খবরের বিস্তারিত...


আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত এর সংজ্ঞা ও আক্বীদা

জুলাই 22, 2018 আক্বীদা

পবিত্র হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে ইরশাদ মুবারক হয়েছে-

عن حَضْرَتْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرُوْ رَضِىَ اللهُ تَعَالـٰى عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَـمَ سَتَفْتَرِقُ اُمَّتِىْ عَلـٰى ثَلَاثٍ وَّسَبْعِيْنَ مِلَّةً كُلُّهُمْ فِىْ النَّارِ اِلَّا مِلَّةً وَّاحِدَةً. قَالُوْا مَنْ هِىَ يَا رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّـمَ قَالَ مَا اَنَا عَلَيْهِ وَاَصْحَابِىْ.
অর্থ : “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে, একটি দল ব্যতীত বাহাত্তরটি দলই জাহান্নামে যাবে। তখন হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম! যে একটি দল নাযাতপ্রাপ্ত, সে দলটি কোন দল? নূরে মুজাসসাম, হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি বলেন, আমি এবং আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের মত ও পথের উপর যারা কায়িম থাকবে (তারাই নাযাত প্রাপ্ত দল)।” (তিরমিযী শরীফ)
অন্য বর্ণনায় এসেছে-
عن حَضْرَتْ مُعَاوِيَّةَ رَضِىَ اللهُ تَعَالـٰى عَنْهُ ثنتان وَّسَبْعِيْنَ فِى النَّارِ وَ واحِدَةٌ فِى الْـجَنَّة وَهِىَ الـجَمَاعَةٌ.
অর্থ : হযরত মুয়াবিয়া রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু উনার থেকে বর্ণিত আছে যে, ৭২টি দল জাহান্নামে যাবে, আর একটি দল জান্নাতে যাবে। মূলতঃ সে দলটিই হচ্ছে আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত।” (মুসনাদে আহমদ শরীফ, আবূ দাউদ শরীফ, মিশকাত শরীফ, মিরকাত শরীফ)
এ হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত জান্নাতী দলটির পরিচয়ে নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি ইরশাদ মুবারক করেন, مَا اَنَا عَلَيْهِ وَاَصْحَابِىْ “মা-আনা আলাইহি ওয়া আছহাবী” অর্থাৎ যে ত্বরীকা মুবারক-এ আমি আছি, আর আমার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা আছেন। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার ত্বরীকা মুবারক বা উনার অনুসৃত পদ্ধতি মুবারক হচ্ছে উনার সুন্নত মুবারক, আর হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের সমষ্টিকে জামায়াত বলা হয়। তাই আলোচ্য হাদীছ শরীফ উনার এ অংশটির মর্মার্থ হল, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত মুবারক এবং উনার ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের জামায়াত উনাদের আদর্শে প্রতিষ্টিত দল। তাই হাদীছ শরীফখানা “আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত” উনার নামের উৎস হিসেবে বিবেচিত।
মুসনাদে আহমদ শরীফ ও আবূ দাঊদ শরীফ উনার বর্ণনায় উক্ত হাদীছ শরীফ উনার শেষাংশে উল্লেখ আছে, জান্নাতী দলটিই হচ্ছে জামায়াত। অন্য বর্ণনায় উল্লেখ আছে, যারা সুন্নত এবং জামায়াত উনার উপর প্রতিষ্টিত তারাই জান্নাতী দল। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার হাদীছ শরীফ উনার মর্মই শুধু আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত নামকরণের উৎস নয় বরং হাদীছ শরীফ উনার সরাসরি শব্দ থেকেই হকপন্থী মুসলমান দলের নামটি গৃহীত। (আক্বীদাতুত ত্বহাবী)
মূলত আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত নামের দুটি অংশ। প্রথম অংশ হচ্ছে সুন্নত ত্বরীকা যা আলোচ্য হাদীছ শরীফ উনার মধ্যে বর্ণিত مَا “মা” শব্দটির মর্ম আর দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের পবিত্র আত্মাসমূহ, যা الـجَمَاعَةٌ “জামায়াত” শব্দটির মর্ম।
সুতরাং এ হাদীছ শরীফ দ্বারা মিয়ারে হক্ব বা সত্যের মাপকাঠি অর্থাৎ মুসলমানদের ৭২টি বাতিল দল থেকে একমাত্র হক্ব বা সত্যপন্থী দলটি পরখ করার মানদ- সাব্যস্ত হল- ১) নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সুন্নত মুবারক আর ২) উনার অনুসারী দল হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের জামায়াত। তাই সুন্নত মুবারক এবং জামায়াত একটি অপরটির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কারণ, সুন্নত মুবারক উনার উপরই জামায়াত প্রতিষ্ঠিত, আর হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনাদের দ্বারাই সুন্নত মুবারক অনুসৃত।
উপরের আলোচনা দ্বারা এ কথা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার একটি প্রসিদ্ধ হাদীছ শরীফ উনার ভিত্তিতেই “আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত” নামকরণ করা হয়েছে এবং সুন্নত রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও জামায়াতে হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা সত্যের মাপকাঠি হওয়াই এ নামকরণের কারণ।
আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত উনার কিছু গুরুত্বপূর্ণ আক্বীদা হচ্ছে- খালিক্ব মালিক রব মহান আল্লাহ পাক তিনি এক। তিনি নিরাকার। তিনি ক্বদিম, হাদিছ নন। উনার সাদৃশ্য কোন কিছুই নেই। নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিনি মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব ও রসূল। তিনি হাদিছ বা সৃষ্টি হওয়ার পরও ক্বদিম উনার সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে উনার মর্যাদা মহান আল্লাহ পাক উনার পরেই। তিনি শুধু মহান আল্লাহ পাক তিনি নন। বাকি সমস্ত মর্যাদা-মর্তবার অধিকারী।
নূরে মুজাসসাম হাবীবুল্লাহ হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনার সাথে সংশ্লিষ্ট হওয়ার কারণে হযরত উম্মাহাতুল মু’মিনীন আলাইহিন্নাস সালাম এবং হযরত আহলে বাইত আলাইহিমুস সালাম উনাদের মুহব্বতই ঈমান আর হযরত আওলাদে রসূল ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উনাদের মুহব্বত হচ্ছে জুযে ঈমান বা ঈমানের অংশ।
হযরত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম উনার মা’ছূম বা নিষ্পাপ আর হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা মাহফুজ বা সংরক্ষিত। হযরত ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুম উনারা মিয়ারে হক্ব বা সত্যের মাপকাঠি। মহান আল্লাহ পাক উনার মুবারক নির্দেশে হযরত ফেরেশতা আলাইহিমুস সালাম উনারা বিভিন্ন কার্য নির্বাহে নিয়োজিত আছেন। পবিত্র কুরআন শরীফ সহ ১০৪ খানা আসমানী কিতাব মহান আল্লাহ পাক উনার নিকট থেকে বিভিন্ন রসূল আলাইহিমুস সালাম উনাদের প্রতি নাযিল হয যা মাখলূক বা সৃষ্ট বস্তু নয় বরং মহান আল্লাহ পাক উনার পাক কালাম। মহান আল্লাহ পাক উনার তরফ থেকেই সমস্ত ভাল-মন্দ তবে মানুষকে তার আমলের ইখতিয়ার দেয়া হয়েছে।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা

সত্য পথের পথিকগণই কেবল নির্ভুল গন্তব্যে পৌছাতে সক্ষম। এই পথেই লাভ হয় সর্বোচ্চ সম্পদ আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি

