খবরের বিস্তারিত...

মোদি বিরোধী আন্দোলনে হেফাজত: আন্তজার্তিক অঙ্গনে কী বার্তা দেবে?

মোদি বিরোধী আন্দোলনে হেফাজত: আন্তজার্তিক অঙ্গনে কী বার্তা দেবে?

প্রসঙ্গ কথা: ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ একটি অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন। এর ঢালপালাও রয়েছে অনেক। দেশের কওমীপন্থী হাজার হাজার মাদরাসা এর আওতাভুক্ত। এ জাতীয় মাদরাসাগুলোতে কোরআন-হাদীস, নাহু-চরফ এবং ইলমে দ্বীন শিক্ষা দেন আলেমরা। স্বাধীনতার পর থেকে এ জাতীয় মাদরাসাগুলো সৌদি আরবসহ আরব রাষ্ট্রের অনুদান এবং সাধারণ মানুষ থেকে চাঁদা উত্তোলনের মাধ্যমে মাদরাসার অর্থ ভান্ডার যোগান হয়। সরকারের কোন অনুদান ভোগ করা অবৈধ ও হারাম মনে করত হেফাজতীরা এবং নিজেদেরকে এ অর্থে খারেজী বলত যে আমরা সরকারের অনুদান গ্রহণ থেকে মুক্ত। তারা জ্ঞান অর্জন করত আরবী, উদ্দু ও ফার্সী ভাষায়। বাংলা ও ইংরেজী ভাষার জ্ঞান অর্জন করাকেও দীর্ঘকাল হারাম ও অবৈধ বলে জানত। এমনকি অনেক বায়োজৈষ্ঠ্য আলেম নিজেদের নাম পর্যন্ত বাংলায় লিখতে সক্ষম হতেন না। হেফাজতের সাবেক আমির মাওলানা আহমদ শফী সাহেবের স্বহস্তে লিখিত স্বাক্ষর আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। অথচ বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতা অর্জন করা ইসলামের দৃষ্টিতে দোষের কিছু নয়। ইংরেজী আন্তর্জাতিক ভাষা আর বাংলা ভাষা মাতৃভাষা। এই দুই ভাষায় বিদ্যা অর্জন থেকে যারা সুদীর্ঘকাল নিজেদেরকে বিরত রেখে নিজেদেরকে একটি দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ রেখেছেন। ফলে আধুনিক প্রযুক্তিসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনেক শিক্ষা থেকে হেফাজত নিয়ন্ত্রিত মাদসারা শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত। বর্তমান সমাজে পরিপূর্ণ মানুষ হতে ইসলামী শিক্ষার সাথে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় ঘটাতে হবে। ( এ নীতিতে কওমীরা বিশ্বাসী ছিল না, ফলে তারা দেশের অর্থ ব্যবস্থা উন্নতি এবং অগ্রগতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি ) যাতে মানুষ দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জাহানে মুক্তি লাভ করে। প্রকৃত শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এসব মাদরাসাগুলো নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রক এবং স্বতন্ত্র। রাষ্ট্র এখানে ভূমিকা রাখতে পারবে না। এ মাদরাসাগুতে জাতীয় দিবস উদযাপিত হয় না, জাতীয় সঙ্গীতের চর্চা হয় না। আলীয়া মাদরাসা থেকে কোন ডিগ্রী অর্জন করাকে অবৈধ বলে জানত। কেউ নিলে তার ভর্তি বাতিল করত। তাদের মতে পৃথিবীতে ৩টি শ্রেষ্ট মাদরাসা রয়েছে ১মটি হচ্ছে ভারতে দেওবন্দ মাদরাাসা, ২য়টি হচ্ছে হাটহাজারী, ৩য়টি হচ্ছে পটিয়া মাদরাসা। তবে ২য় এবং ৩য় স্থান নিয়ে তাদের মাঝে পার্থক্য আছে। সূদূঢ়প্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে সারাদেশে হেফাজতের মাদরাসাগুলো তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।

