একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং সুন্নীয়ত ও ছাত্রসেনা
যারা একাত্তরের চেতনার মূলভিত্তি ধর্ম বাদ দেওয়ার কথা বলেন, বাংলাদেশে কায়েমে তাদের অবদানের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে বলতে চাই, একাত্তরে ধর্মপ্রাণ জনতার বিরাট অংশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে ভন্ডামী করে যারা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছিল, সেই রাজাকাররা ছিল ধর্মের নামে অতি ক্ষুদ্র গোষ্টী। একাত্তরে তাদের সংখ্যা দেশের মোট মুসলিমের 0.5% ও ছিল না।
তাই তাদের দোহাই দিয়ে দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলভিত্তি থেকে ধর্মকে বাদ দেওয়া ধর্মবিদ্ধেষ ছাড়া আর কিছু নয়। মুকিযুদ্ধ কোন সামরিক সমর ছিল না, এটা ছিল এক সুসজ্জিত ও প্রশিক্ষিত সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে কোটি কোটি নিরস্ত্র ভূখা মেহনতি জনতার এক অসম লড়াই। আর আল্লাহর রহমত না থাকলে এমন অসম লড়াইয়ে এই জাতির পক্ষে বিজয় লাভ সম্ভব হত না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজীবুর রহমানও তাই তার বক্তব্যে আল্লাহর সাহায্য চেয়ে বলেছিলেন,”এই দেশকে হানাদারমুক্ত করবই ইনশা আল্লাহ”
মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয় কোন কাকতালীয় ঘটনা নয়, এটা ধর্মপ্রাণ জনতার প্রার্থনা, চেষ্টা ও মহান রবের অনুগ্রহের ফসল। তাইতো কবি শামসুর রহমান তার কবিতায় বলেছিলেন, “সাধীনতা তুমি পিতার জায়নামাজের উদার জমিন”
আরো সুস্পষ্ট করে বললে, এই দেশের অলীভক্ত নবীপ্রেমিক লক্ষ লক্ষ সুন্নী জনতা ছিল ছিল বরাবরই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। ছাত্রসেনার অন্যতম প্রতিষ্টাতা এবং যিনি ছাত্রসেনার নামকরণ করেছিলন, সেই আল্লামা জাফর আহমদ সিদ্দীক (রহঃ) ১৯৭১ সালে মুক্তযুদ্ধের সময় তাঁর জিয়াউল উলুম নামক মাদ্রাসায় বুড়িশ্চর,মদুনাঘাট,বায়ুনা, শিকারদুর সহ আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য সংখ্যালঘু নিরীহ জনতাকে আশ্রয় দিয়ে লঙ্গরখানা খুলে দিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে এইভাবে অসংখ্য সুফী দরবেশ তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তযুদ্ধের সময় ইমাম-মুয়াজ্জিনরা শুধু মসজিদেই তাদের দায়িত্ত শেষ করেন নাই, বরঞ্চ এক হাতে তছবিহ আরেক হাতে অস্ত্র নিয়ে মাথায় কাফনের কাপড় পড়ে দেশের লাল-সবুজ পতাকার জন্য যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন, এদের অনেকেই বুকের তাজা রক্ত দিয়ে শহীদ হয়ে দেশের ইতিহাসে অমর হয়েছেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধে এই দেশের মহান অলীদের অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ হাতে সৈয়দ শফিউল বশর মাইজভাণ্ডারী বরাবর মুক্তিযুদ্ধের জন্য দোয়া চেয়ে একখানি পত্র লেখেন। সেই পত্রটি এখনও মাইজভাণ্ডার দরবারে সংরক্ষিত আছে।