এই পথ ইসলামের পথ। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম এই পথের পরিচিতি বিস্তারিতভাবে তাঁর তেইশ বছরের পয়গম্বরী জীবনে বর্ননা করে গিয়েছেন।

তিনি অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ সর্বকালের মানুষের নবীনবীদের নবী। জিন ফেরেশতা সমস্ত মাখলুকের নবী।

তিনি আল্লাহ্‌পাকের হাবীব-প্রেমাষ্পদ। তাঁর অনুসরণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতের কামিয়াবী। তাঁর প্রবর্তিত পথ ব্যতিরেকে আল্লাহ্‌ প্রাপ্তির আর কোন পথ নেই। ঐ ব্যক্তিই প্রকৃত জ্ঞানী, যিনি তাঁর সফল অনুসরণের সাধনায় আমৃত্যু নিয়োজিত রয়েছেন। ইসলাম পূর্ন দ্বীন—-পূর্নাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এই পূর্নতা এমনই যে, তাঁর মধ্যে সংযোজন ও বিয়োজনের অবকাশ নেই। এই দ্বীন পরিবর্তন, পরিবর্ধন এবং পরিবর্জনের প্রয়োজন থেকে মুক্তও। হযরত আদম (আঃ) এর মাধ্যমে যে দ্বীনের বীজ বপন করা হয়েছিল, সেই দ্বীনই বিভিন্ন নবীগণের মাধ্যমে কালক্রমে পত্র-পুষ্পে পল্লবিত হয়ে পূর্নতা প্রাপ্ত হয়েছে মহানবী (সঃ) এর নিকটেএসে। আল্লাহ্‌পাক সঃ কথাই এরশাদ করেছেন এভাবে, ‘আজকে আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ন করে দিলাম

এই দ্বীন আমাদের জীবনে পূর্নরূপে প্রতিফলিত করাই আমাদের প্রধান কর্তব্যকর্ম। আল্লাহ্‌পাকের হুকুমও এই রকম। তাই এরশাদ হয়েছে, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পূর্নরূপে ইসলামে দাখিল হয়ে যাও

মহানবী (সঃ) তাঁর অন্তিম ভাষণে জানিয়ে দিয়েছেন,

আমার পরে তোমরা দুটি জিনিসকে আঁকড়ে ধরবে- তবেই তোমরা ভ্রষ্টতা থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। সে দুটি জিনিস হচ্ছে, কোরআন হাদিস

আল কোরআন এবং আল হাদিসের মধ্যেই আমাদেরকে পূর্ন দ্বীনের স্বরূপ তালাশ করতে হবে। এর বাইরে আমাদের চিন্তা চেতনাকে পরিচালিত করার কোনই অবকাশ নেই। আবার কোরআন হাদিসের ঐরূপ অর্থই গ্রহণ করতে হবে, যেরূপ অর্থ উদ্ধার করেছেন আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের সম্মানিত ইমামগণ। কারন শিয়া, মোতালিজা, খারেজী, কাদিয়ানী, মওদুদী প্রভৃতি পথভ্রষ্ট দলও কোরআন ও হাদিস থেকেই দলিল প্রমাণাদি পেশ করে থাকে। তাঁদের প্রদত্ত কোরআন হাদিসের ব্যাখ্যা প্রবৃত্তিপ্রসূত এবং সত্যবিচ্যুত। একমাত্র আহ্‌লে সুন্নত ওয়াল জামাতের আলেমগণই কোরআন হাদিসের সঠিক অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁদেরশিক্ষাধারা সম্মানিত সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এবং সলফে সালেহীনের অনুসরণের দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল। এই জামাতই আল্লাহ্‌পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের পথের পথিকৃৎ। এই জামাতই নাজাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণের জামাত।

তাই প্রতিটি মুসলমানের জন্য প্রথম ফরজ কাজ, এই জামাতের আকিদা বিশ্বাস অনুযায়ী নিজেদের আকিদা বিশ্বাস বিশুদ্ধ করা।