উগ্রবাদ ও ধ্বসাংত্মক কর্মসূচী: উগ্রবাদ যে কোন ধর্মেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইসলাম তো মোটেই সমর্থন করে না। এটি হেফাজতের মধ্যে লক্ষ্যনীয়। কথায় কথায় হুমকি-ধমকি দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রে একটি অস্থিশীল পরিবেশ তৈরীতে তারা প্রশিক্ষিত। ব্লগার ইস্যুতে তাদের কর্মকাণ্ড জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। শাপলা চত্বরে ইসলামের হেফাজতে কথা বলে কোরআন শরীফ, জায়নামাজ ও ধর্মীয় বইয়ে আগুনে দেয়ার দৃশ্য ও তথ্য কারো অজানা নয়। ভাস্কর্য ইস্যুতে সিংহের মত মাঠ গরম করে বিড়ালের মত চরিত্র ধারণ করাও দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। নারায়ে তাকবীর বলে ভাঙ্গচুর করা, গাড়ীতে আগুন দেয়া তাদের অন্যতম নীতি। অন্যদিকে নিজেদেরকে ইসলামের ধারক-বাহক মনে করে সর্বদা। আবার মতের অমিল হলে রক্তের বন্যা বসিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। স¤প্রতি হাটহাজারীতে এ্যসিল্যান্ড অফিসে হামলা করা, নথিপত্র নষ্ট করা, আইন-শৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীকে বিনা উস্কানীতে হামলা করা এবং সর্বোপরি থানায় হামলা করা তারই উজ্জ্বল প্রমাণ।

জঙ্গিবাদ: মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, সদা যুদ্ধাংদেহী ভাব মনোভাব পোষণ করা তাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মানুষকে জিম্মি করে অধিকার আদায় করা , ভিন্ন ধর্মী কিংবা নাস্তিক হলে তাকে হত্যা করার জায়েজ মনে করা কোনটিই ইসলাম সম্মত নয়। ইসলাম শান্তির ধর্র্ম। সকল ধর্মের শান্তি ও মুক্তির গ্যারান্টি দিয়েছে ইসলাম। তারা বরাবরই ইসলামের অপব্যাখ্যা করেছে তাদের কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যের মাধ্যমে। বাংলাদেশে ইত্যকার সকল জঙ্গী কর্মকাণ্ডে কওমী মাদরাসার ছাত্র কিংবা তাদের মতাদর্শের সম্পৃক্ততা উচ্চ আদালতেও প্রমাণিত। মুফতি হান্নান, বাংলা ভাই ও শায়খ রাহমান তাদেরই সৃষ্টি। ৬৪জেলায় একযোগে বোমা হামলা, ২১আগস্টের গ্রেনেড হামলা, আইন-আদালত অঙ্গনে বোমা হামলা, সিলেটে শাহ জালাল (রহ.) এর মাজারে বোমা হামলা তাদের অন্যতম উপহার। মাঝে মাঝে সকল মাজার ভেঙ্গে ফেলার হুংকার ছাড়েন।

সুন্নী-হেফাজতী: সুন্নী ও হেফাজতের মধ্যে ইসলামের মৌলিক বেশ কিছু বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) এর শান-মান প্রশ্নে সুন্নীরা সতর্ক এবং কোরআন-সুন্নাহ অনুসরণে বিশ্বাসী। পক্ষান্তরে হেফাজতরী বেপরোয়া। মিলাদ-কিয়ামকে নাযায়েজ মনে করে, প্রিয় নবী (দ.) ইলমে গায়বকে অস্বীকার করে, অলী-আওলীদের মাজার জিয়ারতকে মাজার পূজা বলে, মহান আল্লহ মিথ্যা বলতে পারেন -এ জাতীয় আক্বীদা পোষণ করে। সুন্নীদেরকে বেদাতী ও মাজার পূজারী বলে তিরস্কার করে সর্বদা। অন্যদিকে আব্দুল ওহাব নজদীর সাথে যোগসূত্রের কারণে সুন্নীরা তাদেরকে ওহাবী বলে ।

হরতাল: ইসলামের দৃষ্টিতে হরতাল জায়েজ? হরতাল কার বিরুদ্ধে? যুদ্ধ কার বিরুদ্ধে- আপনি কী আপনার ধর্ম পালন করতে পারছেন না? আপনার ধর্ম পালনে কেউ বাধা দিয়েছেন? হরতালে দেশের অর্থনীতি এবং জানমালের ক্ষতি হয় । জানমালের ক্ষতি সাধন হয় এমন কর্মকাণ্ড ইসলামে নিষিদ্ধ। যেখানে হাদীসে এরশাদ হচ্ছে- ইমাতাতুল আজা আনিত তাারিক্ব- অর্থাৎ রাস্তায় চলাচলের সময় রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা । এটি রাস্তায় হাটার সময় ৩টি করণীয় কাজের মধ্যে অন্যতম। আর হেফাজত নেতারা কষ্টদায়ক বস্তু অপসারণ করা তো দূরের কথা- বরং রাস্তায় দেয়াল নির্মাণ করে, অগ্নি সংযোগ করে মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে অস্থিতিশীল করেছেন। হেফাজত নেতারা হাদীসের এ ব্যাখ্যায় কী উত্তর দিবেন? একজন মোদির আগমণকে ঠেকাতে গিয়ে কতটা ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড করেছেন -তার জররা জররা হিসাব দিতে হবে মহান আল্লাহর দরবারে।

