শিশুর মানসিক বিকাশে শারীরিক শিক্ষা
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড আর আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই শিশুর ভবিষ্যৎ সুন্দর ও সুনিশ্চিত করতে এবং শিক্ষা অর্জনে তাকে বিদ্যালয়ের সঙ্গে পরিচয় করে দেয়া হয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুর দৈহিক, মানসিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক, মানবিক ও নান্দনিক বিকাশ সাধন করা এবং তাদের দেশাত্মবোধ, বিজ্ঞান মনস্কতা, সৃজনশীলতা ও উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে উদ্বুদ্ধ করা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই স্বপ্ন দর্শনে শিশুদের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তার অভিভাবক। শিশুদের প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। তবে এ প্রতিযোগিতা বাবা-মায়ের মধ্যে আরো তীব্র। তারা সারাক্ষণ কার শিশু কি করছে, কি পড়ছে, ভবিষ্যতে কি হতে ইচ্ছুক একথা জানতে ব্যাকুল। আর সেটা চাপিয়ে দিচ্ছেন নিজের শিশুর ওপর। তারা ভুলেই যান সব শিশুর চিন্তাচেতনা, অনুভূতি, গ্রহণ করার ক্ষমতা, অভিরুচি এক নয়। এজন্য শিশুর ধারণ ক্ষমতার কথা আগেই আমাদের চিন্তা করা দরকার।
শিশুদের শারীরিক ও মানসিক উন্নতি সাধনের পাশাপাশি তাদের সৃজনশীল চিন্তাচেতনার উন্নয়ন ঘটানোর জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এখানেও আছে অভিভাবকের হস্তক্ষেপ। শিশুটি কিভাবে পারফর্ম করবে সেটাও যেন বাবা-মা নির্ধারণ করে দেবে।
অবস্থা এমন যে, জিততে তাকে হবেই। হারলে রক্ষা নেই। তাদের বুঝতে হবে এখানে শিশুটির হার-জিত মূল বিষয় নয়। অংশগ্রহণ করে কতটা দক্ষতার সঙ্গে শেষ করল সেটাই বিবেচ্য বিষয়। অনেক সময় দেখেছি, কোনো শিশু খেলাধুলা বা অন্য কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলে তাকে পাশ থেকে বলে দেয়া হয় এভাবে করো বা এদিকে যাও। কথা না শুনলে ধমকও দেয়া হয়। এভাবে চললে তাদের মেধার বিকাশ ঘটবে কি করে? তাহলে তো আমরা তাদের চলার পথের সহায়ক না হয়ে অন্তরায় হয়ে যাচ্ছি। শিশুদের নিজের মতো অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। তাদেরকে ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’-এই মন্ত্রে দীক্ষিত করতে হবে। সঙ্গে নিজের সিদ্ধন্ত নিজে নেয়ার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। আমরা সারা জীবন তাদের পাশে থাকবো না।
প্রয়োজনের সময় আমাদের তারা পেল না। তখন কি সে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বসে থাকবে? শুধু শিশু কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদেরও এভাবে বন্দি করে রাখা হয়। সে কি খাবে, কিভাবে খাবে, কোন পোশাকটা পরবে, কিভাবে হাঁটবে, কখন কোন বিষয়ে লেখাপড়া করবে, কতটুকু অধ্যয়ন করবে, সবকিছুই বাবা-মা কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত রুটিন অনুযায়ী করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিশ্ববিদ্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্র্থী লিনা (ছদ্মনাম)। তাকে দেখলে যে কেউ মনে করবে মেয়েটা কতো স্বাধীন, মুক্তচিন্তার অধিকারী। মত প্রকাশের ক্ষমতাও সর্বোচ্চ। আলোর পেছনে থাকে অন্ধকার, উচ্ছলতার ভিতরেও থাকে জমাট বাধা ব্যথা। সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানতে পারে না। কথা হয়েছিল লিনার সঙ্গে। জানতে পারি তার অজানা বেদনা। আবেগ জড়িত কণ্ঠে বললো, “প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছি, সর্বোচ্চ শ্রেণিতে লেখাপড়া করি। তবুও পরিবারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আমারটাই প্রথমে আড়রফ করা হয়। বড়দের চাপিয়ে দেয়া কোনো মতামত আমি যেন মানতে বাধ্য। আর ক্যারিয়ার কোনদিকে নেবো, সেটাও তারা ঠিক করে দেবে। শুধু তাই না, আমার প্রতিদিনকার রুটিন তাদের তৈরি। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। এর থেকে মুক্তি চাই।”
পেশা বাছাইয়ের সময় সন্তানের মতামতকে অধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত। কোন পেশায় বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে, সেটা সে নিজেই বুঝবে। নিজেদের পছন্দ চাপিয়ে দিলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। শিক্ষার সর্বাচ্চ শিখরে অধ্যয়ন করেও যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে বাকিদের কথা আর না বলাই ভালো। এতো গেল মানসিক দিক। শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে শারীরিক শিক্ষা। শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে দুটি ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়- ‘শরীরের জন্য শিক্ষা, আর শরীরের মাধ্যমে শিক্ষা (আধুনিক মতবাদ)’। শারীরিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে শিশুর সুষ্ঠু শরীর গঠন, সামাজিক, মানসিক ও নৈতিক বিকাশ ঘটানো। যেন সে সমাজে দায়িত্বশীল ও সৃজনশীল নাগরিকের কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে। কথায় আছে, ‘সুস্থ দেহে সুন্দর মন’। সুস্থ দেহের যখন অভাব ঘটবে, সুন্দর মন তখন পালাবে। শারীরিক শিক্ষায় আমাদের শিশুরা অনেক পিছিয়ে।