আকিদা বিশ্বাস বিষয়ক সংক্ষিপ্ত বিবরণ এরকমঃ

  • আল্লাহ্‌পাকই অস্তিত্বও। আর যাবতীয় বস্তুকে আল্লাহ্‌পাকই অস্তিত্ব প্রদান করেছেন ।
  • আল্লাহ্‌পাকের জাত (অস্তিত্ব) এক, সেফাত (গুণাবলী) এক এবং আফআলও (কার্যাবলী) এক। কোন ব্যাপারেই তাঁর সংগে কারও কোন শেরকত (অংশ) নেই।
  • আল্লাহ্‌পাকের জাতের মতো তাঁর সেফাত এবং আফআলও বেমেছাল (আনুরূপ্যবিহীন) । যেমন এলেম (জ্ঞান) সেফাতএই গুন আদিঅন্তবিহীন, অবিভাজ্য এবং আনুরূপ্যবিহীন। সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত প্রকার জ্ঞাতব্য বিষয় এলেম সেফাত কর্তৃক বিকশিত হয়েছে। আল্লাহ্‌তায়ালা সমস্ত বস্তুকে তাঁদের অনুকূল প্রতিকূল অবস্থায় আংশিক ও সমষ্টিগতভাবে প্রত্যকের বিশিষ্ট সময় সহ এক অবিভাজ্য মুহূর্তেই জেনেছেন। আল্লাহ্‌পাকের এলেম খন্ড-বিখন্ড হওয়া এবং অন্য কারো মতো হওয়া থেকে পবিত্রও। আল্লাহ্‌পাকের অন্যান্য সেফাতকেও এইরূপ ধারনা করতে হবে । যেমন কালাম (বাক্য) সেফাত। এই সেফাতও অবিভাজ্য, অতুলনীয় এবং এক। আল্লাহ্‌পাক আদি থকে অন্ত পর্যন্ত ঐ একটি বাক্য দ্বারাই বক্তা। আদেশ, নিষেধ, বিজ্ঞপ্তি অথবা যে কোন বিষয়ের বর্ননাই হোক না কেন, তা ঐ বাক্য থেকে উৎসারিত। তওরাত, ইঞ্জিল, যবুর অথবা কোরআনসবই ঐ এক কালাম (বাক্য) সেফাত থেকে এসেছে। আল্লাহ্‌তায়ালার অন্যান্য সেফাতও তাঁর জাতের মতোই এক, অবিভাজ্য এবং তুলনাবিহীন। এরকম আল্লাহ্‌পাকের আফআলও (কার্যকলাপও) এক, অবিভাজ্য এবং আনুরূপ্যবিহীন। সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাবতীয় কার্যকলাপ (সৃষ্টি, ধ্বংস, জীবন, মৃত্যু, উত্থান, পতন ইত্যাদি) ঐ এক ও অতুলনীয় কার্যেরই বিকাশ।
  • আল্লাহ্‌তায়ালা কোন বস্তুর মধ্যে প্রবেশ করেন না এবং কোন বস্তুও তাঁর মধ্যে প্রবেশ করে না । তিনি যাবতীয় বস্তুকে ঘিরে আছেন, যাবতীয় বস্তুর সঙ্গে আছেন; কিন্তু এই ঘিরে থাকা ও সঙ্গে থাকা সম্পর্কে আমাদের ধারনায় যা আসে সেরকম অবশ্যই নয়। তিনি ধারনার অতীত ।
  • আল্লাহ্‌পাকের জাত (স্বত্তা), সেফাত (গুন) ও আফআলের (কার্যাবলী) মধ্যে কোন পরিবর্তন হয় না ।
  • আল্লাহ্‌তায়ালা গনি অর্থাৎ শর্তবিহীন, অভাবশুন্য। তাঁর জাত সেফাত আফআল কোন বিষয়েই তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। অস্তিত্বে, গুণাবলীতে, কার্যাবলীতে সর্ব বিষয়েই তিনি অমুখাপেক্ষী।
  • আল্লাহ্‌পাক যাবতীয় ক্ষতি এবং নতুনত্বের কালিমা থেকে মুক্তও। তিনি দেহবিশিষ্ট ননস্থান কাল সম্ভূতও নন। সমস্ত প্রকার পূর্নতা একমাত্র তাঁহারই মধ্যে বর্তমান।
  • আল্লাহ্‌তায়ালা আদিঅন্তশুন্য। তিনি ব্যতীত কেউই আদিঅন্তশূন্য নয় ।
  • আল্লাহ্‌তায়ালা সর্বশক্তিমান ও ইচ্ছাময়য়। তিনি ইচ্ছা এবং শক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে সম্পূর্ন স্বাধীন। তিনি বাধ্যতা থেকে পবিত্র। যাবতীয় সৃষ্টি সর্বশক্তিমান ও ইচ্ছাময়ের সৃষ্টির প্রতি নির্ভরশীল । তিনিই সমস্ত সৃষ্টিকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্বে এনেছেন। অতএব, সৃষ্ট বস্তুসমূহের অস্তিত্ব যেমন অস্তিত্ব প্রাপ্তি হিসেবে তাঁর মুখাপেক্ষী, তেমনি স্থায়িত্ব লাভের জন্যও তাঁরই মুখাপেক্ষী ।
  • সৃষ্ট বস্তুসমূহ যেমন আল্লাহ্‌পাকের সৃষ্টি, তেমনি তাঁদের মধ্যে দৃশ্যমান তাছিরও (প্রতিক্রিয়া সমূহ) তাঁরই সৃষ্টি। যেমন, আগুনের প্রজ্বলন শক্তি, ওষুধের রোগ নিরাময় ক্ষমতা ইত্যাদি । সাধারণভাবে বস্তুসমূহের তাছির স্বীকার করতে হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে এইরূপ ধারনা রাখতে হবে যে, আল্লাহ্‌তায়ালার ইচ্ছা না হলে কোন বস্তুর তাছির তো দূরের কথা, সেই বস্তুর অস্তিত্বও বিলুপ্ত হতে বাধ্য ।
  • সৃষ্টি বস্তুর তাছির থেকে উপকার গ্রহণ তাওয়াক্কোল (আল্লাহ্‌র প্রতি নির্ভরতা) বিরোধী নয়, বরং এরকম করাই প্রকৃত জ্ঞানীর স্বভাব। যেমন রোগনিরাময়ের জন্য ওষুধ সেবন, যুদ্ধবিজয়ের জন্য অস্ত্রসম্ভার বৃদ্ধির প্রচেষ্টা, পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য অর্থ উপার্জনের প্রচেষ্টা ইত্যাদি ।
  • আল্লাহ্‌ তায়ালা ভাল মন্দ উভয় কার্যের স্রষ্টা। কিন্তু ভাল কাজে তিনি সন্তুষ্ট এবং মন্দ কাজে অসন্তুষ্ট। বান্দাগণের কেবল মাত্র ইচ্ছা করবার অধিকার আছে। বান্দাগণ ভাল অথবা মন্দ কাজের ইচ্ছা করলে আল্লাহ্‌পাকই তা সৃষ্টি করে দেন। তাই সৃষ্টি করনের কাজ আল্লাহ্‌তায়ালার সঙ্গে এবং এরাদা (ইচ্ছা) করবার স্বাধীনতার কারণে অর্জন করা বান্দাগণের সঙ্গে সম্বন্ধিত ।
  • তকদীরের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। তাকদীর অর্থ ভাগ্যলিপি। আল্লাহ্‌পাক যেহেতু আদি-অন্তের জ্ঞানসম্পন্ন, তাই তিনি প্রত্যকের কর্মফল সম্পর্কে অবশ্যই জানেন। তাঁর জ্ঞাতব্য বিষয় পূর্বাহ্নে লিপিবদ্ধ করা আছে। তাঁর নামই তকদীর ।
  • বেহেস্ত ও দোযখ বর্তমান আছে। বেহেস্ত লাভকারী ব্যক্তিগণকে অবশ্যই ইমানদার হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে বেহেস্তে প্রবেশ আল্লাহ্‌পাকের মেহেরবানীর উপর নির্ভর করে। আর ঈমান হচ্ছে আল্লাহ্‌পাকের সর্বশ্রেষ্ঠ মেহেরবানী ।
  • দোযখে প্রবেশের কারন কুফরি (অবিশ্বাস)। ইমানদার মানুষ কোন গুনাহ্‌র কাজে লিপ্ত হলে পার্থিব বিপদ আপদের মাধ্যমে তাঁর ক্ষতিপূরণ হয় অথবাআল্লাহ্‌পাক মৃত্যুর সময় কষ্ট দিয়ে তাকে পাপমুক্ত করে নেন। এর পরেও গুনাহ্‌ থাকলে কবরের আজাব তাঁর ক্ষতিপূরণের কারন হয় । তাঁর পরেও গুনাহ্‌থাকলে কিয়ামতে ভয়াবহ আজাবের মাধ্যমে তাঁর গুনাহ্‌ মাফ করা হবে। এর পরেও কারো গুনাহ্‌ অবশিষ্ট থাকলে সাময়িকভাবে দোযখের শাস্তি ভোগের পর তাকে বেহেস্তে প্রবেশ করান হবে। কিন্তু যে প্রকৃতই কাফের বা অংশীবাদী অথবা আহলে কিতাব (যেমন মুর্তিপূজক, ইহুদী, খ্রিষ্টান, কাফের ইত্যাদি) সে অনন্তকাল ধরে দোযখের শাস্তি ভোগ করবে ।
  • ইমানদারগণ আখিরাতে আল্লাহ্‌তায়ালার দিদার লাভ করবেন। কিন্তু তা হবে দিক, প্রকার এবং উদাহরণ রহিত অবস্থায়। আমাদের ধারনায় দীদারের যে রকম অর্থ আসে সেরকম নয়। কারন, আল্লাহ্‌পাক যেমন ধারণাতীত, তেমনি তাঁর দীদারও হবে ধারণাতীত অবস্থায় ।
  • নবী ও রাসূল প্রেরণ আল্লাহ্‌পাকের রহমত। তাঁদের দ্বারাই মানুষ সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে সক্ষম হয়েছে। তাঁদের প্রতি অহি’ (প্রত্যাদেশ) সত্য। অহির প্রতিকুল যা কিছু, সবই মিথ্যা ।
  • নবী ও রাসূলগণ নিষ্পাপ। তারা আল্লাহ্‌পাকের নির্বাচিত ব্যক্তি। আল্লাহ্‌পাকই তাদেরকে সর্ব অবস্থায় হেফাজত করেন বলে তারা গুনাহ্‌ থেকে সুরক্ষিত থাকতে সক্ষম হন। ঘটনাক্রমে তাঁদের দ্বারা কোন ভুল হলে আল্লাহ্‌পাকই তা সংশোধন করে দেন। ভুলের মধ্যে তারা স্থায়ীভাবে আবদ্ধ থাকেন না ।
  • হযরত মোহাম্মদ (সঃ) শেষ নবী। তাঁর পরে আর কোন নবী নেই ।
  • কবর আজাব সত্য। কবরে মুনকির নকির নামক ফেরেশতাদ্বয়ের প্রশ্ন করা সত্য ।
  • কিয়ামত সত্য। হযরত ইস্রাফিল (আঃ) এর শিঙ্গার এক ফুঁৎকারে যাবতীয় সৃষ্টবস্তু ধ্বংস হয়ে যাবে। আর এক ফুঁৎকারে সবাই পুনর্জীবন লাভ করে হাশরের ময়দানে সমবেত হবে ।
  • হাশরের ময়দানে আল্লাহ্‌পাক বান্দাগণের হিসাব গ্রহণ করবেন। মীযানেও (তুলাদণ্ডে) নেকি বদি ওজন করা হবে। সবাইকে পুলসিরাত অতিক্রম করার হুকুমদেওয়া হবে ।
  • ফেরেশতাগণ আল্লাহ্‌পাকের বান্দা। তারা নিষ্পাপ এবং ভুল-ভ্রান্তি থেকে পবিত্রও । তাঁদের পানাহার নেই। তারা স্ত্রীও নন, পুরুষও নন। বেলায়েতের(নৈকট্যের) দিক থেকে তারাই অগ্রগামী। নবুয়তের দিক থেকে নয়। আর নবুওত বেলায়েতের তুলনায় শ্রেষ্ঠ। বেলায়েতে সোগরা (অলিগণের বেলায়েত),বেলায়েতে কোবরা (নবীগণের বেলায়েত), বেলায়েতে উলিয়া (ফেরেশতাগনের বেলায়েত) যে কোন বেলায়েতই হোক না কেন, নবুওতের মোকাবেলায় তা মহাসমুদ্রের একবিন্দু পানির; বরং তাঁর চেয়ে কম। যেহেতু নবুয়তের সম্মান মানুষকে দেয়া হয়েছে, তাই বিশিষ্ট মানুষই বিশিষ্ট ফেরেশতার তুলনায় শ্রেষ্ঠ ।
  • ইমানের অর্থ দ্বীনের বিষয়ে যা কিছু আমাদের নিকট সঠিকভাবে পৌঁছেছে, তাঁর প্রতি কলব বা অন্তর দ্বারা বিশ্বাস করা, বাক্য দ্বারা সাক্ষী দেয়া এবং কার্য দ্বারা তা প্রমান করা ।
  • আকৃতিগত ভাবে ঈমান বাড়ে না, কমেও না। কিন্তু এর উজ্জ্বলতা বাড়ে বা কমে। যেমন সাধারণ মুমিনের ইমানের ঔজ্জ্বল্য অপেক্ষা নবী অলিগণের ইমানেরঔজ্জ্বল্য অনেক বেশী। ইমানদারগনের দৃঢ়ভাবে বলা উচিত, ‘আমি সত্য ইমানদার ইমামে আজম এরূপ বলতেন ।
  • নবীগণের মোজেজা এবং অলিগণের কারামত সত্য। মোজেজা নবুওতের দাবির শামিল। কারামত দাবির বিষয় নয়। বরং কারামত মোজেজার অনুসরণে সম্পাদিত হয় ।
  • খোলাফায়ে রাশেদীনের শ্রেষ্ঠত্বের ক্রম তাঁদের খেলাফতের ক্রমানুযায়ী। যেমন, হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) অপেক্ষা , তিনিহযরত ওসমান (রাঃ) অপেক্ষা এবং তিনি হযরত আলী (রাঃ) অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ।
  • সম্মানিত সাহাবীগণের মধ্য যেসমস্ত কলহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তাঁর উৎকৃষ্ট অর্থ গ্রহণ করতে হবে। ঐ সমস্ত কলহ প্রবৃত্তিপ্রসূত ছিল না। বুঝবার ভুলের কারনে ঐ সমস্ত ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। মাসআলা উদ্ধার করতে গিয়ে ভুল মাসআলা উদ্ধারকারী একগুণ সওয়াব এবং সঠিক মাসআলা উদ্ধারকারী দ্বিগুণ সওয়াব পান। রাসূলে পাক (স:) এর সহবতের ফলে তারা কুপ্রবৃত্তির প্রভাব থেকে চিরদিনের জন্য মুক্তিলাভ করেছিলেন। সর্বশ্রেষ্ঠ অলিআল্লাহ্‌ও কখনোসর্বনিম্ন মর্যাদাধারী সাহাবীর মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হন না। কলুষ অন্তর বিশিষ্ট লোকেরাই কেবল সম্মানিত সাহাবীগনের সমালোচনায় লিপ্ত হয়ে পড়ে ।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতাদর্শ

