খবরের বিস্তারিত...


হিজরি সনের ইতিহাস ও গুরুত্ব

জুলাই 22, 2018 আক্বীদা

হিজরি সনের ইতিহাস

মানুষ তার জীবনের স্মৃতিময় দিনগুলোকে স্মৃতি হিসেবে পালন করার জন্য বিভিন্নভাবে দিন, মাস ও সময় গণনা করে থাকে। চন্দ্র ও সূর্য উভয়টির মাধ্যমে সন-তারিখ নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে। হিজরি সাল প্রবর্তনের পূর্বে আরবরা তাদের বিভিন্ন স্মরণীয় ঘটনার উপর নির্ভর করে দিন গণনা করত। যেমন-রাসূল সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম- এর আগমনের প্রায় ৪০ দিন পূর্বে সংঘটিত আবরাহা কর্তৃক কাবা ঘর ধ্বংস করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা দিন গণনা করত। এই গণনার জন্য হিজরি সন অন্যতম ইসলামী পদ্ধতি। হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু-এর যুগে একটি নির্দিষ্ট তারিখ হিসেব করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু সহ বিভিন্ন সাহাবীদের পরামর্শে একটি নির্দিষ্ট সন গণনার পরামর্শ চলে। এতে কেউ রাসূল সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম থেকে সাল গণনা করার কথা বলেন, কেউ বা তার ওপর ওহী আসার দিন থেকে, কেউ আবার তার ওফাত থেকে সাল গণনা করার অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুরাসূল সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর হিজরতের ঘটনা থেকে সাল গণনার প্রস্তাব উত্থাপন করেন, এতেসকল সাহাবী ঐকমত্যপোষণ করেন। কেননা, হিজরত সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করে।

আল-উকদুদ দিরায়ানামক গ্রন্থে রয়েছে-ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর শাসনামলে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর-এর নিকট একটি চুক্তিপত্র উপস্থিত করা হলো। সেখানে শাবান মাসের কথা উল্লেখ ছিল। তখন উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু বললেন, এটা কি গত শাবান না আগামী শাবান মাস? অতঃপর তিনি তারিখ গণনার নির্দেশ প্রদান করলেনএবং রাসূল সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মদীনায় হিজরতকে কেন্দ্র করে হিজরী সন গণনার সূচনা করেন। আর মহররমকে প্রথম মাস হিসেবে গণ্য করা হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হিজরত করেন ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই। সেই দিনকে মহররম মাসের শুক্রবার হিসেবে ধরে হিজরি সাল গণনা শুরু হয়। উক্ত হিজরি হিসেবের প্রথম প্রয়োগ ঘটেহযরত উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুর শাসনামলের ৩০ জমাদিউল উখরা/ ১৭ হিজরি অর্থাৎ ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় আজও হিজরি সন চলে আসছে। হিজরি সন গণনার আগে আরবরা আরবী মাসসমূহকে ব্যবহার করত। অন্যান্য সব সনের মতো হিজরি সনেরও ১২টি মাস। কেননা, আল্লাহর কাছেও ১২ মাসে এক বছর। মহানবী সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম যখন হিজরত করেন তখন ছিল রবিউল আউয়াল মাস। প্রশ্ন দেখা দেয়, তা হলে বছর শুরু ঐ মাসে না হয়ে মহররম মাসে হলো কিভাবে? মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,

নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনার মাস বারোটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। কাজেই এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না।

সূরা তাওবাহ; আয়াত-৩৬

এ আয়াতে চারটি সম্মানিত মাসকে চিহ্নিত করতে গিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজের সময় মিনা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বলেন, তিনটি মাস হলো জিলক্বদ, জিলহজ্ব ও মহররম এবং অপরটি হলো রজব।

তাফসীর ইবনে কাসির

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মাসের যে ধারাবাহিকতা ইসলামী শরীয়তে প্রচলিত রয়েছে, তা মানব রচিত নয়; বরং মহান রাব্বুল আলামীন যেদিন আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন সেদিনই মাসের তারতীব ও বিশেষ মাসের সাথে সংশ্লিষ্ট হুকুম-আহকাম নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। এ আয়াত দ্বারা আরো প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর দৃষ্টিতে শরীয়তের আহকামের ক্ষেত্রে চন্দ্র মাসইনির্ভরযোগ্য। চন্দ্র মাসের হিসাব মতেই রোজা, হজও জাকাত প্রভৃতি আদায় করতে হয়। তবে কোরআন মজীদ চন্দ্রকে যেমন, তেমনি সূর্যকেও সাল তারিখ ঠিক করার মানদন্ডরূপে অভিহিত করেছে। সুতরাং চন্দ্র ও সূর্য উভয়টির মাধ্যমেই সাল-তারিখ নির্দিষ্ট করা জায়েজ। তবে চন্দ্রের হিসাব আল্লাহর নিকট অধিকতর পছন্দনীয়। তাই শরীয়তের বিধি-বিধানকে চন্দ্রে র সাথে সংশ্লিষ্ট রেখেছেন। এজন্য চন্দ্র বছরের হিসাব সংরক্ষণ করা ফরযে কেফায়া। সকল উম্মত এ হিসাব ভুলে গেলে সবাই গোনাহগার হিসেবে গণ্য হবে। চাঁদের হিসাব ঠিক রেখে অন্যান্য সূত্রে হিসাব ব্যবহার করা জায়েয আছে। এ আয়াতের তাফসীরে আল্লামা ইমাম বাগাভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হিতার গ্রন্থ তাফসীরে বাগাভীতে উল্লেখ করেছেন-

বারো মাস হলো, মহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস ছানী, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানী, রজব, শাবান, রমজান, শাওয়াল, জিলক্বদ ও জিলহজ্ব। আর হারাম বা সম্মানিত চারটি মাস হলো-মহররম, রজব, জিলক্বদ ও জিলহজ্ব।

হিজরি সনের গুরুত্বঃ

মহান আল্লাহ তায়ালার বাণী-

লোকেরা আপনাকে নবচন্দ্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আপনি বলুন, তা হলো মানুষের এবং হজের জন্য সময় নির্ধারণকারী।

সূরা-বাকারা; আয়াত-১৮৯

এ আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের হিসাব-নিকাশের সুবিধার্থে পঞ্জিকা স্বরূপ চন্দ্রকে সৃষ্টি করেছেন। এজন্য, চন্দ্র মাস তথা হিজরী সনের গুরুত্ব অপরিসীম । মহান আল্লাহ চন্দ্র মাস সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলেন-

আমি রাত ও দিনকে করেছি দুটি নিদর্শন, রাত্রির নিদর্শনকে অপসারিত করেছি এবং দিনের নিদর্শনকে আলোকোজ্জ্বল করেছি যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করতে সক্ষম হও এবং রাতে তোমরা বর্ষ-সংখ্যাও হিসাব করতে পার এবং আমি সবকিছু বিশদভাবে বর্ণনা করছি।

এ আয়াত থেকে উপলব্ধি করা যায় যে, আল্লাহ তায়ালা অনুগ্রহ স্বরূপ তাঁর বান্দাদের সাল গণনা ও অন্যান্য হিসাব-নিকাশের দিন-রাতকে সৃষ্টি করেছেন।

(সংগৃহীত)

Comments

comments