আন্তর্জাতিক ইস্যু : সম্প্রতি তাদের আরেকটি বিষয় যোগ হয়েছে। এবার তাদের পদোন্নতি। কতো দিন তারা জাতীয় ইস্যু নিয়ে আবদ্ধ থাকবেন। আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়েও তাদের নাক গলাতে হবে। তাই এবার তারা আরেকটু মডারেট হয়ে দুনিয়ার অন্যতম ক্ষমতাধর রাষ্ট্র ভারতের রাষ্ট্র প্রধানের আগমণ বিরোধী তাদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, যুদ্ধাংদেহী মনোভাব, সীমাহীন উগ্রবাদ প্রচার জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। এক সময় শ্লোগান দিত- “আমরা সবাই তালেবান-বাংলা হবে আফগান” । এবার তারা নিজেদেরকে ওসামা বিন লাদেন-মোল্লা ওমরের উত্তরসূরী দাবিকৃত বাংলাকে আফগানিস্তান বানাতে চায়, জঙ্গী রাষ্ট্র বানাতে চায়। শান্তিতে দু’মুটো ভাত খাওয়া তাদের পছন্দ না। দেশে অস্তিতিশীল পরিবেশ তৈরী করতে হবে। এসব বিষয়ে কোরআন-হাদিসকে তাদের নিজেদের মত ব্যাখ্যা করে । অথচ মহান আল্লাহ বলেন – ইন্নাল্লাহা লা ইউহিব্বুল মুফসিদীন অর্থাৎ নিশ্চয় মহান আল্লাহ তা’য়ালা জমিনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না। ব্যক্তি মোদির মুসলিম বিরোধী কর্মকাণ্ড তাবৎ মুসলিম জনগোষ্ঠী ঘৃণা ভরে প্রত্যাখান করেছে। সবাই লাল কার্ড দেখিয়েছে। যখন মোদি ভারতের নির্বাচিত রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে নিজ দেশের সুবর্ণ জয়ন্তী কর্মসূচীতে অতিথি হয়ে আসেন- তখন আমাদের প্রতিবাদের ভাষা কী রকম হওয়া উচিত ছিল? শান্তিপূর্ণ মিছিল ও গণজমায়েত করে আন্তর্জাতিক বিশ্বকে দেখিয়ে দেয়া যেত না? কেন এ্যসিল্যান্ড অফিসে হামলা? থানায় কেন হামলা হল? কেনইবা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমকে রক্তে রঞ্জিত করার মত পরিবেশ তৈরী করা হল? তারা জাতির কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে- পুলিশের সাথে এরা কারা? জাতি জানতে চায়- মসজিদে লাঠি-সোটা-ইট-পাথর নিয়ে এরা কারা? আপনারা নিজেদেরকে ইসলামের রক্ষক মনে করেন। আদাবুল মসজিদের কথা বেমা’লুম ভুলে গিয়েছেন? মসজিদ আল­াহ ঘর । এতে সুন্দর আওয়াজে-নীরবে মহান আল­াহর নিকট প্রার্থনা করতে হয়। চিৎকার করে আপনি জিকির পর্যন্ত করতে পারেন না। রফউচ চাওতে হারামুন ফিল মসজিদে ওয়ালাও কানা জিকরান অর্থাৎ পবিত্র মসজিদে উচ্চস্বরে কথা বলা হারাম যদিও তা জিকির তথা ইবাদত হয়। এ মাসআলা রহিত হয়ে গেছে?

মসজিদে জঙ্গী স্টাইলে লাটি-সোটা নিয়ে আন্দোলন করে হেফাজতের নেতারা কী বার্তা দিলেন? এটার নামই কী ইসলাম? অনেক হেফাজত নেতা দারুল হারব ঘোষণা দিয়ে নিজেদের অপকর্মকে বৈধতা দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছেন। হেফাজতের এ আন্দোলনের ফলে ভারত-বাংলাদেশ’র মধ্যে আমদানী-রপ্তানীর যে বৈষম্য রয়েছে তা আরও প্রকট হবে, সর্ববৃহৎ পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহজ হবে, ইসলাম মর্ধ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে নেতিবাচক ম্যাসেজ যাবে। সর্বোপরি দেশের অর্থনীতির অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

চলবে…
মুহাম্মদ আহসানুল আলম
২৮ মার্চ ২০২১খ্রি.

Comments

comments