মুসলমান হিসেবে আমাদের প্রতিদিন সকালে কুরআন পাঠ দিয়ে দিনের সূচনা করা উচিৎ এবং এতে আমাদের নিজেদের কল্যাণই নিহিত রয়েছে। আল্লাহ্‌ পাক বলেন, “সূর্য ঢলে পড়ার সময় থেকে রাত্রির অন্ধকার পর্যন্ত নামায কায়েম করুন এবং ফজরে কোরআন পাঠ করুন। নিশ্চয় ফজরের কোরআন পাঠ সাক্ষী হয়ে থাকে (ফেরেশতারা তা প্রত্যক্ষ করে থাকে)।” [সূরা বনী ইসরাইল ১৭:৭৮] রাসূল ﷺ বলেন, ফজরের দু’রাকাত সুন্নাত পৃথিবী এবং এর মাঝে যা কিছু আছে তা থেকে উত্তম”। [সহীহ মুসলিমঃ ৭২৫]

৬। Scribe মানে Writing। আমাদের অবচেতন মনে অনেক চিন্তা এবং ধারণা উদিত হয় আবার তা পরক্ষণেই নিভে যায়। বিখ্যাত ব্যক্তি মাত্রই সেসব বিচ্ছিন্ন চিন্তা ও ধারণাকে টুকে রাখেন। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিৎ জীবনের প্রতিটি ক্ষণে মনের ভাব, অভিব্যক্তি এবং বিচ্ছিন্ন ও ছুটাছুটি করা স্বপ্নগুলোকে টুকে রাখা। রাসূল ﷺ এর জীবন থেকে প্রতিটি বিষয়ের মতো এ বিষয়ে রয়েছে আমাদের জন্য আদর্শ। তিনি কুরআন নাজিল হবার সাথে সাথে তা লিখে রাখার জন্য তাগিদ দিতেন। প্রথম দিকে তাঁর কথা বা হাদিসগুলো টুকে রাখার ব্যাপার নিষেধাজ্ঞা দিলেও কুরআন নাজিলে পূর্ণতা আসার কাছাকাছি সময়ে তিনি তাঁর বাণীকে লিখে রাখতে উৎসাহিত করতেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্‌ পাক বলেন, “হে মুমিনগণ! যখন তোমরা কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ঋনের আদান-প্রদান কর, তখন তা লিপিবদ্ধ করে নাও এবং তোমাদের মধ্যে কোন লেখক ন্যায়সঙ্গতভাবে তা লিখে দেবে; লেখক লিখতে অস্বীকার করবে না। আল্লাহ তাকে যেমন শিক্ষা দিয়েছেন, তার উচিত তা লিখে দেয়া। এবং ঋন গ্রহীতা যেন লেখার বিষয় বলে দেয় এবং সে যেন স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করে এবং লেখার মধ্যে বিন্দুমাত্রও বেশ কম না করে।” [সূরা বাক্বারাঃ ২৮২]। ঋনের আদানপ্রদান লিপিবদ্ধ করে রাখার ব্যাপারে বলা হলেও, এ থেকে আমাদের জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নোট করে রাখার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

আল্লাহ্‌ পাক আমাদেরকে প্রতিটি সকালে এ অভ্যাসগুলো মেনে চলার তৌফিক দান করেন। আমীন।

~~ ডঃ আব্দুল বাতেন মিয়াজী (গবেষক ও লেখক)

Comments

comments