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত হচ্ছে মুমিন-মুসলিমের সহজ-সরল ও পরিশুদ্ধ বিশ্বাস পোষনকারী দল । যাহাদেরকে আকিদা-বিশ্বাসের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকেকোন শাস্তি দেওয়া হইবে না । বরং পুরস্কৃত করা হইবে । তাহারা এই উম্মতের মোট ৭৩ ফিরকা বা দলের মধ্যে একমাত্র দল যাহারা মহানবী (সঃ) ও তাহারসাহাবীগনের শুদ্ধ ও বিশ্বস্ত অনুসারী । ইহা ছাড়া আরো বহু বাতিল ফেরকা থাকিবে, যাহাদেরকে অনুসরন করা হইলে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হইয়া পড়িবে । এইপ্রসঙ্গে মহান আল্লাহ্‌ বলিয়াছেনঃ

এবং এই পথই আমার পথ । সুতরাং তোমরা ইহারই অনুসরন করিবে এবং বিভিন্ন পথ অনুসরন করিবে না, করিলে উহা তোমাদিগকে তাহার পথ হইতে বিচ্ছিন্ন করিবে । এই ভাবে আল্লাহ্‌ তোমাদিগকে নির্দেশ দিলেন যেন তোমরা সাবধান হও ।

সূরা আনআম আয়াত ১৫৩

তাফসীরে আহমদীর ৪৪ পৃষ্ঠায় এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আছেঃ

ইহা (এই পথ) বলিয়া উক্ত সূরায় প্রথমে ওয়াহদানিয়াত (আল্লাহর একত্ববাদ) ও নবুয়াত অর্থাৎ রিসালাত সপ্রমান করনার্থে এবং শরীয়াতের ব্যবস্থাগুলির বিবরন যাহা উল্লিখিত হইয়াছে তাহার প্রতি ইশারা করা হইয়াছে । অর্থাৎ উল্লিখিত সমস্ত বিষয় আমার সত্যপথ, কাজেই তোমরা শুধু এই পথেরই অনুসরন কর এবং শরীয়ত বিরোধী বিদআত নিয়মগুলি, প্রাচীন ধর্মগুলি ও ইসলাম ধর্মের বিপরীত অন্য পথসমূহের অনুসরন করিও না ।”

মূলকথা, উক্ত সূরায় উল্লিখিত হইয়াছে যে তোমরা শিরক করিও না, পিতা-মাতার সহিত সদ্ব্যবহার করিও, ন্যায় বিচার করিও, অঙ্গীকার পূর্ন করিও, সন্তান হত্যা,ব্যভিচার ও নরহত্যা করিও না, পিতৃহীন শিশুদের অর্থ আত্মসাৎ করিও না, মাপে কম-বেশী করিও না । অতঃপর আল্লাহ্‌ বলিয়াছেন, এই সকল আমার সত্য পথ,ইহা ত্যাগ করে অন্যান্য দ্বীন ও বিদআত মত অবলম্বন করিও না ।