বর্তমান সময়ের সুন্নীয়তের রাজনৈতিক সংগঠকদেরও ছিল ১৯৭১ সালে গৌরবজ্জল ভূমিকা। সুন্নী রাজনীতির আইকন সংগঠক, ছাত্রসেনার জাতীয় সংগঠন ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ এর সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক মমতাজ উদ্দীন চৌধুরী ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। শুধু সুন্নী রাজনৈতিক সংগঠক নয়, সুফীবাদী তরিকতপন্থী সংগঠনগুলোর ভাইরাও সেই সময় দেশের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে লড়েছেন। যেমন চট্টগ্রাম বন্দর থানা অন্তর্গত ৩৭ নং ওয়ার্ডের গাউছিয়া কমিটির সভাপতি ফজলুর বারীর ভূমিকাও হয়ত ইতিহাসের পাতায় লেখা হয় নাই। কিন্তু লাল-সবুজের পতাকার জন্য তারা সেই উত্তাল সময়ে জীবন বাজি রেখেছিলেন।
সুন্নী আলেমরাও ছিল অগ্রকাতারে। মাওলানা রহমত উল্লাহ নামে একজন সুন্নী আলেমের কথা জানি যিনি ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম আগ্রাবাদ মতিয়ার পুল জামে মসজিদের ইমাম ছিলেন, সেই ইমাম সাহেব মুক্তিযোদ্ধাদের সমড়াস্ত্র সমূহ নিরাপদে জমা রাখতেন এবং অপারেশনের সময় সেই অস্ত্র আবার মুক্তযোদ্ধাদের সরবরাহ করতেন। এই রকম বহু সুন্নী আলেমের মুক্তিযুদ্ধে অবদান ইতিহাসের পাতায় লেখা হয় নাই।
শুধু একাত্তরে নয়, একাত্তরের পরেও সুন্নীয়তের শক্তি বরাবরই সাধীনতার পক্ষে কাজ করেছে। জামাত-শিবির রাজাকাররা যে মুহুর্তে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকে ধর্মের সাথে নাস্তিকের যুদ্ধ বলার অপপ্রয়াস চালিয়েছে, সেই মূহুর্তে সুন্নীয়তের ছাত্র সংগঠন ছাত্রসেনা ধর্মীয় দল হিসেবে মাঠে ময়দানে মুকিযুদ্ধের শক্তি হিসেবে অবস্থান নিয়ে প্রমান করেছে, এই দেশের মুক্তিযুদ্ধ ধর্মের সাথে নাস্তিকের যুদ্ধ নয়, বরঞ্চ মুক্তিযুদ্ধ হল জালেমের সাথে মজলুমের যুদ্ধ। যেখানে জালেম হল ধর্মের নাম ভাঙ্গানো ভন্ড মওদুদীর অনুসারী জামাত-শিবির, আর মজলুম হল এই দেশের কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ জনতা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে যখন জামাত-শিবির ধর্মের অপবাদ দিয়ে বিতর্কিত করার প্রয়াস চালিয়েছে, হেফাজতের নেতৃত্তে ওহাবী-কওমীরাও যেই সময়ে জামাতের সাথে তাল মিলিয়েছে এবং নাস্তিকদের বিরুদ্ধে বললেও কিন্তু রাজাকারদের বিচার নিয়ে নীরব ভূমিকা পালন করে রাজাকারদের দালালী করেছে, তখন ঠিক সেই উত্তাল সময়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ধর্মীয় দল যেই দলটি প্রথমে মাঠে নেমেছে সেই দলটার নাম হল ছাত্রসেনা !! সুন্নী জনতাকে সাথে নিয়ে ছাত্রসেনা সেই সময় বাংলার পথ-প্রান্তরে শ্লোগান তুলেছে—লাল-সবুজ আর সুন্নীয়তের বাংলায় নাস্তিক আর রাজাকারদের ঠায় নাই !!
অথচ এক শ্রেনীর জ্ঞানপাপী বামপন্থী ও হলুদ সাংবাদিকরা মুক্তিযুদ্ধ ও সাধীনতার পক্ষে ছাত্রসেনা ও সুন্নীয়তের সেই অবদানকে কোন সময়ই সীকৃতি দেয় নাই, উল্টো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে ধর্ম আর সুন্নীয়তকে বাদ দেওয়ার বার বার অপচেষ্টা করে গেছে।
কিন্তু এই দেশের যতদিন ছাত্রসেনার একটা কর্মী জীবিত থাকবে, ততদিন সুন্নী জনতার প্রতিনিধি হিসেবে ছাত্রসেনা লাল-সবুজের প্রেমে এই বাংলার প্রতিটা প্রান্তে কাজ করে যাবে ইনশা আল্লাহ।
~~ ইকবাল হোসাইন
কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক (বিশ্ববিদ্যালয়), ইসলামী ছাত্রসেনা