আগের দিনে শিশুরা খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেত। ছিল খোলা মাঠ। সে সুযোগ-সুবিধা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। বর্তমান সভ্যতা সেগুলো কেড়ে নিয়েছে। ‘খেলা করে কি লাভ, তার চেয়ে কম্পিউটার শেখো, কাজে লাগবে’Ñ এই বলেই প্রথমে শিশুদের ব্রেনওয়াশ করা হয়। পরবর্তীতে সেই অভিভাবকের মুখেই শোনা যায়, আমার বাচ্চা খেতে চায় না, কোনো সময় সুস্থ থাকে না, চোখের সমস্যা, প্রচণ্ড মাথাব্যথা করে ওর’-এরূপ নানা অভিযোগ। বেশি সময় কম্পিউটার-ল্যাপটপ, মোবাইল ব্যবহার শুধু শিশু কেন, সব বয়সী মানুষের জন্যই ক্ষতিকর। তাছাড়া লেখাপড়া ছাড়া অন্যকিছু অর্থাৎ খেলাধুলা করার কথা ভাবার সময় কোথায়? প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের কথাই ধরা যাক। স্কুল ছুটি হয় সাড়ে চারটায়।
বাড়ি পৌঁছানোর আগেই সেখানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে প্রাইভেট টিচার। কখনো হাত-মুখ ধুয়ে আবার কখনো না ধুয়েই বসতে হয় পড়ার টেবিলে। কিছুক্ষণ চলার পর শিশুটি ক্লান্ত হয়ে নিজের অজান্তে কখন ঘুমিয়ে পড়ে নিজেই সে বুঝতে পারে না। সকালের ঘুমটাও তার প্রাইভেট টিচারের ডাকে ভাঙে। পড়া শেষ করেই বিদ্যালয়ের দিকে দৌড়। এভাবে যদি শিশুর রুটিন তৈরি করে দেয়া হয় তার অন্য কিছু করার সময় কোথায়? তাই এখনকার শিশুদের দেখতে পুষ্ট মনে হলেও ভেতরটা অন্তঃসারশূন্য। আমাদের জনগোষ্ঠীর একটা বৃহৎ অংশ শহরে বসবাস করে। শহরের স্কুলগুলোতে নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ। শুধু খেলার মাঠ কেন, দৃষ্টি প্রসারিত করার মতো জায়গাটুকুও সেখানে নেই।
মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে তুলনামূলক কম সময় দিতে হলেও বেশি সময় দিতে হয় প্রাইভেট টিচারের কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তচিন্তা ও অন্যান্য কার্যক্রম করার সময় থাকলেও আর হয়ে ওঠে না। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। লেখাপড়ার নিচের ধাপগুলো পার হতেই তাদের এসব বিষয়ে অনীহা সৃষ্টি হয়ে যায়। তাছাড়া তখন তাদের ছুটতে হয় বিভিন্ন তাগিদে। তাদের দিকে ভরসার দৃষ্টি মেলে আছে অসহায় বাবা-মাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্য। কর্মজীবনে প্রবেশ করার আগেই তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। আমাদের প্রতিদিনকার যে রুটিন তাতে যদি একটু খেলাধুলা, বিনোদন, মুক্তচর্চার সুযোগ থাকে তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও শিশুদের কর্মচঞ্চল রাখতে পারবো।
শারীরিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে সিএ বিউকার বলেছেন, ‘শারীরিক শিক্ষা হলো শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং শারীরিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে উপযুক্ত নাগরিক গড়ে তোলার লক্ষ্যে পৌঁছানোর এক প্রচেষ্টা মাত্র।” সবাইকে মনে রাখতে হবে, শারীরিক শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা শিশুদের অধিকার, আমাদের দেয়া ছাড় নয়। বর্তমানে সরকারিভাবে স্কুলগুলোতে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি শারীরিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। স্কুল পর্যায়ে শিক্ষকদের শারীরিক শিক্ষার ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এসব শিক্ষকের দায়িত্বশীল ভূমিকা শিশু এবং অভিভাবক উভয়ের ওপরেই কার্যকর হবে বলে আশা করি। বিদ্যালয় ও পরিবারকে ভীতিকর স্থানের পরীবর্তে আনন্দমুখর আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত রাখতে শারীরিক শিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রপ্ত শিক্ষকদের পাশাপাশি সকল শিক্ষকদের আন্তরিক হতে হবে। অভিভাবকদের বিশেষ করে মায়েদের এগিয়ে আসতে হবে। বাচ্চার সঙ্গে মাঝে মধ্যে বাড়িতে খেলতে হবে। তাদের বিভিন্ন খেলা শেখাতে হবে। শিশুদের চাওয়া অনুযায়ী পাওয়া দিলে বাড়তি দেয়ার হাত থেকে আমরা সবাই রেহাই পাবো। সেও ফেলতে পারবে স্বস্তির নিঃশ্বাস।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়