মিশকাত, ৩০ পৃষ্ঠায় বর্নিত আছে যেঃ

হযরত রাসূলে করিম (সঃ) একটি রেখা অংকন করিয়া বলিলেন যে, ইহা আল্লাহ্‌ তাআলার পথ । এরপর তিনি উহার ডান ও বাম দিকে কয়েকটি রেখা অঙ্কন করিয়া বলিলেন, এইগুলি বিভিন্ন পথ, এই সকল পথের প্রত্যেকটিতে এক একটি করে শয়তান উহার দিকে আহবান করিয়া থাকে । তখন মহানবী (সঃ) উল্লিখিত আয়াতটি পাঠ করেন ।

মিশকাত শরীফ, ৩০ পৃঃ

হাদিসটির মর্মার্থ এই যে, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের পথটিই একমাত্র আল্লাহ্‌ তাআলার মনোনীত পথ তদ্ব্যতীত শিরক ও মুনাফেকী ও বিদআত সাইয়্যেয়াহ্‌ সমন্বিত অন্যান্য পথগুলি শয়তানের পথ । উক্ত নাজাতী বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত যে একটি সত্যদল তার প্রমাণস্বরূপ মিশকাত শরীফের অপর একটি হাদিস উল্লেখ করিতেছিঃ

মিশকাত, ৩১ পৃষ্ঠাঃ

হযরত নবী পাক (সঃ) বলিয়াছেন, নিশ্চয় বনী ইসরাইল ৭২ দলে বিভক্ত হইয়াছিল, আর আমার উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হইবে । একদল ব্যতীত তাহাদের সমস্তদলই দোযখে পতিত হইবে । সাহাবাগন আরজ করিলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! ঐ মুক্তিপ্রাপ্ত বা জান্নাতি দলটি কাহারা হইবে ? মহানবী (সঃ) বলিলেনঃ “আমি ও আমার সাহাবাগন যেই পথে আছি-এই মতাবলম্বী দল উক্ত বেহেশতী ফেরকা” ।

মিশকাত, পৃঃ ৩১

কোন কোন সলফে সালেহীন “মা আনা ওয়া আস্‌হাবিহি” এর ব্যাখ্যায় বলেন, যাহারা আমার নবুয়াত-রিসালাতকে মানিবে এবং অলিগণকে মানিবে তারাই হইল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত । যেহেতু সাহাবাগন ছিলেন ওলী, তাই “মা আনা আলাইহি” বলতে নবুয়াতের যুগ এবং “আসহাবী” বলতে বেলায়াত এর যুগকে বুঝানো হইয়াছে । অপর এক রেওয়ায়েতে আছে ৭২ দল দযখী হইবে এবং একদল বেহেশতী হইবে । উক্ত বেহেশতী দল আলেম ও ফকীহ সম্প্রদায় হইবে ।” যাহারা নবী পাক (সঃ) ও তাহার সত্য পথপ্রাপ্ত খলিফাগনের সুন্নাতের দৃঢ় অনুসরনকারী, তাহারাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত নামে অভিহিত, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই । যাহারা হযরত নবী করিম (সঃ) ও তাহার সাহাবাগনের অনুরুপ মত (আকীদা) ও রীতিনীতি অবলম্বন করিয়াছেন, তাহারাই সত্যগামী, ইহা ছাড়া সমস্তই বাতিল বা পথভ্রষ্ট ।”

আশিয়াতুল লুমআত, খ ১/১৫১ পৃষ্ঠাঃ

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতই নাজাতী দল । কেননা অসংখ্য প্রমানে ও হাদিসসমূহের অনুসন্ধানে স্থির সিদ্ধান্ত এই যে, সাহাবা, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগন এইরুপ আকীদা (মত) ও তরিকা অবলম্বী ছিলেন । বিদআত মতগুলি প্রথম জামানার পর সৃষ্টি হইয়াছে । সাহাবা ও প্রাচীন তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগন এই বিদআতে সাইয়্যেয়ার মতাবলম্বী ছিলেন না । সিহাহ সিত্তাহ্‌ সঙ্কলক এবং অন্য মুহাদ্দিসগন, চার ইমাম-আবূ হানিফা (রঃ), শাফেয়ী, মালেক, আহমদ ইবন হাম্বল (রঃ) এবং তাহাদের সমশ্রেনী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুরুপ মাযহাবধারী ছিলেন । আশআরীয়া ও মাতুরিদিয়া হইতেছে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা । বিশ্বাসের তাত্ত্বিক বিশ্লেষনকারী ধারার দুইটি নাম । মহানবী (সঃ) এর সুন্নাহ ও সালফ সালেহীন তথা সাহাবা ওতাবেঈগনের ঐক্যমতের ভিত্তিতে যে সহীহ আকীদা পোষণকারী দল শুরু হইতে চলিয়া আসিতেছে তাহারই নাম আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত । এ মাযহাব ও বিশ্বাস প্রাচীন । হযরত নবী (সঃ) এর হাদীসসমূহের অনুসরন ও প্রাচীন বিদ্বানগনের পদানুসরন করাই ছিল তাহাদের রীতি । তাহারা নিতান্ত আপত্তিজনক কারন ব্যতীত সকল স্থলে কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট অর্থটি গ্রহন করিয়াছেন । মোতাজেলা, শিয়া, বর্তমান নব্যসৃষ্ট মউদুদি জামাআত ও লামাযহাবী, কাদিয়ানী ও সালাফীগন অনুরুপ মতাবলম্বী ছিলেন না । প্রাচীন পীর বুজুর্গগন এই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মাযহাবের অনুসারী ছিলেন । তাহাদের আকীদা ও সুন্নী জামাআতের আকীদা একই । পূর্ব-পশ্চিম দেশের হাদীস, তাফসীর, আকায়েদ, ফিকাহ, তাসাউফ, ইতিহাস ইত্যাদির কিতাবগুলির অনুসন্ধান করিলে, ন্যায়পরায়ন ব্যক্তিগন ইহা বুঝিতে পারিবেন ।

আল্লাহ্‌তায়ালার অস্তিত্ব ও আল্লাহ্‌ পাক সম্পর্কিত আক্বীদা

আল্লাহ্‌তায়ালাই প্রকৃত অস্তিত্ব । তিনি ছাড়া বাকী যা কিছু আছে সে সমস্তকে আল্লাহ্পাকই অস্তিত্বে এনেছেন। সুতরাং স্বয়ং অস্তিত্ব যিনি, তিনিই আল্লাহ্ । তিনি খালেক (স্রষ্টা) । আর তিনি যাদেরকে অস্তিত্ব প্রদান করেছেন তারা মাখলুক (সৃষ্টি) ।

আল্লাহ্পাকের জাত (সত্তা ও অস্তিত্ব) এক, অদ্বিতীয়। তাঁর সিফাত (গুণাবলী) এক, অদ্বিতীয় এবং তাঁর আফআল (কার্যাবলী)ও এক, অদ্বিতীয় । তাঁর অস্তিত্ব, গুণাবলী ও কাজ, সৃষ্টির অস্তিত্ব,গুণাবলী এবং কাজের মতো নয় । প্রকৃতপক্ষে কোনো বিষয়ে কেউ বা কোনো কিছু তাঁর সঙ্গে সংযুক্ত নয় । অংশীও নয়। না অস্তিত্বের বিষয়ে। না গুণাবলী বা কাজের বিষয়ে । আল্লাহ্পাকের জাত প্রকারবিহীন (বে-মেছাল) ।তাঁর সিফাতও বে-মেছাল । তেমনি তাঁর কার্যকলাপও বে-মেছাল । সৃষ্ট বস্তুসমূহের জাত, গুণ ও কাজের সঙ্গে তাঁর কোনোই সম্বন্ধ নেই ।

ফেরেশতা সম্পর্কিত আক্বীদা

ফেরেশতাবৃন্দ আল্লাহ্তায়ালার দাস। তাঁরা ভুলভ্রান্তি এবং গোনাহ্ থেকে সুরক্ষিত ও পবিত্র। আল্লাহ্তায়ালার আদেশ তাঁরা যথাযথভাবে পালন করেন। এসম্পর্কে আল্লাহ্তায়ালার এরশাদ এরকম

এবং যাহাই আদিষ্ট হয়, তাহাই করে

সূরা তাহরীম, ৬ আয়াত

ফেরেশতাদের পানাহারের প্রয়োজন হয় না। তারা না নারী; না পুরষ । কোনো কোনো ফেরেশতাকে আল্লাহ্পাক রেসালত বা সংবাদ বহনের জন্য নির্বাচনকরেছেন, যেমন মানুষের মধ্যেও রসুল বা বাণীবাহক আছেন। আল্লাহ্পাকের এরশাদ

আল্লাহ ফেরেশতা এবং মানুষের মধ্য থেকে রসুল নির্বাচন করে থাকেন।

সূরা হজ, ৭৫ আয়াত

সত্যবাদী আলেমগণের অধিকাংশের মত এই যে, বিশিষ্ট মানুষ বিশিষ্ট ফেরেশতা থেকে শ্রেষ্ঠ। তবে ইমাম গাজ্জালী র. ইমামুল হারামাইন আব্দুল মালেক র. এবংফুতুহাতে মক্কিয়ার রচয়িতা শায়েখ মুহিউদ্দিন আরাবী র. বিশিষ্ট ফেরেশতাকে বিশিষ্ট মানুষ থেকে শ্রেষ্ঠবলে মত প্রকাশ করেছেন।

হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি র. বলেন, এই ফকিরের প্রতি যা উদ্ভাসিত হয়েছে তা এই- ফেরেশতাগণের বেলায়েত বা নৈকট্য নবী আ.গণের বেলায়েত থেকে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু নবুয়ত এবং রেসালতের মধ্যে নবী-রসুলগণের এমন এক মর্যাদা আছে, যা ফেরেশতাগণের কোনোদিনই লাভ হবার নয়। এই মর্যাদামাটির কারণে হয়েছে, যে মাটি ফেরেশতাদের মধ্যে নেই। এ প্রসঙ্গে এই ফকিরেরনিকট আরো প্রকাশ পেয়েছে যে, কামালতে নবুয়তের (সংবাদ প্রেরণ সম্পর্কিত পূর্ণতার) তুলনায় কামালতে বেলায়েতের (নৈকট্যসম্ভূত পূর্ণতার) কোনোই মূল্য নেই। আক্ষেপ! যদিমহাসাগরের তুলনায় একবিন্দু পানির অস্তিত্বতুল্যও হতো! অতএব বুঝতে হবে, বেলায়েতজাত উৎকর্ষ অপেক্ষা নবুয়তজাত উৎকর্ষ বহুগুণবেশী। তাই, একথা নিশ্চিত যে, নবী-রসুলগণই সাধারণ শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।

ফেরেশতাগণের শ্রেষ্ঠত্ব আংশিক। কাজেই সত্যবাদী অধিকাংশ আলেমগণ যা বলেছেন, তা-ই ঠিক। আল্লাহ্পাক তাঁদের প্রচেষ্টা সফল করুন। আমিন।
এই আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার যে, কোনো ওলি কখনো নবীর স্তরে উপনীত হতে পারেন না। সর্বাবস্থায় ওলির মস্তক নবীর পদতলে। জানা আবশ্যক যে, কোনো মাসআলার ব্যাপারে আলেম ও সুফী সমাজের মধ্যে দ্বিমত দেখা দিলে আমি দেখি, আলেমগণের পক্ষই অধিক সত্য। এর রহস্যএই যে, পয়গম্বর আ. এর অনুসরণের কারণে তাঁদের লক্ষ্য কামালতে নবুয়তের এলেমের (ওহীজাত এলেমের) প্রতি স্থিরনিবদ্ধ থাকে। আর সুফীগণের দৃষ্টি নিবদ্ধথাকে কামালতে বেলায়েতজাত মারেফাতের দিকে। তাই বেলায়েত থেকে গৃহীতএলেম অপেক্ষা নবুয়তের তাক থেকে গৃহীত এলেম অধিকতর স্পষ্ট ও সঠিক হয় । ফেরেশতাগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ফেরেশতা চার জন ।
১. হজরত জিবরাইল আ. ইনি রসুলগণের নিকট ওহী বা প্রত্যাদেশ বহন করে নিয়ে আসেন ।
২. হজরত মীকাইল আ. এর উপর সমস্ত সৃষ্টজীবের জীবিকা পৌঁছানোর দায়িত্ব দেওয়াহয়েছে। জীবিকার বণ্টন-বিভক্তি ও পরিমাণ নির্ধারণের দায়িত্ব তাঁর উপরেই ন্যস্ত।
৩. হজরত ইস্রাফিল আ. ইনি শিঙ্গা ধারণ করে আছেন। তাঁর শিঙ্গার প্রথম ফুৎকারে কিয়ামত এবং দ্বিতীয় ফুৎকারে হাশর অনুষ্ঠিত হবে।
৪. হজরত আজরাইল আ. ইনি সমস্ত সৃষ্টজীবের রূহ কবজ করার দায়িত্ব পালন করেন।
এই চারজন ছাড়া আরো অনেক উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন এবং আল্লাহ্তায়ালার নৈকট্যভাজন ফেরেশতা আছেন। তাঁদের মধ্যে আটজন মহাসম্মানিত ফেরেশতা আল্লাহ্তায়ালার আরশ ধরে আছেন। এঁরা আকারে অতি বৃহৎ। তাঁদের কানেরলতি থেকে কাঁধ পর্যন্ত দূরত্ব দুশবছরের পথের দূরত্বের সমান। আরেক বর্ণনায়বলা হয়েছে, সাতশ বছরের রাস্তার দূরত্বের সমান।

শায়েখ আব্দুল হক মোহাদ্দেছে দেহলভী র. বলেন এ কথার উপর বিশ্বাসরাখা কর্তব্য যে, আল্লাহ্তায়ালাই ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা নূরের তৈরী । তাঁরা যে কোনো আকার ধারণ করতে পারেন। তাঁদের রূহ এবং শরীরই তাঁদের পোশাক । ফেরেশতাদের মধ্যে নারী পুরুষ বলে কিছু নেই। তাঁদের বংশবিস্তারও নেই। আকাশ ও পৃথিবীর সকল জায়গায় তাঁরা কর্মরত। তাঁরা এই বিশ্বজগতের তত্ত্বাবধায়ক এবং রক্ষণাবেক্ষণকারী । একজন মানুষের সঙ্গে কয়েকজন ফেরেশতাথাকেন। কেউ আমল লেখেন, কেউ হেফাজত করেন শয়তান এবং ক্ষতিকর অনেক কিছু থেকে। ঊর্ধ্ব ও অধঃ জগতের সকল পরিসর তাঁদের কার্যতৎপরতায় মুখর। হাদিস শরীফে এসেছে, সমগ্র সৃষ্টিজগতকে দশভাগে ভাগ করলে নয় ভাগহবে শুধু ফেরেশতাফেরেশতারা পাখা অথবা বাহুবিশিষ্টও হন । তাঁদের মধ্যেকারো কারো দুই, তিন কিংবা চার জোড়া পর্যন্ত পাখা হয়। কোরআন মজীদে ফেরেশতাদের বাহু সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে । সুতরাং এর উপরে ইমান রাখা জরুরী । তবে ফেরেশতাদের পাখার সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা একমাত্র আল্লাহ্তায়ালারই আছে। এরকম ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, পাখা তাদের শক্তিরপ্রতীক । ফেরেশতাদের নেতা হজরত জিবরাইল আ. এর ছয়শতপাখাদেখেছিলেন রসুলে আকরম স. । মেরাজ বিষয়ক হাদিসে এরকম বিবরণ আছে । এক হাদিসে এসেছে, রসুলে করিম স. বলেন, প্রত্যেক ইমানদার ব্যক্তির উপর আল্লাহ্তায়ালার পক্ষ থেকে তার নিরাপত্তার জন্য তিনশ ষাট জন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকেন । তাঁরা তাঁর প্রত্যেক অঙ্গের হেফাজত করেন । তার মধ্যে সাতজন ফেরেশতা রয়েছেন কেবল চোখের নিরাপত্তা বিধানের কাজে নিয়োজিত। নিশ্চিত ও নির্ধারিত নয়, এরকম বিপদাপদ থেকে তাঁরা মানুষকে এমনভাবে নিরাপদ রাখেন, যেমন মধুর পাত্রের দিকে ছুটে আসা মাছির দলকে পাখা ইত্যাদির সাহায্যে তাড়িয়ে দেয়া হয় । মানুষের জন্য এরকম নিরাপত্তা-ব্যবস্থা না থাকলে শয়তান তাকে ছিনিয়ে নিত ।

নবী(আঃ)গণ সম্পর্কিত আক্বীদা

নবী রসুল প্রেরণ পৃথিবীবাসীদের জন্য রহমত বা দয়া। তাঁদের মধ্যস্থতাব্যতিরেকে অবশ্যম্ভাবী আল্লাহ্তায়ালার জাত সিফাতের জ্ঞানলাভ ছিলো অসম্ভব। আল্লাহ্তায়ালার সন্তুষ্টির অনুকূল ও প্রতিকূল বিষয়াবলীতো তাঁদের মাধ্যমেই পার্থক্য লাভ করেছে। তাঁদের দাওয়াতী নূরের সাহায্য ছাড়া আমাদের প্রজ্ঞা ও মনীষা অপূর্ণ ও অপদস্থ। জ্ঞান দলিল বটে, কিন্তু পূর্ণ দলিল নয়। পয়গম্বর প্রেরণই পূর্ণ দলিল, যার প্রতি আখেরাতের সওয়াব ও আজাব নির্ভর করে।

তাঁদের প্রতি অবতীর্ণ ওহী (প্রত্যাদেশ) সত্য। ওহীর মাধ্যমে শরিয়ত প্রতিপালনের যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, তাও আল্লাহ্তায়ালার রহমত। শরিয়ত অস্বীকারকারী বেদ্বীন কাফেরেরা বলে, কেমন ধরনের রহমত যে, মানুষকে নামাজ রোজা ইত্যাকার কষ্টকর কাজের আদেশ দিয়ে বলা হয়, এটি তোমাদের জন্য রহমত। শরিয়তের আদেশ-নিষেধসমূহ পালন করলে বেহেশত, আর না করলে দোজখ। এসব তো বন্দীত্ব। স্বাধীনতা নয়। এ ধরনের কথা যারা বলে, তারা প্রকৃতই নির্বোধ ও অকৃতজ্ঞ। তারা একথা জানে না যে, যিনি আমাদেরকে অস্তিত্ব দিয়েছেন এবং অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অসংখ্য নেয়ামত দানে ধন্য করেছেন, সেই নেয়ামতদাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আমাদের উপরে ওয়াজিব (অবশ্যকর্তব্য)। আর শরিয়তের দায়িত্বাবলী তো সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপকরণ মাত্র। অতএব, জ্ঞানতঃ শরিয়তের দায়িত্ব সম্পাদন করা অপরিহার্য। আবার পৃথিবীর শৃক্সখলা রক্ষাও এই দায়িত্বপালনের উপর নির্ভরশীল। শরিয়তের শাসন না থাকলে দুষ্টামী, নষ্টামী ও বিশৃঙ্খলায় পৃথিবী পূর্ণ হয়ে যেতো । প্রত্যেক স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তি অপরের সম্পদের প্রতি অন্যায় হস্তক্ষেপ করতো। এভাবে সূত্রপাত হতো শত সহস্র বিপর্যয়ের। এভাবে অত্যাচারীরা অপরকে ধ্বংস করতো। নিজেরাও ধ্বংস হতো। পৃথিবীর শৃঙ্খলা ও শান্তি শরিয়তের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ প্রয়োগের ফলেই সম্ভব হয়ছে। আল্লাহ্পাক এরশাদ করেছেন

এবং প্রতিশোধ বাস্তবায়নের মধ্যেই তোমাদের জীবন রয়েছে, ওহে বিবেচক ব্যক্তিগণ।সূরা বাকারা , ১৭৯ আয়াত

আল্লাহ্পাক সকল কিছুর মালিক। বান্দাগণ তাঁর পূর্ণ দাস। তিনি আপন দাসদের প্রতি যে আচরণই করেন, অথবা যে আদেশই প্রদান করেন তা অবশ্যই বান্দাদের জন্য কল্যাণকর ও সংশোধনসূচক বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ্তায়ালা এরশাদ করেন

তিনি যা করেন, সে সম্পর্কে প্রশ্ন করবার কেউ নেই।সূরা রা, ৪১ আয়াত

তাঁর পরাক্রম দেখে সাধ্য আছে কার সমর্পণ ছাড়া কথা বলবে আবার।

আল্লাহ্তায়ালা সমগ্র সৃষ্টিকে চিরদিনের জন্য দোজখে স্থাপন করলেও প্রতিবাদের অবকাশ নেই। এতে অত্যাচারের সন্দেহও অবান্তর। আমাদেও অধিকার এর বিপরীত। বরং আমাদেরকে অধিকার তো দিয়েছেন আল্লাহ্তায়ালাই। অতএব, চিন্তা-চেতনায়, বক্তব্যে, আচরণে ও কর্মে ওই পর্যন্তঅগ্রসর হওয়াই আমাদের জন্য সঙ্গত, যে পর্যন্ত প্রকৃত মালিক আমাদের জন্য বৈধ বা মোবাহ সাব্যস্ত করেছেন।নবী-রসুলগণ মাসুম (নিষ্পাপ)। তাঁদের দ্বারা ভুল সংঘটিত হতে পারে। কিন্তু ভুলের উপরে স্থায়ী থাকা তাঁদের পক্ষে সঙ্গত নয়। আর ভুল কিন্তু গোনাহ্ নয়। গোনাহ্ তাদের দ্বারা সংঘটিত হতেই পারে না । আবুল আলা মওদুদীর মতো মোরতাদ ব্যক্তিরা ভুলকে গোনাহ্ মনে করে সম্মানিত, পবিত্র ও নিস্পাপ নবী রসুলগণকে দোষী সাব্যস্ত করে। আল্লাহ্পাক ওই সকল বেদ্বীন ব্যক্তিদের অপবিত্র বিশ্বাস থেকে সকল ইমানদারকে নিরাপদ রাখুন। আমিন।

অল্লাহ্তায়ালা নবী-রসুলগণকে মোজেজা বা অলৌকিক ঘটনা দ্বারা সাহায্য করেছেন। মোজেজা সত্যা। মোজেজা দ্বারা ইমান লাভ হয়। মোজেজা নবুয়তের সত্যতার অটল প্রমাণ।

নবী ব্যতীত অন্য কেউ মোজেজা প্রকাশ করতে পারে না। আল্লাহ্পাকের নিয়ম এই যে, তিনি কারণ ছাড়া সাধারণত কোনোকিছু সৃষ্টি করেন না। এটা তাঁর কানুন (বিধান)। কিন্তু কোনো কোনো সময় তিনি তাঁর কানুনকে ভেঙে তাঁর অপার কুদরতের প্রকাশ ঘটান। কোনো প্রকাশ্য কারণ ছাড়াই নবী-রসুলের মাধ্যমে অলৌকিক ঘটনা সৃষ্টি করে দেন। মোজেজা আসলে আল্লাহ্তায়ালারই কাজ,যদিও তা নবী-রসুলগণের মাধ্যমে দৃষ্টিগোচর হয়। কারণ, আল্লাহ্তায়ালার কানুন ভেঙে ফেলার ক্ষমতা রয়েছে কেবল আল্লাহরই। নবুয়তের দাবী একটি অসাধারণ দাবী। তাই অসাধারণ ঘটনা (মোজেজা) তার প্রমাণ হিসাবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। মোজেজা আল্লাহতায়ালার কুদরত। মোজেজা প্রকাশিত হওয়া মানে ইমানের সম্পূর্ণ কানন উন্মোচিত হওয়া। ইমানের অক্ষয় কাননের চিরসুবাসিত আশ্রয় থেকে এর পরেও যারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তারা সত্যিই সত্তাগতভাবে দুর্ভাগ্যশীল ।

হজরত মোহাম্মদুর রসুলুল্লাহ্‌ সল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়া সালাম নবী ও রসুলগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনিই শেষ নবী। তাঁর পরে আর কোনো নবী আসবেন না। একথা যারা বিশ্বাস করে না, তারা নিঃসন্দেহে কাফের। যেমন কাদিয়ানি সম্প্রদায় ।

রসুলে আকরম মোহাম্মদ মোস্তফা আহমদ মুজতবা স. আল্লাহ্তায়ালার মাহবুব (প্রেমাস্পদ)। তিনি জ্বিন, ইনসান, ফেরেশতা সকলের নবী। নবীগণেরও নবী। আল্লাহ্তায়ালা সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন নূরে মোহাম্মদী স.। প্রথম নবী হজরত আদম আ. যখন সৃষ্ট হননি, তখনও তিনি নবী ছিলেন। প্রকৃত ইমানদার ওই ব্যক্তি, যিনি তাঁর সকল প্রিয় বস্তু, এমনকি নিজের জীবন অপেক্ষা রসুলেপাক স. কে বেশী ভালোবাসেন। কিন্তু বাতিল ও বেআদব ওহাবী সম্প্রদায় ভালোবাসার বদলে রসুলে করিম স. এর প্রতি পোষণ করে শত্রুতা। এদের জঘন্য ও ঘৃণ্য আকিদা বিশ্বাস সম্পর্কে শামী, আশ শিহাবুছ ছক্বিব, বাহারে শরিয়ত ইত্যাদি পুস্তকে পরিষ্কার বর্ণনা করা আছে। আমার হাতের লাঠি মোহাম্মদ অপেক্ষা অধিক উপকারী’-এরকম কথা কেবল ওহাবী শয়তানদের অপবিত্র মুখেই উচ্চারিত হওয়া সম্ভব [1]

মুহাম্মাদ (সঃ) নূর

নবী করিম (সঃ) নূর হওয়ার অর্থ এটা নয় যে, তিনি আল্লাহ্‌র সত্ত্বাগত মূল দৈহিক নূরের অংশ বিশেষ । এবং এটাও নয় যে, তিনি রসূলের নূরের উৎস আল্লাহ্‌র সত্ত্বাগত মূলের নূর । এবং এটাও নয় যে, হুজুরের নূর আল্লাহ্‌র মত সত্ত্বাগত চিরস্থায়ী । এটাও নয় যে, রব্বুল আলামীন নবীর মধ্যে ঢুকে গেছেন । যাতে শিরক ও কুফরী সংঘটিত হয়ে যায় । বরং অর্থ ইহাই যে, হুজুর (সঃ) মাধ্যম বিহীন আল্লাহ্‌ থেকে ফয়েজ গ্রহণকারী । যেমন- একটি বাতি হতে দ্বিতীয় আর একটি বাতি জ্বালানোর পর দ্বিতীয় বাতি হতে আরও হাজার হাজার বাতি জ্বালান । অথবা একটি শিশা সূর্যের সামনে রাখুন, এতে শিশাটি জ্বলে উঠবে । তারপর ঐ শিশাটিকে ঐ শিশাগুলোর দিকে ফিরিয়ে দিন, যেগুলো অন্ধকারের মধ্যে অবস্থিত । এতে সমস্ত অন্ধকারস্থ শিশা জ্বলে উঠবে । এ কথা স্পষ্ট যে, প্রথমোক্ত শিশার মধ্যে সূর্য স্বয়ং এসে যেমন উপস্থিত হয়নি তেমনি সূর্যের অংশ বিশেষ শিশার মধ্যেও রাখা হয়নি । বরং শুধুমাত্র এটাই হয়েছে যে, প্রথম শিশা বিনা মাধ্যমে সূর্যের আলোকে আলোকিত হয়েছে এবং অবশিষ্ট সমস্ত শিশা ঐ শিশা হতে আলো লাভ করেছে । যদি প্রথম শিশাটি মধ্যস্থলে না হত তাহলে অবশিষ্ট সমস্ত শিশাগুলি অন্ধকারাচ্ছন্ন থেকে যেত । উদাহরণস্বরূপ এটা বুঝে নিন যা রাব্বুল আলামীন হযরত আদম (আঃ) সম্পর্কে বলেছেন-

আর যখন আমি তাঁকে ঠিক করলাম এবং তাঁর মধ্যে আমি আমার রুহ ফুকে দিলাম তখন তোমরা সকলেই তাঁর সামনে সিজদায় অবনত হবে ।

হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে বলেন

তিনি (ঈসা (আঃ)) তাঁর রুহ ।

এ কারনে হযরত ঈসা (আঃ) কে রুহুল্লাহ বলা হয় । ইহার অর্থ এটা নয় যে, আদম (আঃ) ও ঈসা (আঃ) উভয়েই আল্লাহ্‌র রুহ এর টুকরো বা অংশ বিশেষ বা আল্লাহ্‌ তাঁদের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন ।

বরং আদমকে কোণ পিতামাতা ছাড়া এবং ঈসাকে পিতার মাধ্যম ছাড়াই আল্লাহ্‌ তাঁদের মধ্যে রুহ দান করেন । অনুরূপ নবী করিম (সঃ) আল্লাহ্‌র নূরহওয়ার অর্থ এটাই যে, তিনি সৃষ্টি জগতের কোণ মাধ্যম ব্যতীত প্রভু থেকে ফয়েজ লাভ করেন ।

তাকদীর সম্পর্কিত আক্বীদা

তকদীরের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। তাকদীর অর্থ ভাগ্যলিপি। আল্লাহ্‌পাক যেহেতু আদি-অন্তের জ্ঞানসম্পন্ন, তাই তিনি প্রত্যকের কর্মফল সম্পর্কে অবশ্যই জানেন। তাঁর জ্ঞাতব্য বিষয় পূর্বাহ্নে লিপিবদ্ধ করা আছে। তাঁর নামই তকদীর ।

(সংগৃহীত)

Comments

comments